X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মায়ের কাছে গেলেন আনিসুল হক

আহসান কবির
০৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:২৫আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:৪১

আহসান কবির খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলেন তিনি। হাসপাতালের বিছানায় কি তার বার বার মনে পড়ছিল ‘ফুঁ দিয়ে দেওয়া’ মায়ের মুখ? মেট্রিক পরীক্ষার সময়ে তার জ্বর হয়েছিল। সকালে উঠে তিনি বলেছিলেন তার পক্ষে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব না। তার মা তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন পরীক্ষার হলে। মাত্র ৩৪ নম্বরের উত্তর দিতে পেরেছিলেন। হল থেকে ফিরে মাকে বলেছিলেন, মা পাস করা হয়তো হবে না। মা যখন জানতে চাইলেন ‘কেন’, তখন তিনি বলেছিলেন মাত্র ৩৪ নম্বরের উত্তর দিতে পেরেছি। মা তার কপালে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে নফল নামাজ পড়লেন। এরপর তাকে ‘ফুঁ’ দিয়ে দিলেন। পরীক্ষার পর তিনি অবাক হয়ে খেয়াল করলেন সেই পরীক্ষাতে তিনি চৌত্রিশই পেয়েছেন! আর পাস নম্বর হচ্ছে ৩৩।
হাসপাতালের বিছানায় হয়তো তিনি মাকেই খুঁজে ফিরেছেন। ‘ফুঁ’ দিয়ে তাকে জাগিয়ে তুলতে পারতেন তার মা। মা আসেননি বলে কি তিনি শেষমেষ মায়ের কাছেই ফিরে গেলেন? আনিসুল হক আপনি যেখানে গেছেন সেখানে মা কি দাঁড়িয়ে আছেন আপনাকে বরণ করার জন্য? তিনি কি আবারও ‘ফুঁ’ দিয়ে আপনাকে বরণ করবেন?
খুব বেশি দূর যেতে হলো না আপনাকে। আর্মি স্টেডিয়ামে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে আপনি আপনার মায়ের পাশেই ঘুমালেন!

নিজের মায়ের মতোই ‘মা’দের খুব পছন্দ করতেন আপনি। বলতেন,  মায়েরাই পারেন! বাংলাদেশ টেলিভিশনের সোনালি সময়ের জনপ্রিয় উপস্থাপক ছিলেন আপনি। মজার এক অনুষ্ঠানে (আজ আর মনে নেই, সেটা একুশে টেলিভিশনের ঈদের ঢোল অনুষ্ঠান কিনা) আপনি এক মাকে হাজির করেছিলেন। সবাই ভেবে নিয়েছিল, সেই মা হয়তো মজাদার কিছু করে দেখাবেন। আনিসুল হক বললেন, ‘তাঁকে আমি পরিচয় করিয়ে দেব। আপনারা যে পরিচয়ে চেনেন, সেই পরিচয়ে নয়। এই মায়ের ছেলে যুদ্ধে গিয়েছিল। যুদ্ধ শেষ কিন্তু তাঁর ছেলে ফিরে আসেনি। একদিন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের এক ছবি দেখে তার ভেতরে নিজের ছেলেকে খুঁজে পেলেন। এরপর ছুটে গেলেন সেই ছবির মানুষদের কাছে। তারা জানালো ছেলেটা যুদ্ধে মারা গেছে। আসুন আজ এখানে যারা আছি তারা এই মাকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাই!’ সেদিন যারা টেলিভিশন দেখেছিলেন, তাদের অনেকেই কান্না সামলাতে পারেননি। মেয়র হিসেবে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি হিসেবে গিয়েছিলেন আপনি। নিজের মায়ের কথা আর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আজাদের মায়ের কথা বলেছিলেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে। যে মা ৭১ সালের ১৫ আগস্ট জানতে পারেন, তার ছেলেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে গেছে। রমনা থানায় আছে সে। মা ছুটে গেলেন রমনা থানায়। দেখলেন, ছেলে শুয়ে আছে মেঝেতে। ছেলেটা মায়ের কাছে ভাত খেতে চেয়েছিল। মা ভাত নিয়ে এসে দেখেন ছেলে সেখানে আর নেই। এরপর সেই মা আরও পনেরো বছর বেঁচে ছিলেন। এই পনেরো বছর সেই মা আর ভাত খাননি। এক লোকমা ভাতও কেউ তাকে খাওয়াতে পারেনি। ঘুমুতেন মেঝেতে। পনের বছর পর আরেক পনেরো আগস্টে এই মা মারা যান। তার কবরের ফলকে লেখা আছে–‘শহীদ আজাদের মা’!

জানি না, আপনার কবরের ফলকে কিছু লেখা থাকবে কিনা। এই দেশটাকে আপনি মায়ের মতোই ভালোবাসতেন। ঢাকাকে যে তিলোত্তমা করে সাজানো যায়, গড়ে তোলা যায়, সেটা আপনি করে দেখানো শুরু করেছিলেন। আমার মতো অনেকে কল্পনা করেনি যে, আপনি তেজগাঁও কাওরান বাজারের ট্রাক স্ট্যান্ড নিজে নেতৃত্ব দিয়ে উচ্ছেদ করতে পারবেন, সেখানে দৃষ্টিনন্দন রাস্তা হবে আর পাবলিক টয়লেট হবে। বনানী গুলশানের অনেকেই ভাবেননি যে, দূতাবাসগুলোর দখল করা জায়গা আপনি উদ্ধার করতে পারবেন, ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির উত্তর অংশে রাস্তার পাশের ফুটপাত দিয়ে প্রতিবন্ধীরাও চলাচল করতে পারবেন! ‘ঢাকার চাকা’ নামের বাস সার্ভিস হবে মানুষের কল্যাণে, রিকশাচালকরাও পরবে ভিন্ন পোশাক, যেন মানুষ তাদের সহজেই চিনতে পারে! আমার মতো অনেকেই কল্পনা করেননি যে গাবতলী আমিন বাজার কিংবা সাভারের বাস-ট্রাক টার্মিনালকে কেউ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন! অনেকে কল্পনা করেননি যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, উত্তরা, টঙ্গি ও গাজীপুরের যানজট নিয়ন্ত্রণে ২২টি ইউলুপ করা যেতে পারে, বনানী, গুলশান ও বিমানবন্দরগামী সড়ক প্রশস্ত করা সম্ভব অথবা রাস্তার দুই পাশের দৃশ্য আরও দৃষ্টিনন্দন করা সম্ভব! দেয়ালে পোস্টার লাগানোর নিয়ম করা কিংবা বিলবোর্ড সরিয়ে নিয়ে ঢাকাকে আরও সুন্দর করে গড়ে তোলা যেন আপনার পক্ষেই সম্ভব ছিল। গুলশান বনানীর লেক ও লেকের পাশের রাস্তা নিয়ে ১৬ বছর ধরে যে মামলা চলছিল সেটা সমাধান করে লেকের দুই পাশ আপনি সাজিয়ে ছিলেন দৃষ্টিনন্দন করে। রাজনীতির মারপ্যাঁচ ও পেশিশক্তি দিয়ে কনস্ট্রাকশন বা উন্নয়নের নামে টেন্ডারবাজির মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে নেওয়া এবং ঠিকমতো কাজ না করার চিরাচরিত রেওয়াজটা আনিসুল হক আপনি বলেই বন্ধ করতে পেরেছিলেন! হীন রাজনীতির এই একচোখা দৈত্যকে আপনি সাময়িক সময়ের জন্য হলেও বধ করতে পেরেছিলেন।

পারেননি ঈর্ষাকাতর কিছু অমানুষের মুখ বন্ধ করতে যাদের একমাত্র কাজ ছিল কুৎসা রটনা করা। তেজগাঁ কাওরান বাজারের ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ ও নতুন রাস্তা নির্মাণ এবং গাবতলী আমিনবাজারের বাসস্ট্যান্ডে ডিসিপ্লিন ফিরিয়ে আনার পর এই রটনাকারীরা বলেছিলেন, ‘পারতো না পেরেছে সেনাপ্রধান ভাইয়ের জন্য!’ কাওরান বাজারের মাছ ও সবজিবাজার সরিয়ে মহাখালি নিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়েও ঘোটপাকানো হয়েছে, এই সুন্দর কাজটি যেন আপনি করতে না পারেন সেটা নিয়েও কথিত আন্দোলনকারীদের মাঠে নামানো হয়েছিল। কাওরানবাজার ও বনানী ডিসিসি মার্কেটে আগুন লাগার পর প্রচারণা চালানো হয়েছিল কার স্বার্থে এই আগুন? সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলবার পরেও আপনার বিরুদ্ধে রটনাকারীরা হার্ডলাইনে খেলা শুরু করেছিল। তারা কুৎসিতভাবে প্রচার করতে শুরু করে যে, আপনি সরকারবিরোধী প্রচারণায় লিপ্ত ছিলেন বলে আপনি ইংল্যান্ডে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন! আপনি নাকি অসুস্থ নন, অসুস্থ হলে নাকি আপনার হাসপাতালের ছবি ছাপা হতো পত্রিকায় কিংবা দেখানো হতো টেলিভিশনে। কাদম্বিনীর মতো আপনাকে ‘মরিয়া প্রমাণ করিতে হইলো যে আপনি অসুস্থ ছিলেন’। আপনার পরিবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আপনার নাতিকে হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রীর আদর করার ছবিটি ফেসবুকে প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল। আপনি যেদিন শেষবারের মতো হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি হন, সেদিন একটি বেসরকারি টেলিভিশন ব্রেকিং নিউজ দিয়ে আপনার মৃত্যুর খবর প্রচার করেছিল। আপনি মরে যাওয়ার আগেই আপনাকে মৃত বানিয়ে ফেলেছিল কুৎসারটনাকারীরা! আপনি আমাদের এই হীনতা ক্ষমা করে দেবেন।

সবশেষে এটাই সত্য যে, আপনি না ফেরার দেশেই চলে গেছেন। আপনি টেলিভিশন ছেড়ে ব্যবসায়ীদের রাজ্যে চলে যাওয়ার আগে টেলিভিশনের জন্য রেখে গেছেন অনেক আইকন অনুষ্ঠান। হতে পারে সেটা ‘বলা না বলা’ কিংবা ‘সবিনয়ে জানতে চাই’ এর মতো অনুষ্ঠান। টেলিভিশন অনুষ্ঠানে কিংবা ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমই-এর অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে আপনি এক করতে পেরেছিলেন! এখনই কিংবা অন্তরালে অনুষ্ঠানের সফল ও জনপ্রিয়তম উপস্থাপক ছিলেন আপনি। জলসা অনুষ্ঠানে আপনি ক্ল্যাসিসিকাল ও ব্যান্ডশিল্পীদের দিয়ে ভিন্নধর্মী একটা গানের অনুষ্ঠান করেছিলেন। গান কিংবা রাজনীতি, ম্যাগাজিন কিংবা ঈদের অনুষ্ঠানের আইডিয়া করাতে আপনি ছিলেন অনন্য। ব্যবসায়ীদের সংগঠন কিংবা মেয়র হিসেবে আপনার করা আইডিয়া এবং এর বাস্তবায়নে আপনি অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন। উপস্থাপক, ব্যবসায়ী নেতা ও কর্মবীর হিসেবে আপনি যত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, একজনমে খুব কম মানুষের পক্ষেই সেটা পাওয়া সম্ভব।

শিল্পী ও ক্ষণজন্মা সুরকার লাকী আখান্দ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। আপনি ছুটে গেলেন লাকী আখান্দের বাসায়। লাকী ভাই হারমোনিয়াম বাজানো শুরু করলেন আপনি তার সঙ্গে গলা মেলালেন–আবার এলো যে সন্ধ্যা। শুধু দু’জনে, চলো না ঘুরে আসি অজানাতে। এরপর আপনি নতুন একটা সংগঠনের জন্ম দিলেন। শিল্পীর পাশে আমরা। লাকী ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য লাখ লাখ টাকা উঠলো সংগঠনের পক্ষ থেকে, লাকী ভাই চিকিৎসা নিতে গেলেন বিদেশে। লাকী ভাই ফেরেননি, তার সঙ্গে আনিসুল হক, শেষমেষ আপনিও চলে গেলেন অজানাতে!

প্রিয় আনিসুল হক, আপনি চলে যাওয়ার দিন আপনার বিরুদ্ধে যারা কুৎসা রটিয়েছিল, তাদের কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবু কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছে আপনার জানাজা কেন আর্মি স্টেডিয়ামে হবে, কেন সেটা সংসদ ভবনে নয়? আপনি চলে যাওয়ার দিন কোটি মানুষের চোখ ছলছল করেছে। আপনি বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন, ‘আমারও ঘরের মলিনও দীপালোকে/ জল দেখেছি যেন তোমার চোখে।’ এরপর সেই মুক্তিযোদ্ধার মায়ের মতো হয়তো তাদেরও বুকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করতেন!

যেখানে যাবেন, সেখানে হয়তো আপনার মা অপেক্ষা করছেন। অপেক্ষা করছেন শহীদ আজাদ ও সেই মুক্তিযোদ্ধার মা। আপনাকে তারা ফুঁ দিয়ে বরণ করে নেবেন। আপনার একটা টিভি অনুষ্ঠানের শেষপর্বে আপনি একটি ইতিহাসের গল্প বলেছিলেন। রাজা মারা গেছেন। কেউ বিশ্বাস করেননি যে, রাজা মারা যেতে পারেন। হাজারো মানুষ তাই প্রতিদিন ভিড় করতো তার কবরের কাছে। রাজার হাতি এসে করুণভাবে সুরটা তুলে সালাম জানাতো। সবার মনে হতো রাজা ফিরবেনই!

চলে যাওয়ার পর ইতিহাসের কোনও রাজাই ফেরেন না। রাজারা বেঁচে থাকেন অসংখ্য ভালোবাসার মানুষের হৃদয়ে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: কুৎসা রটনাকারীদের মুখে ছাই দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছুটে গিয়েছিলেন আপনার বাসভবনে। ইতিহাস জন্ম দিতে পারেন যে রাজা, সেই রাজার কন্যা ঠিকই জানেন কে আসল আর কে ষড়যন্ত্রকারী! কে মোশতাক আর কে আনিসুল হক!

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
হামলার ঘটনায় মামলা করায় এবার বোমা হামলা, আহত ১৫
হামলার ঘটনায় মামলা করায় এবার বোমা হামলা, আহত ১৫
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ