X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংলাপ: বিএনপির উদারতা নাকি পরাজয়?

আমীন আল রশীদ
০২ নভেম্বর ২০১৮, ১৬:৩৭আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০১৮, ২০:২৭

আমীন আল রশীদ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা ৫ বছর বাড়িয়ে হাইকোর্ট যেদিন ১০ বছর করে রায় দেন, সেদিনই বিএনপিসহ চারটি দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাক্ষরিত চিঠি পৌঁছে দেওয়া হয় ঐক্যফ্রন্টের মুরুব্বি ড. কামাল হোসেনের কাছে।
এই ঘটনা চলাকালীনই বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করার জন্য হাইকোর্ট একটি আদেশ দেন নির্বাচন কমিশনকে—যে আদেশ পালন করা হলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের পক্ষে বিএনপির নেতৃত্বে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। এর অব্যবহিত পূর্বে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে টেলিভিশন টকশোতে ‘চরিত্রহীন’ বলার মামলায় গ্রেফতার করা হয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের নেপথ্যে ভূমিকা পালনকারী সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে। অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের আরেক পরামর্শদাতা, প্রবীণ চিকিৎসক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগে মামলা হয়। সুতরাং আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীনরা যে সংলাপ শুরু করেছে, সেই আলোচনায় এই বিষয়গুলোকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। 

তবে বিএনপি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র নির্বাচনের পর থেকে যে সরকারকে ‘অবৈধ’ বলে আসছিলো, সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং সেই দল ও জোটের নেতাদের সাথে সংলাপে বসে রাজনৈতিক উদারতার পরিচয় দিলো নাকি এটি তাদের এক ধরনের রাজনৈতিক পরাজয়—সেই প্রশ্নটি পাঠকের জন্য থাকলো।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টার পরে গণভবনে শুরু হওয়া সংলাপ চলে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। এরপর বেরিয়ে ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভালো আলোচনা হয়েছে’। কিন্তু বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা আলোচনায় সন্তুষ্ট নন। বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগ বা ১৪ দল অথবা প্রধানমন্ত্রীর সাথে সংলাপে বিএনপি সন্তুষ্ট হবে—এমন উদার রাজনীতির জন্য যে আমাদের আরও বহুদিন অপেক্ষা করতে হবে, তা নিয়ে সন্দেহ কম।

এই সংলাপ যে খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না তা বিএনপিই শুধু নয়, দেশের রাজনীতি সচেতন প্রত্যেকটা মানুষেরই জানা। কিন্তু তারপরও সবাই এই সংলাপকে স্বাগত জানিয়েছেন এ কারণে যে, যখন বড় দুটি দলের মধ্যে রেষারেষি ভয়াবহ এবং শীর্ষ নেতাদের মধ্যে মুখ দেখাদেখিও হয় না বললেই চলে, সেরকম বাস্তবতায় সংলাপের উসিলায় যদি তারা একটু চা বিস্কিট খান বা ডিনারে অংশ নেন এবং কিছু কথাবার্তা বলেন—সেটিও এক ধরনের অগ্রগতি। এই প্রক্রিয়াটা চলতে থাকলে দূরত্ব কিছুটা কমবে। তাতে আখেরে দেশ ও রাজনীতিই লাভবান হয়।

সংলাপে বিএনপি এবং তাদের নয়া জোটের অংশগ্রহণকে যারা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পথে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে ভাবতে পছন্দ করেন, তাদের নিশ্চয়ই ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে, দেশের ইতিহাসে এরকম সংলাপের ইতিহাস খুব নতুন নয়। প্রতিটি সংকটের সময়েই এরকম সংলাপ বা আলোচনা হয়েছে। কিন্তু যেকোনও বড় সমস্যার সিদ্ধান্ত শেষতক রাজপথেই হয়েছে এবং তাতে প্রাণ গেছে সাধারণ মানুষের। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের অর্থনীতি; যার বড় উদাহরণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৬ সালের আন্দোলন এবং ২০০৭ সালে এক-এগারো সৃষ্টির আগের সংঘাত-সহিংসতা। আবার সব সময় এসব রক্তক্ষয় যে সমস্যার সমাধান আনে তাও নয়। যেমন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সারা দেশে পেট্রোলবোমার যে ভয়াবহ সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছিল, তাতে নির্বাচন বানচাল তো দূরে থাক, বরং রাজনীতিতে বিএনপি ও তাদের শরিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাঝখান দিয়ে প্রাণ গেছে অনেক নিরীহ মানুষের। পিছিয়ে গেছে দেশ।

সেরকম রূঢ় বাস্তবতায় এবার যে সংলাপের উদ্যোগ নেয়া হলো, তাতে আখেরে রাজনীতির চরিত্র কতটা বদলাবে কিংবা আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ-সুষ্ঠু হওয়ার পথ কতটা মসৃণ করবে, তা এখনই বলা মুশকিল। কারণ, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে সংলাপের দিনেই খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সারা দেশে অনশন কর্মসূচি পালন করে বিএনপি এবং তারা সেখান থেকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে কোনও নির্বাচন হতে দেয়া হবে না।

বাস্তবতা হলো, আগামী নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার মুক্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ। আর যদি তিনি কারাগারেই থাকেন তাহলে কি বিএনপি এবারও নির্বাচন বর্জন করবে নাকি ‍জিয়া পরিবারের কাউকে ছাড়াই নির্বাচনে অংশ নিয়ে রাজনীতিতে একটা নতুন ঘটনার জন্ম দেবে? খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না- এই কথা দলের মাঠ পর্যায়ের নেতারা যতটা আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে বলেন, দলের শীর্ষনেতারাও সেটি বিশ্বাস করে বলেন, নাকি তারা জিয়া পরিবারের বাইরে অর্থাৎ পরিবারতন্ত্রের হাত থেকে বিএনপির আসন্ন মুক্তির জন্য ভেতরে ভেতরে উদ্বেলিত- সেই প্রশ্নটিও পাঠকের জন্য থাকলো।

তবে এই তর্ক ছাপিয়ে আপাতত দেশের মানুষের চোখ সংলাপেই। চায়ের দোকানে, সেলুনে, রাস্তার মোড়ে, গলিতে, যেখানেই কয়েকজনের জটলা, তাদের আলোচনার কেন্দ্রে এই সংলাপ। বলা হয়, বাঙালি বেজায় রাজনীতি সচেতন। দেশের রাজনীতি নিয়ে মানুষের অসন্তুষ্টির অন্ত না থাকাই এর কারণ বলে বিবেচনা করা যায়।

কথা হচ্ছে এই সংলাপে আখেরে কী হবে? প্রথম সংলাপ শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যেসব দাবি জানিয়েছে তার মধ্যে নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সুযোগ দেয়া এবং সভা-সমাবেশ করতে দেয়ার দাবির সাথে প্রধানমন্ত্রী একমত হয়েছেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, সংলাপে এটি একটি বড় অর্জন। যদিও নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে ক্ষমতাসীনরা একমত নয়। তবে ব্যাপক আকারে না হলেও এবার সীমিত আকারে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে।

বিএনপির প্রধান যে দাবি, খালেদা জিয়ার মুক্তি, সেটিকে ওবায়দুল কাদের আদালতের বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন এবং সাদা চোখে দেখলে এটিই ধ্রুব। কিন্তু রাজনীতির মারপ্যাঁচে হিসাব করলে সেটি যে কেবল আদালতের বিষয় নয়, তা দেশের একজন সাধারণ মানুষও বোঝেন। যদিও সংলাপে বিএনপিকে প্রধানমন্ত্রী মনে করিয়ে দিয়েছেন, খালেদা জিয়া যে মামলায় কারাগারে আছেন, তা সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের। এখানে ব্যক্তি শেখ হাসিনা বা দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কোনও দায় বা প্রতিহিংসার বিষয় নেই। কিন্তু তারপরও বিএনপির মূল অভিযোগ, সরকার আদালতকে ব্যবহার করেছে এবং করছে।

নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবির সাথে একমত নয় ক্ষমতাসীনরা। তারা বলছে, বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে এর সুযোগ নেই। কারণ, বিশ্বের উন্নত দেশ এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। কিন্তু এই ইস্যুতে বিতর্কের মূল জায়গাটি পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধের অভাব। ভারতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও সেখানে পরাজিত প্রার্থী বা দল ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে না। সে দেশের নির্বাচন কমিশন এতটাই শক্তিশালী ও স্বাধীন, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, জনগণ নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সবার জন্য সমান সুযোগের কোনও ঘাটতি হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে এযাবৎ হওয়া ১০টি নির্বাচনের একটিও সমালোচনা বা বিতর্কের ঊর্ধে থাকেনি। তুলনামূলক ভালো নির্বাচনগুলোরও সমালোচনা করেছে পরাজিতরা। এসব কারণেই ‍মূলত ১৯৯৬ সালে সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যাতে তুলনামূলক ভালো নির্বাচন হয় এবং সব দল সমান সুযোগ পায়। কারচুপি হলেও যেন সেটি সহনীয় মাত্রায় থাকে এবং যাতে কোনও দলই একতরফা ভোটের মাঠ দখলে নিতে না পারে। অর্থাৎ যাতে একটা ভারসাম্য থাকে। রাজনীতিতে সেই অবস্থার যেহেতু এখনও ন্যূনতম কোনও পরিবর্তন হয়নি, বরং বড় দুই দলের মধ্যে চিন্তা ও মতের পার্থক্য ক্রমবর্ধিষ্ণু, তখন নির্বাচনটি কোন সরকারের অধীনে হচ্ছে, সেটি একটি বড় চিন্তার বিষয় হয়েই থাকছে। ধরে নেয়াই সঙ্গত যে, এই প্রশ্নের কোনও সুরাহা চলমান সংলাপে হবে না।

লেখক : সাংবাদিক

 

/ওএমএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফরিদপুরে দুই শ্রমিক হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে খেলাফত মজলিসের মিছিল
ফরিদপুরে দুই শ্রমিক হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে খেলাফত মজলিসের মিছিল
মশা তাড়ানোর ৫ প্রাকৃতিক উপায়
মশা তাড়ানোর ৫ প্রাকৃতিক উপায়
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ