X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সম্পাদকের দায়বদ্ধতা ও মাহফুজ আনামের 'ভুল স্বীকার'

বুলবুল হাসান
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৯:০৮আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৯:১২

বুলবুল হাসান ২০০২ সালের গোড়ার দিকের কথা। দেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনামের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। আমি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি। বিতর্ক বিষয়ক একটি প্রকাশনায় তার সাক্ষাৎকার ছাপবো বলে আমি এবং আমার বন্ধুরা ছুটে যাই এক সময়ের তুখোড় বিতার্কিক মাহফুজ আনামের কাছে। অল পাকিস্তান ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপের সাফল্য, ছাত্র-রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপট এবং গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতাসহ সমকালীন নানা বিষয় নিয়ে চলতে থাকে আমাদের আলাপচারিতা।
সাক্ষাৎকার শেষে আমার এক সহকর্মী ডেইলি স্টার নিয়ে তার মুগ্ধতার কথা প্রকাশ করতেই মাহফুজ আনাম কিছুটা গম্ভীর হয়ে যান। আমাদেরকে খানিকটা অবাক করে দিয়ে তিনি বলেন, প্রতিদিনই পত্রিকাটির বিভিন্ন পাতায় অসংখ্য সব ভুল থেকেই যাচ্ছে। এই দায় যেমন সম্পাদক হিসেবে তিনি এড়াতে পারেন না, ঠিক তেমনি ডেইলি স্টার নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের উচ্ছ্বসিত হওয়ারও কোনও কারণ খুঁজে পান না তিনি। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া এক দঙ্গল বাচ্চা ছেলের কাছে মাহফুজ আনাম অকপটে নিজের ভুল স্বীকার করেন, মেতে ওঠেন আত্মসমালোচনায়। আসলে ভুল করতে করতেই তো জীবনের পথে হাঁটে মানুষ। ভুল স্বীকারে তাই কোনও গ্লানি নেই। হয়তো গৌরবও নেই। তবু মাহফুজ আনামের ওই দিনের স্বীকারোক্তিতে আমি মুগ্ধ হই। অমন উদারতা বাংলাদেশের ক'জন সম্পাদক দেখাতে পারেন!
সম্প্রতি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ডিজিএফআইয়ের সরবরাহকৃত ‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির খবর’ যাচাই ছাড়া প্রকাশ করাকে নিজের সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল বলে অভিহিত করেছেন মাহফুজ আনাম। তার অনুসারীদের অনেকেই অবশ্য বলছেন, টেলিভিশনে বিষয়টি ওভাবে স্বীকার না করলেই ভালো করতেন তিনি। কেননা, সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম থেকে শুরু করে পত্র-পত্রিকায় এরই মধ্যে তিনি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এরই মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মাহফুজ আনামের বিচার দাবি করেছেন। যদিও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাকে আদৌ অভিযুক্ত করা যায় কী-না সেটি নিয়েও রয়েছে দ্বিধাবিভক্তি। তবে এটাও ঠিক, প্রধানমন্ত্রী পুত্রের এই প্রতিক্রিয়াকে কেবলমাত্র আইনি কাঠামোয় বিশ্লেষণ করলে চলবে না। ওয়ান ইলেভেনের অনিশ্চয়তায় ঘেরা দিনগুলোতে নিজের মায়ের বিরূদ্ধে 'দুর্নীতির খবর' যাচাই ছাড়াই প্রচার করাকে 'ভুল' হিসেবে মানতে আপত্তি থাকতেই পারে তার; কেননা আপাতদৃষ্টিতে তা চরিত্রহননেরই নামান্তর।
অন্যদিকে সমালোচকদের একটা বড়ো অংশের প্রশ্ন- এতোদিন পরে কেন তিনি ভুল স্বীকার করলেন? তাহলে কী প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের প্রতি সরকারের কট্টর মনোভাবের কারণে বিজ্ঞাপনে সেটির প্রভাব পড়েছে? মাহফুজ আনাম-মতিউর রহমানরা কি গভীর এক সঙ্কটে নিমজ্জিত? যদি তা-ই হয়, তাহলে তো তিনি আবারও চাপের কাছে নতি স্বীকার করলেন! অভিজ্ঞ সাংবাদিক আফসান চৌধুরী এই ‘ভুল স্বীকার’ ইস্যুতে বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত এক কলামে সম্পাদক হিসেবে মাহফুজ আনামের নীতি-নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতার জায়গাটিতে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকেই মনে করেন, রাজনৈতিক ওই ক্রান্তিকালে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহ করা অসমর্থিত সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি সাংবাদিকতা পেশাটিকেই ছোট করেছেন। তবে মাহফুজ আনাম সাংবাদিকতা পেশার কতখানি ক্ষতি করেছেন সে বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছানোর আগে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদকের বিরূদ্ধে সমালোচকদের আক্রমণের ধরন দেখে আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশে মূলত সাধু-সন্ন্যাসীরাই পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা ক'রে থাকেন- যারা সাধারণত ভুল করেন না। আর যদি কখনও মনের ভুলে কোনও সম্পাদক নিজের 'ভুল স্বীকার' করে ফেলেন তাহলে সেটি বিবেচিত হবে ক্ষমার অযোগ্য 'অপরাধ' হিসেবে। কী অদ্ভুত এক সমাজে আমাদের বসবাস!

এক এগারোর রাজনৈতিক সঙ্কটে ডেইলি স্টারসহ বাংলাদেশের অধিকাংশ পত্রিকার সম্পাদকগণ যে মেরুদণ্ডহীনতার পরিচয় দিয়েছেন তা নিন্দনীয়। এই আপোষকামীতা কোনও বিবেচনাতেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু সেই লজ্জার দায় কেবল একা মাহফুজ আনামকেই কেন নিতে হবে? এটিএন নিউজের আলোচিত ওই সাক্ষাৎকারে তিনি তো একরকম স্বীকার করেই নিয়েছেন যে, ওই সময়টাতে 'চাপে পড়ে' তিনি ফরমায়েশি সংবাদ ছাপতে বাধ্য হয়েছেন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে- যখন দেশে গণতন্ত্রের মৃদুমন্দ বাতাস বইতে থাকে, তখন কি কোনও রকমের চাপ ছাড়াই সংবাদ প্রকাশ করে থাকে সংবাদপত্রগুলো? মাহফুজ আনাম না হয় চাপে পড়ে সংবাদ ছাপিয়েছেন, কিন্তু যারা 'লোভে' পড়ে সংবাদ ছাপান; রাজনীতিবিদ, আমলা আর বিদেশি প্রভুদের স্বার্থ সংরক্ষণ করেন তাদের বিষয়ে আমাদের 'মহান' সমালোচকদের কোনও বাণী নেই?

অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ব্রিটেনে ঘটে যাওয়া আলোচিত 'ফোন হ্যাকিং' কেলেঙ্কারির কথা। রাজপরিবারের সদস্যসহ সেলিব্রেটিদের ফোনে আড়ি পেতে সংবাদ সংগ্রহের অভিযোগে লর্ড জাস্টিজ লেভিসনকে চেয়ার করে তৎকালীন নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড পত্রিকার সম্পাদকসহ তার সহকর্মীদের বিরূদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। মিডিয়া মোঘল রুপার্ট মারডকের আশীর্বাদপুষ্ট এবং বৃটিশ সমাজে প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন এডিটর রেবেকা ব্রুকস্ ও পত্রিকাটির ম্যানেজিং এডিটর এন্ডি কুলসনকে এক পর্যায়ে গ্রেফতারও করা হয়। এদিকে হ্যাকিং-এর সাথে যোগসূত্র থাকার প্রমাণ পাওয়ার পর ব্রিটিশ এমপি এবং সিভিল রাইটস্ মুভমেন্ট কর্মীদের প্রবল চাপে ২০১১ সালে বন্ধ হয়ে যায় ১৬৮ বছরের পুরনো পত্রিকা নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড। সংবাদপত্রের ইতিহাসে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। গণমাধ্যম যেন কোনওভাবেই আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেই সুপারিশ নিয়ে ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় দুই হাজার পাতার দীর্ঘ লেভিসন রিপোর্ট। এই রিপোর্টটি কেবল ব্রিটেনের প্রেক্ষাপটেই নয়, পৃথিবীজুড়ে সাংবাদিকতা চর্চায় নীতি-নৈতিকতা ও আইনের পরিধিকে পরিমাপ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কয়েকশ' বছরের বৃটিশ সাংবাদিকতার প্রচলিত রীতিকে বেশ জোরেশোরে ধাক্কা দিয়ে লেভিসন তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, ব্রিটেনের 'প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন' প্রচলিত আইনি কাঠামো কিংবা নৈতিকতার মানদণ্ডে গণমানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। পাশাপাশি সংবাদপত্রের সাথে পুলিশ ও রাজনীতিবিদের সম্পর্কের মাত্রা কেমন হবে সেটিরও এক ধরনের দিক নির্দেশনা তুলে ধরে কমিশন। 

এবার আসা যাক, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। মাহফুজ আনামের 'ভুল স্বীকার' ইস্যুতে বেশ কয়েকটি মর্মান্তিক সত্য আমাদের সামনে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমত: জরুরি অবস্থায় বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের কোনও রক্ষাকবচ নেই। কেননা ওই সময়টাতে 'বিশেষ বাহিনী/সংস্থা' অনেকটা জোর করে 'বিশেষ প্রয়োজনে' গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে থাকে। দ্বিতীয়ত: সেই সময়ের বাস্তবতায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দেশের শীর্ষ রাজনীতিবদগণ 'অসমর্থিত' এবং অনেক ক্ষেত্রে 'অসত্য' সংবাদ পরিবেশনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অথচ তারা দেশের ক্ষমতা কাঠামোর সর্বোচ্চ জায়গাটাতে থাকার পরও আজ অবধি এর কোনও প্রতিকার পাননি। আমার ধারণা, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনী কাঠামো কিংবা প্রেস কাউন্সিল মিডিয়ার আগ্রাসী ভূমিকার বিপরীতে নাগরিকের স্বার্থ সংরক্ষণে সক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে না। আমাদের দেশে নীতিমালা হলো ‘ওয়ার্কিং পেপারের নির্বাক শব্দালঙ্কার’। তৃতীয়ত: রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশ কিংবা প্রতিরক্ষাবাহিনীর সাথে মিডিয়ার সম্পর্কের মাত্রা নির্ণয়ে আমরা একটি মানদণ্ড তৈরি করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছি। যদিও এই সমস্যাটি রাজনৈতিক নয়, একেবারেই সংস্কৃতিগত। মৌলিক দায়বদ্ধতা থেকে সরে এসে সাংবাদিকতা এখন ‘চাপে পড়ে’ কিংবা ‘লোভে পড়ে’ জনবিচ্ছিন্ন ক্ষমতাবানদের স্বার্থ সংরক্ষণের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম। আর এসব কারণেই ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের 'ভুল স্বীকার' কিংবা 'দায় স্বীকারের' রয়েছে এক প্রতীকী তাৎপর্য। এক এগারোর দিনগুলোতে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে প্রতিবেদন প্রকাশ করলে আমরা হয়তো লেভিসন প্রতিবেদনের চেয়েও মহার্ঘ্য কিছু পেয়ে যেতে পারি।

লেখক: সাংবাদিক

E-mail: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ