X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক দল কি ব্যবসায়ীদের আখড়া?

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১৫ নভেম্বর ২০১৮, ১৬:০৪আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০১৮, ১৬:৩৬

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী গত পাঁচ বছর বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন বীজ হিসেবে রয়ে গেছে, ডালপালা মেলে বৃক্ষ হতে পারেনি। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে কিনা, তা নিয়ে দুই সপ্তাহ আগেও সংশয় ছিল  পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। প্রবীণ নেতা ড. কামাল হোসেন বিএনপির অসহায়ত্বে তাদের হাতে ধরে ময়দানে নিয়ে আসলেন, আবার সংলাপে বসিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনে আসারও একটা রাস্তা তৈরি করে দিলেন। এখন সারাদেশে নির্বাচনের ঢেউ সৃষ্টি হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।
দেশ দুই দলীয় ব্যবস্থার দিকে এগিয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় প্রথাটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনাও ছিল আর দ্বি-দলীয় প্রথাটাও বলিষ্ঠ হতো। দেশের রাজনীতিবিদেরা কোনও হিতকর রীতি প্রথাকে পরিচর্যা না করলে তা স্থায়িত্ব লাভ করে না। ব্রিটেনে, আমেরিকায় দ্বি-দলীয় প্রথা গড়ে উঠেছে তাদের নেতাদের, তাদের দেশের মানুষের সচেতন প্রচেষ্টার ফলে।
আমাদের দেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ চালানোর প্রথা চালু হয়েছে ১৯২০ সাল থেকে। প্রথাটাতে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও এখন বিশ্বে দেশ চালানোর যত পদ্ধতি আছে তার মাঝে উত্তম পদ্ধতি হলো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ পরিচালনার এই পদ্ধতি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা অন্তত পাঁচ বছর পরে হলেও জনসাধারণের কাছে এসে তাদের কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা করতে হয়। সুতরাং জনপ্রতিনিধিরা জনস্বার্থকে অবহেলা করার সাহস খুব সহজে করেন না। আমাদের জনগণও এ পদ্ধতিটার সঙ্গে পরিচিত।

কোনও বৃহৎ লক্ষ্যই অনায়াসে লাভ করা যায় না। ক্ষমতা লাভের পথ মসৃণ না দেখলে আমাদের দেশে কথায় কথায় নির্বাচন হতে দেবো না– এই যে হুমকি এটা কিন্তু বাহুবলের কথা। বাহুবল যুক্তির কথা তো নয়ই, গণতন্ত্রের কথাও নয়। নির্বাচনে আমাদের মতো অনুন্নত বিশ্বের দেশে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে থাকে। কিন্তু এখন দেখছি উন্নত বিশ্বেও তা হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নাকি রাশিয়ার হস্তক্ষেপ ছিল। ট্রাম্প নাকি রাশিয়ার পছন্দের প্রার্থী ছিলেন। আর তাকে জেতানোর জন্য তারা নির্বাচনে নাকি হস্তক্ষেপ করেছেন। এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ট্রাম্প নিজেই অভিযোগ করেছেন তাকে অকার্যকর করে ফেলতে রাশিয়া ও চীন মধ্যবর্তী নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে পারে। নির্বাচন হয়ে গেছে, এর ফল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য সুখকর হয়নি। তবে কোনও পক্ষ থেকে হস্তক্ষেপের কোনও অভিযোগ এখনও ওঠেনি।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপের বিষয়টা আমেরিকার সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইন্টিলিজেন্স-এর তদন্তাধীন আছে। কিন্তু এ ঘটনা আমাদের দেশে হলে পরাজিত পক্ষ ট্রাম্পের পদত্যাগের দাবিতে গত দুই বছরে কমপক্ষে দুশো দিন হরতাল করতো আর কয়েক হাজার কোটি টাকার সরকারি-বেসরকারি সম্পদ বিনষ্ট করতো।

গণতন্ত্রের প্রথম চর্চা আরম্ভ হয় গ্রিকের নগর রাষ্ট্রগুলোয়। সেই থেকে এই পর্যন্ত নির্বাচিতরা ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে চেয়েছে। প্রতিপক্ষকে দমানোর চেষ্টাও করেছে। এমনকি ভিন্নমত পোষণকারীকে হত্যাও করেছে। সক্রেটিসকে বিচার করে হেমলক বিষ পানে হত্যা করেছিল যুবকদের বিদ্রোহ করার উসকানি দেওয়ার অভিযোগে। অথচ সক্রেটিস ছিলেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিবেকবান ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি। রোমেও গণতন্ত্র ছিল। সিনেটররা নির্বাচিত হতো। সিনেটরদের অন্তর্কলহে রোমে কখনও সুশাসন বা শৃঙ্খলা ছিল না। কিন্তু রোমসাম্রাজ্য বিস্তারের কাজও কখনও থেমে থাকতো না।

আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবীরা যে সুশাসনের বয়ান দেন, গণতন্ত্রের জৌলুসের যে চমকৎকার রূপ বর্ণনা করেন, তা উন্নত বিশ্বেও নেই। আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবীদের কল্পনার অনুরূপ গণতন্ত্র, সুশাসন অনুপস্থিত থাকা স্বাভাবিক।

যাক। লিখছিলাম একাদশ সংসদ নির্বচানের কথা। নির্বাচন কমিশন ২৩ ডিসেম্বর থেকে ভোটগ্রহণ ৩০ ডিসেম্বর করেছে। ড. কামালরা চান আরও তিন সপ্তাহ পেছাতে। আওয়ামী লীগ বলেছে নির্বাচনের তারিখ আর পেছানোতে তারা রাজি না। আগেও কোনও নির্বাচন কমিশন ছিল না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করতো। এখন এত বড় কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং আগানো পেছানোতো কোনও অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না।

গত ১১ নভেম্বর ২০১৮ কাউকে সরকার গ্রেফতার না করার জন্য, মামলা না দেওয়ার জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। সবাই ভালো আচরণ করলে সরকারও ভালো আচরণ করতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫  জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনের মতো কেউ যদি নির্বাচন বানচালের জন্য পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে ৩১৯ জন সাধারণ মানুষ হত্যা করে, ১৫০টি নির্বাচনি কেন্দ্র জ্বালিয়ে দিয়ে, প্রিসাইডিং অফিসার হত্যা করে পুলিশ হত্যা করে তবে সরকার তো তখন নির্বাক থাকতে পারবে না। ১৪ নভেম্বর বিএনপি কার্যালয়ের সামনে পুলিশ ও বিএনপিকর্মীদের সংঘর্ষে যে তাণ্ডব হয়েছে, সেটি ২০১৪ সালের দিকে তাদের ফিরে যাওয়ার লক্ষণ, সেটি দেশবাসী কামনা করে না। দেশের সাধারণ মানুষ আশা করে দেশের সরকারবিরোধী পক্ষ অনুরূপ কোনও গর্হিত কাজে লিপ্ত হবে না।

দেখলাম আওয়ামী লীগের অফিস লোকে  প্রার্থী আর সমর্থকদের ভিড়ে লোকারণ্য আবার নয়া পল্টনের বিএনপি অফিসেও অনুরূপ অবস্থা। কিছুটা আশ্বস্ত হওয়া গেলে যে নিরুপদ্রুব নির্বাচন হয়তো বা আশা করা যায়। আবার হৃদয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ভয় রয়েছে নির্বাচনে বিএনপি শেষ পর্যন্ত থাকবে কিনা? মাঝপথে নির্বাচন ফেলে চলে যাওয়ার এক বদঅভ্যাসে বিএনপি ভোগে। বিএনপির অনুরূপ আচরণের সংশয় কিন্তু রয়ে গেলো। এমনকি নির্বাচনের দিন কারচুপির অভিযোগ তুলেও তারা চলে যেতে পারে।

অবশ্য গত ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে এবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে দল বিপন্ন হবে সম্ভবত কথাটা খালেদা জিয়া উপলব্ধি করতে পেরেছেন। সুতরাং মনে হয়, এবার তারা নির্বাচন নিয়ে জায় ঝামেলা সৃষ্টি নাও করতে পারে।

এবার মনোনয়ন নিয়ে প্রতিটি জোট ঝামেলা পোহাতে পারে। কারণ জোটে এমন এমন দলও আছে যারা তিনশত সিটে মনোনয়ন দিতে পারে। সুতরাং সমঝোতা করে প্রার্থী দাঁড় করানো কঠিন হবে। প্রার্থীর নমুনা যা দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে যে ‘বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল পোহালে শর্বরী রাজদণ্ডরূপে’। বণিকের শাসন কখনও ভালো শাসন হয় না।

১৯৭৫ সালের পরে দুই সামরিক শাসকের দীর্ঘ ১৫/১৬ বছরের শাসনের সময়ই দেশে রাজনীতি তার ঐতিহ্য গৌরব সবকিছু হারাতে আরম্ভ করে। ধীরে ধীরে রাজনীতি ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যেতে থাকে। আওয়ামী লীগকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সে পথে পা বাড়াতে হয়। অন্যথায় পাল্লায় তাদের সঙ্গে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এখন সব দলে ব্যবসায়ীরাই রাজনীতির নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি। আর রাজনৈতিক কর্মীরা দলে ব্যবসায়ী নেতাদের অনুগ্রহভোগী কামলা। এদের নতুন নাকরণ হয়েছে ‘তৃণমূল’।

এই কারণেই দেশের সর্বত্র দুর্নীতি চেয়ে গেছে। এখন ব্যবসায়ীদের সংস্পর্শে এসে ‘তৃণমূলে’ থাকা রাজনৈতিক কর্মীরাও পয়সামুখী হয়ে গেছে। সর্বত্র এখন পয়সা রোজগারের প্রতিযোগিতা। সম্ভবত কয়দিন পরে রাজনীতিতে ত্যাগী কর্মী পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। রাজনীতি তো মিশনারি কাজে। ত্যাগ না থাকলে রাজনীতি তো নিষ্ফলা হয়ে যাবে। রাজনীতি আর কারও উপকারে আসবে না।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যেভাবে দলীয় মনোনয়ন নিতে ওঠে পড়ে লেগেছে তাতে মনে হয় ছিটে ফোটা যে কয়জন রাজনীতিবিদ এখনও রাজনীতিতে আছে তাদেরও মূল উচ্ছেদ হবে। এটা দেশের জন্য অশনি সংকেত। রাজনৈতিক দলগুলো তিনশ’ আসনের পার্লামেন্টের ১৫১ সংখ্যা নিয়ে মাথা ঘামাবে না সেটা বলি না। কিন্তু তার জন্য যদি ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দিয়ে সংসদকে ব্যবসায়ীদের একটা ক্লাব বানিয়ে ফেলে তাতে রাজনীতি হারিয়ে যাবে। দলগুলোর উচিত প্রকৃত রাজনীতিবিদদের, ত্যাগী ও শিক্ষিত নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া এবং দলের তরফ থেকে প্রচুর অর্থ দিয়ে জিতিয়ে আনা। যতক্ষণ রাজনীতিতে ত্যাগী নিষ্ঠাবান কর্মীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত না হবে ততক্ষণ আর রাজনীতির সত্যিকার সৌন্দর্য্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। হতশ্রী দশা হতে হতে একসময়ে রাজনৈতিক দল সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতকারীদের আখড়ায় পরিণত হবে।

 লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ