X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবারও সুলতান এরদোয়ান

আনিস আলমগীর
০৩ জুলাই ২০১৮, ১৩:৫০আপডেট : ০৩ জুলাই ২০১৮, ১৬:০১

আনিস আলমগীর সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন এনে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তুরস্কে। গত ২৪ জুন নতুন ব্যবস্থার অধীনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব তায়্যিব এরদোয়ান এবারও ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। শাসনতন্ত্র অনুসারে ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বে ভোট পাওয়ার কারণে তাকে দ্বিতীয়বার নির্বাচনের সম্মুখীন হতে হবে না। সংশোধিত শাসনতন্ত্রে প্রেসিডেন্টকে প্রচুর নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। সংশোধিত শাসনতন্ত্রও গণভোটে তুরস্কের সংখ্যারিগষ্ঠ মানুষ মেনে নিয়েছেন।
তুরস্ক ন্যাটো জোটের সদস্য। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলো বলছে, এতো ক্ষমতা এরদোয়ানকে একনায়ক করে তুলবে। এরদোয়ানও মানুষ। সুতরাং তার কাছে মানবীয় দুর্বলতা থাকবে না তা তো হয় না। এক ব্যক্তির হাতে শাসন বিভাগ, পার্লামেন্ট আর বিচার ব্যবস্থার ওপর ছড়ি ঘুরাবার কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে। এমন একক কর্তৃত্ব এক ব্যক্তির হাতে পুঞ্জিভূত হলে সে ব্যক্তি তো একনায়ক হবেই। এটাই তো ইতিহাসের ধারাবাহিকতা।
ওসমানিয়া খেলাফতের সুলতানদেরও এমন একক ক্ষমতা ছিল। সব সুলতান তো সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট হননি। আমাদের মাওলানা ভাসানী বলতেন, ‘সব জমিদার যদি করটিয়ার চান মিঞার মতো হতেন তবে আমি জমিদারি উচ্ছেদ চাইতাম না।’ যুগে যুগে হাজার হাজার জমিদার এসেছেন। কিন্তু করটিয়ার চান মিঞা তো পাওয়া গেলো মাত্র একজন।

আমেরিকার প্রজাতন্ত্রটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন অধিবেশনের পর অধিবেশনে বসে স্বাধীনতার স্থপতিরা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেছিলেন। তাতে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার এমন সুনিপুণ বিন্যাস ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে এযাবৎ কোনও প্রেসিডেন্ট একনায়করূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারেননি। অবশ্য ক্ষমতা গ্রহণের দেড় বছরের মাথায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন। অনেকেই বলছেন, ট্রাম্প শুধু প্রেসিডেন্ট হয়ে সন্তুষ্ট নন, তিনি সম্রাট হতে চান। সিএনএন ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন নামকরণ করেছে ‘ইম্পিরিয়াল প্রেসিডেন্সি’।

মার্কিন শাসনব্যবস্থার দুই প্রধান খুঁটি—হোয়াইট হাউস ও কংগ্রেস উভয়ের ওপর ট্রাম্প পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিচার ব্যবস্থাও তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আনছেন। রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের সাহায্যে তিনি ইতোমধ্যে ফেডারেল আদালতগুলোতে নিজের পছন্দমতো বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে পুরো বিচার ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন।

আমেরিকার শাসনতন্ত্রে কতবার এক ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন তা লেখা ছিল না, এ কারণে জাতির পিতা জর্জ ওয়াশিংটনকে সবাই যখন তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট হতে অনুরোধ করলেন তখন তিনি বললেন, ‘আমি সম্রাট হতে চাই না।’ অথচ প্রকৃত অবস্থা ছিল এমন, তিনি ইচ্ছে করলে ইংল্যান্ডের সম্রাটের মতো আমেরিকার সম্রাট হতে পারতেন। তিনি প্রথম জীবনে ইংল্যান্ডের রাজকীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্নেল ছিলেন। তিনি তার অধীনস্থ   সেনাবাহিনী নিয়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আমেরিকার স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ করেছিলেন। ফ্রান্সের সাহায্য না পাওয়া পর্যন্ত তিনি তার পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে তার সেনাবাহিনীর বেতন প্রদান করতেন। ওয়াশিংটনের চরিত্র ছিল অশেষ গুণের আধার।

বহু বক্তা, কবি, নাট্যকার, উপন্যাসিক ওয়াশিংটনের খ্যাতি বাড়িয়ে তুলতে চেয়েছেন, তার চরিত্র সম্পূর্ণ করে তুলতে চেয়েছেন বহুক্ষেত্রে। হয়তো বহু কিছু বিকৃত হতে পারে কিন্তু তার কৃতজ্ঞ দেশবাসী বিনা দ্বিধায় তাকে দেবতার আসনে বসিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটনের মতো মানুষ তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়াকে ‘সম্রাট হওয়া’ মনে করেছিলেন আর এরদোয়ান তুরস্কের ৪৭ শতাংশ মানুষ তার বিরুদ্ধে থাকার পরও সমগ্র ক্ষমতা একক হাতে পুঞ্জিভূত করার দুঃসাহস দেখালেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক ও জার্মানি ছিল এক পক্ষ, আর ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া ছিল মিত্র পক্ষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর তুরস্কের ওসমানিয়া খেলাফতকে ভাগবাটোয়ারা করে মিত্রশক্তি নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। তখন কামাল আতাতুর্ক ছিলেন আনাতোলিয়ায়। তিনি আনাতোলিয়া থেকে যুদ্ধ আরম্ভ করে ইস্তাম্বুল পর্যন্ত কোনোরকমে মূল তুরস্ককে রক্ষা করেছিলেন। কামাল আতাতুর্ক যখন ওসমানিয়া খেলাফত বিলুপ্ত করে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখন সমগ্র মুসলিম বিশ্ব, বিশেষ করে মিশরীয় ও ভারতীয় মুসলমানেরা কামাল আতাতুর্ককে খলিফা ঘোষণা করে খেলাফত অব্যাহত রাখার আবেদন জানিয়েছিলেন। এমনকি ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে আগা খান ও  স্যার সৈয়দ আমির আলী কামালের সঙ্গে সাক্ষাৎ  করেছিলেন।

কামাল আতাতুর্ক মুসলিম বিশ্বের এ লোভনীয় প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। তখন তুরস্কের মানুষের মাঝে কামাল আতাতুর্ক এত জনপ্রিয় ছিলেন যে তার কথায় লক্ষ লক্ষ লোক প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। তাকে লোকে আতাতুর্ক বলে ডাকতো। আতাতুর্ক মানে পিতা।

এরদোয়ান এতো ক্ষমতা হাতে নিলেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে পরিহার করার জন্য অথচ কামাল আতাতুর্ক যখন সিদ্ধান্ত নিলেন এক জাতির তুরস্ক গড়ে তুলবেন, তখন সামরিক বেসামরিক আমলারা এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের এ বিরোধিতার পেছনে যুক্তিও ছিল। কারণ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপর তুরস্কের অর্থনীতিতে দেউলিয়া অবস্থা বিরাজ করছিল। যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য ওসমানিয়া খেলাফতের সুলতানেরা এমনকি ইহুদি বড় বড় সুদি কারবারিদের থেকেও ঋণ গ্রহণ করেছিলেন। এমন অর্থনৈতিক অবস্থার মাঝেও তিনি শুধু গ্রিস থেকে ৮ লক্ষ তুরস্কের লোককে তুরস্কে এবং আনাতোলিয়া থেকে ১৪ লক্ষ গ্রিককে গ্রিসে পাঠিয়েছিলেন। আমলাতান্ত্রিক বাধা কামালকে আটকাতে পারেনি। জাতির উন্নয়নের জন্য জাতির স্বাধীনতা হরণ করতে হয় না।

এরদোয়ানের বয়স এখন ৬৪ বছর। স্বাবলম্বী মানুষ। পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা ছিল। বাবা ছিলেন কোস্টগার্ডের ক্যাপ্টেন। তবু তিনি লেবুর সরবত আর তিলের রুটি বিক্রি করে ছাত্রজীবনে নিজের খরচ নিজেই উপার্জন করতেন। এখন জাতিকে যখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন তখন জাতিকে স্বাবলম্বী করতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক। স্বাবলম্বিতার আনন্দের মাঝেই তিনি জীবন গঠন করেছেন। জাতিকে স্বাবলম্বী করার জন্যই তিনি একক নেতৃত্ব হাতে নিয়েছেন। একক নেতৃত্ব ছাড়াও তো জাতিকে স্বাবলম্বী করা যায়।

এরদোয়ান ছিলেন নাজিম উদ্দিন আরবাকান-এর ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টির যুব সংগঠনের সদস্য। ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টি ছিল ইসলামিক চিন্তা চেতনায় সমৃদ্ধ দল। ১৯৮০ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর নাজিম উদ্দিন আরবাকানের নতুন দল ওয়েলফেয়ার পার্টিতে যোগদান করেন তিনি। এ দল থেকেই তিনি ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন ১৯৯৪ সালে।

মেয়র হিসেবে তিনি খুবই সফল ছিলেন। ইস্তাম্বুল প্রাচীন নগরী, পূর্বে রোম সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। তখন তার নাম ছিল কনস্টান্টিনোপল। তখন এ শহরের খ্যাতি ছিল বিশ্বব্যাপী।

১৯৯৮ সালে ওয়েলফেয়ার পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে ২০০১ সালে এরদোয়ান নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন জাস্টিজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি। ২০০২ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জাস্টিজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বিজয় লাভ করে। এরদোয়ান তখন কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে এমপি হতে না পারায় প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। ২০০৩ সালে নিষেধাজ্ঞা ওঠে গেলে তিনি এক উপনির্বাচনে জয়লাভ করে প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর তিনি ২০০৭ সালের নির্বাচন ও ২০১১ সালের নির্বাচনেও জিতে ছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনবার প্রধানমন্ত্রী থাকার পর ২০১৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

২০১৮ সালের শাসনতন্ত্র সংশোধন করে সমগ্র নির্বাহী ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে প্রদান করে এবার নির্বাচন করলেন। তিনি এবারও জিতেছেন। পাঁচবার সাধারণ নির্বাচনে, দুইবার গণভোটে এরদোয়ান জয়লাভ করে প্রমাণ করলেন, তিনিই বর্তমান তুরস্কের সবচেয়ে বেশি আস্থাভাজন নেতা। দেশের জনসাধারণ যার প্রতি এত আস্থা স্থাপন করলেন তার জননায়ক থেকে শাসনতান্ত্রিকভাবে একনায়ক হওয়ার সিদ্ধান্ত মনে হয় ঠিক হয়নি।

মধ্য এশিয়ায় তুরস্ককে শক্তিশালী একটা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন এরদোয়ান। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য। ন্যাটো সদস্যদের মধ্যে আমেরিকার পরেই বৃহত্তম সৈন্যবাহিনী রয়েছে তুরস্কের। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে এখন সুসম্পর্ক স্থাপন করেছেন। রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ক্রয় করছেন আবার আমেরিকার কাছ থেকে লকহিড এফ-৩৫ বোমারু বিমানও ক্রয় করেছেন, যার প্রথম চালান তুরস্কে এরই মাঝে পৌঁছেছে। মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর নিরাপত্তার জন্য শক্তিশালী তুরস্ককে প্রয়োজন।

এরদোয়ান ইরানের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক রক্ষা করে চলছেন। এখন এরদোয়ানের উচিত মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ভুল-বুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে ঐক্যবদ্ধ একটা মুসলিম উম্মাহ গঠনের প্রচেষ্টা চালানো এবং সিরিয়ায় শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া। এরদোয়ান ইসলামপন্থি  লোক। কিন্তু গত ৯০ বছরব্যাপী তুরস্ক ছিল সেক্যুলার দেশ। সব বিষয়ে ধীরস্থির পদক্ষেপ দেওয়াই উত্তম হবে।

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তুরস্ক সফরকালে এরদোয়ান সম্পর্কে একটা উত্তম ও যথাযথ মন্তব্য করেছিলেন। ওবামা বলেছিলেন, ‘একজন নেতা কীভাবে  একই সঙ্গে ইসলামিক, গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু হতে পারেন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এরদোয়ান’। এবারের নির্বাচনের পর সব ক্ষমতাই তার হাতে। বলা হয়, Power tends to corrupt; absolute power corrupts absolutely.  এরদোয়ান যেন সে পথে পা না বাড়ান। মুসলিম বিশ্বে এখন সাহসী নেতার খুবই অভাব। আমরা এরদোয়ানকে হারাতে চাই না।

লেখক: সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ