X
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

যারা নিখোঁজ হয়, যারা ফিরে আসে

আমীন আল রশীদ
২৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১২:০০আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১২:৫৭

আমীন আল রশীদ মুবাশ্বার হাসান অথবা উৎপল দাস––নিখোঁজের পরে যারা ফিরে এসেছেন, তাদের পরিবারে এখন নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন। প্রিয়জন ফিরে এসেছে, তাতেই খুশি। কারা তাদের নিয়ে গিয়েছিল, কেন নিয়েছিল এবং কেনই বা ফিরিয়ে দিলো, সেই প্রশ্নও করতে চায় না পরিবারগুলো। ফিরে আসা মানুষেরাও কথাবার্তায় সতর্ক। সতর্ক অথবা ভীত যাই হোক না কেন, মুবাশ্বারের একটি কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ; তা হলো, যারা তার মতো অপহৃত/ নিখোঁজ/ গুম হয়নি, তাদের পক্ষে এটা কোনোভাবেই আন্দাজ করা সম্ভব নয় যে, বিষয়টা কত ভয়াবহ। তিনি এই ঘটনাকে সাইক্লোনের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
প্রশ্ন হলো এই সাইক্লোন বন্ধ হবে কি না কিংবা এই সাইক্লোনের উৎপত্তি বা কারণ এবং এর জন্য দায়ীরা আদৌ চিহ্নিত হবে কি না? প্রশ্নগুলো এ কারণে যে, নিখোঁজ হওয়ার পরে যারা ফিরে আসেন, গল্পগুলো অনেকটা ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের মতো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তরা গুলি ছুঁড়েছে এবং পাল্টা গুলিতে তিনি বা তারা নিহত হয়েছেন––এই বর্ণনা এখন সবার মুখস্ত। একইভাবে নিখোঁজ বা গুমের পরে ফিরে আসা মানুষেরাও যা বলেন, তার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা কিছুই বলেন না।যেমন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা কিংবা পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক নিখোঁজের পরে ফিরে এলেও এ নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে কোনও কথা বলেননি। বিষয়টি নিয়ে কোনও আইনি পদক্ষেপেও তারা যাননি বা যেতে চাননি।
সাংবাদিক উৎপল ফিরে আসার পরে সাংবাদিকদের বলেছেন, তাকে ধরে নেয়ার পরে জঙ্গলে একটা টিনের ঘরের ভেতরে রাখা হয়েছিল। তার কাছে মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরিবার কোনও মুক্তিপণ না দিলেও অপহরণকারীরা তাকে জীবিত অবস্থায় নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় রাস্তার পাশে ফেলে দিয়েছে। তার মানে এখানে মুক্তিপণ কোনও বিষয় ছিল না। তাছাড়া উৎপল বা তার পরিবারের যে আর্থিক সক্ষমতা, তাতে তাকে টাকার জন্য অপহরণ করার কোনও যুক্তি নেই। পেশাদার অপহরণকারীরা যদি কাউকে টাকার জন্য ধরে নিয়ে যায়, তার আগে তারা তার অর্থনৈতিক সক্ষমতার ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নেয়।

মুবাশ্বারও ফিরে আসার পরে বলেছেন যে, তার কাছে টাকা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু মুবাশ্বার শেষ অবধি কেনো মুক্তিপণ দিয়েছেন, এমন কোনো কথা তিনি বা তার পরিবার গণমাধ্যমকে বলেননি। তার মানে তাকেও ধরে নিয়ে যাওয়ার পেছনে টাকা বা মুক্তিপণ কোনও বিষয় নয়। আর এখানেই রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা। তা হলো, একজন নাগরিক, তিনি হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, হন সাংবাদিক কিংবা ব্যবসায়ী–যখন কেউ তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং কিছুদিন পরে জীবিত ফিরে আসেন, তখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব অপহরণকারীদের খুঁজে বের করা। যদি না পারে তাহলে সেটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। আর যদি রাষ্ট্র কোনোকিছু গোপন করে তাহলে সেটি নাগরিকের মানবাধিকার ক্ষুণ্ন করে। কেননা, প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব।

দুঃখজনক এবং ভয়াবহ ব্যাপার হলো, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা এতটাই ক্ষয়িষ্ণু যে, যখনই কেউ কোথাও নিখোঁজ হয়, প্রথম সন্দেহটি যায় তাদের দিকেই। যে কারণে পরিবারের লোকজন প্রথমেই যান নিকটস্থ থানায়। কিন্তু সেখান থেকে বলা হয়, তাদের (পুলিশ) কাছে কোনও তথ্য নেই। এরপর পরিবার যায় নিকটস্থ র‌্যাব অফিসে। এরপর ডিবি কার্যালয়ে। এভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় লাটিমের মতো ঘুরতে থাকে স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যরা। বিষয়টা নিয়ে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও যে স্বস্তিতে নেই তা টের পাওয়া গেছে সাংবাদিক উৎপল ফিরে আসার পরে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, নিখোঁজ হওয়ার দীর্ঘদিনেও উৎপলকে খুঁজে না পাওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা দুঃখজনক। তিনি এও বলেছেন যে, ফিরে আসা ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনার নেপথ্য কারণ বের করার চেষ্টা করা হবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থায় এতটাই চিড় ধরেছে যে, এখন যদি কেউ ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতেও গুম হন, তারপরও মানুষের একট বড় অংশই সন্দেহ করে যে, তাকে হয়তো কোনও বাহিনীর লোকেরা ধরে নিয়ে গেছে। এই যে ধারণাটি তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো যতক্ষণ না মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পারছে, ততক্ষণ অনেক অপরাধী গোষ্ঠীও এই সুযোগ নেবে। ব্যক্তিগত শত্রুতা বা সত্যিকারার্থেই মুক্তিপণ আদায়ের জন্য অপহরণের ঘটনা ঘটলেও মানুষ ঘুরেফিরে বিশেষ কোনও বাহিনীকেই সন্দেহ করবে।

এই জায়গাটি একদিনে তৈরি হয়নি। এটি হত না যদি ফিরে আসার পরে এ নিয়ে রাষ্ট্র কঠোর উদ্যোগ নিত। যদি মামলা হতো এবং ঘটনার প্রকৃত কারণ বের করা সম্ভব হতো। বরং একজন নিখোঁজ মানুষ ফিরে আসার পরে সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। সুতরাং কাকে প্রকৃত অপরাধীরা ধরে নিয়ে গেছে আর কাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে গেছে, সেটি পরিস্কার করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব।

তবে কিছু ঘটনার রহস্য কখনওই যেন উন্মোচিত হতে চায় না। যেমন দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পরে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের সন্ধান মিললো ভারতে। এখনও তিনি দেশে ফেরেননি। কেন আসছেন না, গ্রেফতার এড়াতে?  সবশেষ কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমানেরও সন্ধান মিলেছে নিখোঁজের চার মাস পরে। পুলিশ বলছে, ২০১৫ সালে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ওপর হামলা মামলায় গ্রেফতার এড়াতে তিনি এতদিন পালিয়ে ছিলেন। অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিখোঁজের মধ্যে কিছু পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। যদিও মারুফ জামান নামে একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত ৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। ঘটনার দিন কয়েকজন লোক তার বাসায় গিয়ে কম্পিউটার নিয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছে এটি নিছক মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা নয়। তাকে কারা নিয়ে গেছে, তাও পরিস্কার নয়।

ধরা যাক, যে লোকগুলো নিখোঁজ বা গুম হয়েছেন, তাদের কেউ কেউ অপরাধে যুক্ত। তাহলে প্রচলিত আইনেই তাকে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব। যদি কোনও ব্যক্তি সরকার বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন, যদি কারো ফেসবুক স্ট্যাটাস বা কর্মকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকার বিব্রত হয়, তাহলে তাকে সতর্ক করা কিংবা তাকে শাস্তি দেয়ার আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। রাষ্ট্রের যেকোনও নাগরিকের বিরুদ্ধেই মামলা হতে পারে এবং তার দল ও মত যাই হোক, তার বিচারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এমনকি তাকে জিজ্ঞাসাবাদেরও আইন রয়েছে। কিন্তু তারপরও কিছু মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসার পরে যে রহস্যের জন্ম হয়, তা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং এভাবেই একটি সমাজে ও রাষ্ট্রে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হতে থাকে।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

/এফএএন/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মহাখালী বাস টার্মিনাল এলাকায় অবৈধ দোকান উচ্ছেদ
মহাখালী বাস টার্মিনাল এলাকায় অবৈধ দোকান উচ্ছেদ
এক ঝড়ে বঙ্গোপসাগরে একসঙ্গে ডুবলো ২০ ট্রলার
এক ঝড়ে বঙ্গোপসাগরে একসঙ্গে ডুবলো ২০ ট্রলার
২৫ মে বিশ্ব ফুটবল দিবস
২৫ মে বিশ্ব ফুটবল দিবস
৪৬৮ কোটি টাকার তেল ও ডাল কিনবে সরকার
৪৬৮ কোটি টাকার তেল ও ডাল কিনবে সরকার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ