X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফের ‘মি টু’ ও স্বপ্নের একুশে টেলিভিশন

আমীন আল রশীদ
০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:৪৩আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:৪৫

আমীন আল রশীদ কিছুদিন বিরতি দিয়ে ফের #মি টু। এবার অভিযোগকারী বাংলাদেশে বেসরকারি টেলিভিশন সাংবাদিকতার পথিকৃৎ একুশের টিভির একজন জুনিয়র নারী রিপোর্টার। তিনি যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন একুশে টেলিভিশনের চিফ রিপোর্টার এস এম সেকেন্দার মিয়ার বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে ফেসবুকে #মি টু দেওয়ার আগে তিনি কর্তৃপক্ষ বরাবরে লিখিত অভিযোগও করেন—যেখানে তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিস্তারিত বর্ণনা দেন। এরইমধ্যে অভিযুক্ত সেকেন্দারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে তোলপাড়। তবে শুধু মূল অভিযুক্ত নয়, তাকে মদদ ও প্রশ্রয়দাতাদেরও বিচারের আওতায় আনার দাবিতে মানববন্ধন করেছেন গণমাধ্যকর্মীরা।
দেশে সম্প্রতি আরও কয়েকটি #মি টু’র ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে গণমাধ্যমকর্মীও আছেন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী একজন নারী দেশে থাকা অবস্থায় দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইংরেজি পত্রিকার একজন সিনিয়র সহকর্মীর দ্বারা যৌন হয়রানির অভিযোগ করলে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে তদন্ত করছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানায়। কিন্তু তারপর কী হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। ফলে একুশে টিভির ওই তরুণীর অভিযোগে এস এম সেকেন্দারের গ্রেফতারের পরে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ওই নারী ফেসবুকে লিখেছেন: ‘গতকাল থেকে আনন্দে ভাসতেছি। গণমাধ্যমের একজন যৌন নিপীড়ককে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে বিচার করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে দেখে। এটা #মি টু আন্দোলনের একটা সফলতা। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো ইটিভি কর্তৃপক্ষ এই নিপীড়ককে শেল্টার দিচ্ছে না। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সকল সংবাদ তারা প্রচার করছে।’

প্রসঙ্গত, এবার ইটিভির যে সাংবাদিককে যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেফতার করা হলো, সেই প্রতিষ্ঠানটি অনেক দিন ধরেই নানারকম সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। মালিকের জেলে যাওয়ার পরে মালিকানা বদল এবং শীর্ষ পদে রদবদলের প্রেক্ষিতে নানারকম অভ্যন্তরীণ সংকটের খবর আর গোপন নেই। এতদিন বিষয়টি গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা জানলেও এখন আমজনতাও জানে। কারণ একুশে টিভি রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে কারওয়ান বাজার মোড়ে অবস্থিত এবং এই ভবনের আশেপাশের দেয়ালে টেলিভিশনের শীর্ষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে নানারকম স্লোগান লেখা পোস্টার সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে। অর্থাৎ বিষয়টি আর ইটিভির চারদেয়ালে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। ওই রাস্তা দিয়ে যারা যাচ্ছেন সবার চোখেই পড়ছে এই পোস্টার। ফলে ঘরের কথা এখন আর ঘরে নেই।

এই সংকটের ভেতরে একুশে টিভির চিফ রিপোর্টারকে যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেফতার ও রিমান্ড প্রতিষ্ঠানকে আরও বেশি সংকটে নিপতিত করবে বলেই আশঙ্কা করা যায়। অথচ একুশে টেলিভিশনই দেশে টেলিভিশন সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। এখন দেশের বলতে গেলে সবগুলো বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল যারা চালাচ্ছেন, শীর্ষ পদে আছেন, তাদের অধিকাংশই একুশে টিভির সাবেক কর্মী। সাংবাদিকরাও যে তারকা হতে পারেন, বাংলাদেশে সেই ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত করেছিল এই একুশে টেলিভিশন। শুরু থেকেই এর সংবাদ ও অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু ও মান তুমুল জনপ্রিয়তা পায় এবং একুশে টিভি মানেই নতুন ও ভিন্ন কিছু—এই ধারণাটি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানটি আজ যে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে, তার জন্য কারা দায়ী, সেটি চিহ্নিত করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রতিষ্ঠানটিকে শুধু গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য নয়, দেশের স্বার্থেও বাঁচানো দরকার। কারণ একুশে টিভি শুধু বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলই নয়, বরং এটি একটি ব্র্যান্ডেরও নাম। দেশে আধুনিক টিভি সংবাদ ও অনুষ্ঠানের পথিকৃতের নাম—যেখানে সাংবাদিকতা করতে পারা একসময় এদেশের তারুণ্যের কাছে একটি স্বপ্নের মতো ছিল। এরকম একটি প্রতিষ্ঠান চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাবে, সেটি কারোরই কাম্য হতে পারে না।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আজ একুশে টেলিভিশন যে খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে, তার পেছনে রয়েছে মূলত রাজনীতি। সাংবাদিকরা যে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে একটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারেন, তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই টেলিভিশন চ্যানেল।

বরাবরই যে কথাটি বলা হয় যে, একজন সাংবাদিকও যেহেতু ভোটার এবং ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ অপছন্দের বিষয় তারও আছে, সুতরাং কোনও একটি রাজনৈতিক দলের প্রতি তার পক্ষপাত বা বিশ্বাস থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন তিনি লিখছেন বা বলছেন, সেখানে কোনোভাবেই তার ওই বিশ্বাসের প্রতিফলন থাকবে না। সেটি যে দলই হোক। দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমাদের দেশের সাংবদিকরাও এই তত্ত্ব ও নিয়ম মেনে আসছিলেন। কিন্তু সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেসক্লাবে রাজনৈতিক বিভাজনের পর থেকে সংগঠনের বাইরে থাকা সাংবাদিকরা ধীরে ধীরে এত বেশি দলীয় আনুগত্য প্রকাশ শুরু করেন যে, এখন আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হয়, সারা দেশের সাংবাদিকতারই বুঝি রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত। এটি অত্যন্ত লজ্জার। পৃথিবীর কোনও সভ্য দেশে দলীয় সমীকরণে সাংবাদিক সংগঠনে নির্বাচন হয় কিংবা সাংবাদিকরা প্রকাশ্যে কোনও দলের সদস্য বা নেতা হন বলে মনে হয় না। সাংবাদিকদের এই দলীয় আনুগত্যের প্রকাশ শুধু তাদের নির্বাচনের মধ্যে নয়, তারা এটি কোনও ধরনের রাখঢাক ছাড়াই টেলিভিশনের টকশো, পত্রিকায় লিখে এবং প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে প্রশ্ন করার মাধ্যমে জাহির করেন। এখন দেশের মানুষ জানে কোন সাংবাদিক কোন পন্থী। এটি তো হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু হয়েছে এবং হচ্ছে। এবং এই প্রবণতা থেকে যদি সাংবাদিক সংগঠনগুলো এবং সাংবাদিকরা বেরিয়ে আসতে না পারেন, তাহলে আরও অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে একুশে টেলিভিশনের পরিণত বরণ করতে হবে—তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

একুশে টেলিভিশনের চলমান সংকট ও অস্থিরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশ। নানা অস্থিরতা, অসঙ্গতি ও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ, সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা শুধু একুশে টেলিভিশনে কর্মরতদের আতঙ্কিত করছে না, বরং পুরো সাংবাদিক সমাজই এতে উদ্বিগ্ন বলে জানানো হয় বিবৃতিতে। অথচ যারা বিবৃতি দিয়েছেন, তারাও বিভাজিত। একজন সাংবাদিকের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য যে বস্তুনিষ্ঠতা ও দলনিরপেক্ষতা—সেটি বিসর্জন দিয়ে কোনও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সংকটে উদ্বেগ প্রকাশ করাটা একধরনের ‘দ্বৈতনীতি বা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’। সুতরাং গণমাধ্যমের সংকট নিয়ে কথা বলার আগে সাংবাদিকদের নিজেদের বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণ বেশি জরুরি বলে মনে হয়।

 

লেখক: সাংবাদিক।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
হামলার ঘটনায় মামলা করায় এবার বোমা হামলা, আহত ১৫
হামলার ঘটনায় মামলা করায় এবার বোমা হামলা, আহত ১৫
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ