X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাহুল গান্ধীর অগ্নিপরীক্ষা!

চিররঞ্জন সরকার
১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:৫৭আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:০১

চিররঞ্জন সরকার

সভাপতি যে তিনিই হবেন, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ ছিল না। মা সোনিয়া গান্ধীর অসুস্থতা ব্যাপারটিকে ত্বরান্বিত করেছে মাত্র। তবে তিনি যথেষ্টই সময় নিয়েছেন। হ্যাঁ, লিফট নয়, তিনি সিঁড়ি দিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়েছেন। একাই মনোনয়ন দিয়েছিলেন। লড়াইয়ের ময়দান একেবারেই ছিল সাফ। হিসেব মেনেই রাহুলই বসলেন সভাপতি পদে। গত ১১ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে রাহুলকে কংগ্রেসের সভাপতি পদে বসানোর কথা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ১৩২ বছরের পুরনো এই রাজনৈতিক দলের হাল এবার তার হাতেই। গুজরাট নির্বাচনের আগেই রাহুলকে সভাপতি নির্বাচন করা হবে বলে জানিয়েছিল কংগ্রেস। সেই দিনক্ষণের একটু হেরফের হল বটে। তবে নির্বাচনের মধ্যেই দলের দায়িত্ব নিলেন রাহুল গান্ধী। পরিবারের ষষ্ঠতম ব্যক্তি রাহুল যিনি এই পদের দায়িত্ব সামলাবেন। গত ১৯ বছর ধরে দলের এই পদের দায়িত্ব সামলেছেন তার মা সোনিয়া গান্ধী। কতটা দক্ষতা কতটা ব্যর্থতা ছিল তার হিসেব নিকেশ পরের কথা। এবার পরীক্ষা রাহুলের। কংগ্রেসকর্মীদের প্রত্যাশা পূরণে তিনি ভূমিকা পালন করতে পারবেন, সেটা ভবিষ্যতই বলে দেবে। আপাতত রাহুলের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। তার বয়স এখন ৪৭ বছর। তরুণ নেতাদের চেয়ে একটু বেশি। তার বাবা ৪০ বছর বয়সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর একের পর এক রাজ্যে ক্ষমতা হারিয়েছে কংগ্রেস। ৫৪৩ আসনের লোকসভায় এই ১৩২ বছরের দলটির সদস্য এখন মাত্র ৪৪। তাই এখন রাহুলের নেতৃত্বে ভরসা রেখে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে দলটি।

তবে সোনিয়া গান্ধী যতদিন জীবিত থাকবেন, দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন নিঃসন্দেহে। দলের লক্ষ্য ও দিকনির্দেশনাও দেবেন তিনি। মায়ের সর্বাত্মক সহযোগিতা রাহুলকে অনেকটাই ভরসা যোগাবে।

রাহুলের বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা আছে। তার অনেক সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তারপরও তিনিই ভারতের সবচেয়ে পুরনো দলের সমর্থকদের কাছে সবচেয়ে ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছেন। এটা সহজ নয়। রাজ-রাজরাদের রীতি অনুযায়ী মুঘল সম্রাট আকবরকে ডাকা হত ‘জাহাপনা’ বলে। ‘জাহাপনা’ শব্দের অর্থ হলো, ‘বিশ্বের আশ্রয়’। এক সময় নেতাকে তেমনটাই মনে করা হতো। নেতা সেই মানুষটি, যিনি প্রজার আশ্রয়স্থল। তার সমর্থক, তার প্রজা, তার ভোটারকে রক্ষা করেন নেতা। উপমহাদেশের ঐতিহ্য অনুযায়ী নেতা মানে শুধুই ক্ষমতা নয়, নেতা হয়ে ওঠা এক প্রক্রিয়া। ক্ষমতা একটা সাময়িক মাধ্যম। আসলে নেতৃত্ব মানুষের ভালোবাসা থেকে গড়ে ওঠে, ক্ষমতা থেকে নয়। সবাই সত্যিকারের জাহাপনা হয়ে উঠতে পারেন না। কেউ কেউ পারেন, যেমন পেরেছিলেন সম্রাট আকবর।

রাহুল আপাতত দলের জাহাপনা হয়ে উঠেছেন। তবে তিনি এক তা হননি। সংসদ সদস্য হয়েছেন, দলের সাধারণ সম্পাদক থেকে সহ-সভাপতি হয়েছেন, ধাপে ধাপে সেই তরুণই এখন এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেতা হয়ে উঠলেন। দলের ভেতর এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাহুল প্রতিকূলতাকে জয় করে নিজেকে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সোনিয়া যখন দলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখনও তাকে অনেক বিক্ষুব্ধ কার্যকলাপের মুখোমুখি হতে হয়। শারদ পওয়ার থেকে সাংমা-রাজেশ পাইলট ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বেরিয়ে আলাদা দল গড়েছিলেন। অর্জুন সিংহ থেকে নটবর সিংহ— অনুগামী থেকে বিদ্রোহী হয়েছিলেন কায়েমি স্বার্থে ঘা লাগায়। সীতারাম কেসরী পদের জন্য কী না করেছেন! ‘সোনিয়া তার শাশুড়ির সিন্ডিকেট-বিরোধী হিমশীতল প্রতিক্রিয়াহীন পাল্টা রাজনীতির কৌশলে সেই বিক্ষিপ্ত রাজনীতিকে নিশ্চিহ্ন করেছেন। দশ বছরের মনমোহন সিংহের জমানায় শত রকম গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব-অন্তর্কলহ থাকা সত্ত্বেও সোনিয়া কংগ্রেসকে বেঁধে রেখেছিলেন নিপুণ ঐক্যে।’ রাহুল এসবই দেখেছেন, এসব থেকে শিখেছেন। রাহুলের নেতৃত্বেও কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। ‘বৃদ্ধতন্ত্র’ ফোঁস করতে পারেনি, তাদেরও রাহুল সঙ্গে রেখেছেন, বাতিল করেননি। আবার নবীন প্রজন্মের রাজ্যওয়ারি এক নেতৃত্বও গড়ে তুলেছেন।

এ সবই রাহুল করেছেন চুপচাপ। তার পরে, হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো এখন তিনি নেমে পড়েছেন রণসজ্জায়। যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে গেছে। তিনি শুধু কংগ্রেসের নয়, বিরোধী শিবিরেরও প্রধান মুখ। মনমোহন সিংহের শাসনকাল নিয়ে মোদি সমালোচনায় মুখর হলেও রাহুলকে বিদ্ধ করতে পারছেন না। ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণের সুযোগ কিন্তু রাহুলের সামনে অনেক আগেই এসেছিল। মনমোহন বার বার বলা সত্ত্বেও সে দিন রাহুল মন্ত্রীও হননি। ২০১৪ সালের ভোটের আগে নেতৃত্বের আসনে তড়িঘড়ি উপবিষ্ট হননি।

রাহুল অবশ্য গত কয়েক বছর ধরেই কংগ্রেসের নেতৃত্বে রয়েছেন। সোনিয়া গান্ধী নামেই সভানেত্রী। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে তিনি অচল, অসুস্থ। দলটা চালাচ্ছেন সহ–‌সভাপতি রাহুল গান্ধীই। রাহুলের বিরুদ্ধে কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগ, তিনি অভিজ্ঞ নেতাদের গুরুত্ব দেন না। নিজের একটা টিম করে নিয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকের সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। যারা স্মার্ট, কিন্তু দেশটাকে চেনেন না। তারপরও রাহুল কংগ্রেসের জন্য অবিকল্প। কংগ্রেস দলের সুদিন–‌দুর্দিন সবই নেহরু–‌গান্ধী পরিবারের হাত ধরে। যত ব্যর্থতাই আসুক, এখনও ওই পরিবারের দিকেই তাকিয়ে কর্মী–‌সমর্থকরা। মাঝে মাঝে আওয়াজ ওঠে— প্রিয়াঙ্কা লাও!‌ লাও তো বটে, কিন্তু আসে কে!‌ ফুলটাইম রাজনীতিক হতে চান না প্রিয়াঙ্কা। দাদার বিকল্প হতে চান না তো বটেই, তার চেয়েও বড় কথা, নেতৃত্বে আসার মানসিকতা নেই। দিল্লিতে শোনা যায়, মাঝে মাঝে এক ধরনের অবসাদে ডুবে থাকেন তিনি। আর স্বামীরত্ন রবার্ট ভদ্রর দুর্নীতির দাগ মুছে ফেলা অসম্ভব। কোথাও কোথাও লেখা হয়, কংগ্রেসের শেষ তাস প্রিয়াঙ্কা। এখনই ফেলতে চাইছে না কংগ্রেস। কংগ্রেস এই তাস কবে ফেলবে, আদৌ ফেলবে কি-না, সেটা রহস্য হয়ে থাকল!

তবে অনেকের আশা এবার রাহুলের হাত ধরে কংগ্রেসের সুদিন আসবে। কারণ উত্থান ও পতন প্রকৃতির চিরকালীন নিয়ম, একসময়ে মোদির জনপ্রিয়তা কমবে। তখন কংগ্রেসের সুদিন আসবে। ২০১৯ লোকসভা ভোটে একটা সম্ভাবনা আছে। সব বিরোধী দল মানতে বাধ্য, সম্মিলিত বিরোধিতা ছাড়া মোদিকে সরানো যাবে না। মমতা অনেক আসন নিয়ে যাবেন, জোট অটুট থাকলে নীতীশ–‌লালুরাও বিহার থেকে অনেক আসন দেবেন। কংগ্রেস একচ্ছত্র শাসক ছিল বলেই বিরোধী ঐক্য তৈরি হয়েছিল। মোদি তথা বিজেপি’র প্রবল উত্থান সেই সম্ভাবনার পথ খুলে দিতে পারে। উদাহরণ– উত্তরপ্রদেশ। বিজেপি ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েই পরাক্রান্ত রাজা। বিরোধী জোটে মায়াবতী থাকলে, ভোট যোগ হলে, দাঁড়ায় প্রায় ৫০ শতাংশ। সাত দফার নির্বাচন শেষ হওয়ার পর, পরিস্থিতি বুঝে অখিলেশ বলেন, মায়াবতীর সঙ্গে জোট সরকার করতে প্রস্তুত, বিজেপি–‌কে আটকানোর জন্য। দিল্লিতে উপস্থিতি রাখার জন্য মায়াবতীর চাই রাজ্যসভার আসন। ২০১৮ সালে মেয়াদ শেষ হবে, এখন সমাজবাদী পার্টিই পারে তাঁকে রাজ্যসভায় রাখতে। অখিলেশের আপত্তি আছে বলে মনে হচ্ছে না। যদি পাঁচ বছরের মাথায় যাবতীয় প্রতিশ্রুতি ফাঁকা প্রতিপন্ন হওয়ায় মোদির জনপ্রিয়তা কমে, যদি বিজেপি–‌কে রুখতে ব্যাপক বিরোধী ঐক্য ছাড়া উপায় নেই ভেবে জড়ো হয় অধিকাংশ দল, বদল এলেও আসতে পারে। যদি আসে, কংগ্রেস আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। এবং প্রাসঙ্গিকতার অন্য নাম হবে রাহুল গান্ধী।

রাহুলের প্রথম অ্যাসিড টেস্ট হচ্ছে গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে। গুজরাটের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজ প্রদেশের এই নির্বাচনকে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে (লোকসভা) তার জনপ্রিয়তার জন্য ‘অ্যাসিড টেস্ট’ বা নমুনা পরীক্ষা হিসেবে দেখা হচ্ছে। অন্যদিকে, কংগ্রেসের নেতা হিসেবে ওই নির্বাচনে রাহুল গান্ধী তার দলকে কোথায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন- গুজরাট নির্বাচনকে তার-ই অগ্নিপরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

গুজরাটকে মোদির রাজনৈতিক ঘাঁটি বলা হয়। কিন্তু এক সময় কংগ্রেস এ রাজ্যে শক্তিশালী অবস্থানে ছিল। মহাত্মা গান্ধীর জন্মস্থান গুজরাটে রাজনীতির সুবাতাস ফেরাতে বহুদলীয় ঐক্য গঠন করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে রাহুল-সোনিয়া গান্ধীর দল। নির্বাচনের আগে আঞ্চলিক ইস্যুগুলো গুরুত্ব পেলেও শেষ সময়ে ব্যক্তি পর্যায়ে ‘মোদি বনাম রাহুল’ লড়াই প্রধান্য বিস্তার করেছে।

আগামী দিনে কংগ্রেসের ডুবন্ত তরীর হালে কতটা শক্তি জোগাবেন তিনি, সেটা নির্ভর করবে এই যুব নেতার নেতৃত্বের ওপর। 

লেখক: কলামিস্ট

রাহুল গান্ধীর অগ্নিপরীক্ষা!
/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফরিদপুরে দুই শ্রমিক হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে খেলাফত মজলিসের মিছিল
ফরিদপুরে দুই শ্রমিক হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে খেলাফত মজলিসের মিছিল
মশা তাড়ানোর ৫ প্রাকৃতিক উপায়
মশা তাড়ানোর ৫ প্রাকৃতিক উপায়
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ