X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পানি আনতে স্কুল ফুরায়

আসাদুজ্জামান সরদার, সাতক্ষীরা
২২ মার্চ ২০২৪, ১৩:০৪আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৪, ১৬:২০

তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে শিশু আয়েশা। বন্ধুদের কাঁধে যখন স্কুলের ব্যাগ, আয়েশার হাতে তখন পানির কলস। পরিবারের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতে গিয়ে ১০ বছরের আয়েশাকে দুই বছর আগেই বন্ধ করতে হয়েছে স্কুলে যাওয়া। পানি আনতে যাওয়ার এই পথও সহজ নয়। কখনও পাড়ি দিতে হয় দুর্গম মেঠোপথ, কখনও নদী।

আয়েশা একা নয়, সুপেয় পানির সংকটে সাতক্ষীরা উপকূলের এমন হাজারো শিশুকে প্রতিদিনই স্কুল বাদ দিয়ে যেতে হচ্ছে পানির সন্ধানে। ফলে অনেকেই ঝরে পড়ছে প্রাথমিকের পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাতক্ষীরা উপকূলে বেড়েছে লবণাক্ততা। মিষ্টি পানির উৎস নষ্ট হয়ে সুপেয় পানির সংকট দিন দিন আরও তীব্র হচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিশুশিক্ষার ওপর।   

কখনও দুর্গম মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে, কখনও বা নৌকা বেয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয় তাদের। এতে শিশুশিক্ষার্থীরা শিক্ষায় হয়ে পড়ছে অনিয়মিত।

খাবার পানি নিতে লম্বা লাইন

সাতক্ষীরা শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের সাবেক স্কুলশিক্ষার্থী আয়েশা খাতুন বললো, ‘আমি ক্লাস থ্রি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। দুই বছর আগে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। আমার দুটো ছোট ভাই আছে। আম্মু তাদের নিয়ে সব দিক একা সামলাতে পারে না। আমি পানি আনতে পারি বলে আমাকেই আসতে হয়। আম্মু পানি আনতে আসবে কখন, আর রান্না করবে কখন? সেজন্য আমিই পানি নিতে আসি। এসে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পানি নিতে হয়। পানি নিতে এসে অনেক দেরি হয়ে যায়। ১-২টা বেজে যায়। এমন পরিস্থিতির জন্য আমি পড়াশোনা করতে পারিনি।’

দূরদূরান্ত থেকে সংগ্রহ করতে পারলেই পানির চাহিদা মেটে উপকূলের মানুষের। সেটা সম্ভব না হলে বাধ্য হয়ে পান করতে হয় পুকুরের পানিও।

ঝরে পড়া স্কুলশিক্ষার্থী আয়েশার মা রোজিনা বেগম বলেন, ‘সুন্দরবন অঞ্চলে খাবার পানির খুবই সমস্যা। এই অঞ্চলের পানি লোনা। দুই কিলোমিটার দূরে পানি আনতে যেতে হয়। এক থেকে চার কলস পানি আনা লাগে। সংসারের কাজ, রান্নাবান্না ও পরিবারের সদস্যদের খাওয়াতে গেলে পানি আনতে যেতে পারি না। সেজন্য বাধ্য হয়ে মেয়েকে পানি আনতে পাঠাতে হয়। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পানি আনতে গিয়ে মেয়ের স্কুলের সময় চলে যায়। সে কারণে মেয়ের লেখাপড়া হলো না। পড়াশোনা না করলে আমরা বেঁচে থাকতে পারি, কিন্তু পানি না হলে বেঁচে থাকতে পারি না। যার কারণে মেয়েটার লেখাপড়া আজ বন্ধ হয়ে গেছে।’

সুপেয় পানির কিনতে হলে আয়েরও একটি বড় অংশ ব্যয় করতে হবে উপকূলের পরিবারগুলোকে। অনেকেরই নেই সে সামর্থ্য। অন্যদিকে, বিনা মূল্যের পানি সংগ্রহে ব্যয় হয় দিনের বড় একটা সময়। ফলে সন্তানকে স্কুলে না পাঠিয়ে পানি সংগ্রহ করতে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক অভিভাবক।

লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে চলে যায় স্কুলের সময়

সাতক্ষীরা শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের মহসিন আলীর পানির কলে পানি নিতে আসা অভিভাবক সোনিয়া বেগম বলেন, ‘বাচ্চারা পানি নিতে আসলে তাদের স্কুলে যাওয়া হয় না। আমাদের বাচ্চাদের যাতে সঠিক সময়ে স্কুলে পাঠাতে পারি সেজন্য অনেক সময় আমরা পানি নিতে আসি। পানি নিয়ে বাড়ি ফিরে বাচ্চার টিফিন গোছানো এবং পোশাক গুছিয়ে দিতে হয়। সকাল ৯টা থেকে স্কুল হলে পানি নিয়ে বাড়ি ফিরে রান্না করতে করতে সাড়ে ৮টা বেজে যায়। অনেকসময় বাচ্চারা না খেয়ে স্কুলে চলে যায়।’

সাতক্ষীরা উপকূলের কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের হাজিরার তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমে উপস্থিতির হারের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অর্ধেকে নেমে আসে।

বুড়িগোয়ালিনী স্কুলের প্রধান শিক্ষক উম্মে তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমাদের এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে আমাদের পানির সংকট আরও তীব্র হয়। ফলে আমাদের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবারের পানির সংকট মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন জায়গায় পানি আনতে যায়। এ কারণে তাদের স্কুলে আসতে দেরি হলে তখন তারা স্কুল মিস করে। এভাবে তারা স্কুলের প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। বাড়ির কাজের প্রতি সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। সে কারণে দিন দিন ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

বেসরকারি সংস্থা উত্তরণের শ্যামনগর উপজেলার প্রোগ্রাম অফিসার নাজমা আক্তার বলেন, ‘শ্যামনগর উপজেলায় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ৩০ শতাংশ। বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই সব শিশুরা ঝরে যাচ্ছে। এই এলাকার শিশু এবং নারীরা পানি সংগ্রহের ক্ষেত্রে বেশি সময় দেয়। কারণ, এখানকার মানুষেরা সব সময় সুপেয় পানির সংকটে ভোগেন। এই কারণে পিএসএফের পানি নিতে গেলে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। শিশুরা সেখানে গিয়ে সময় নষ্ট হওয়ার কারণে অনেকসময় তাদের স্কুলে যেতে দেরি হয়। এভাবে আস্তে আস্তে দুই দিন, দশ দিন স্কুল মিস করতে করতে ঝরে পড়ে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

শিশুশিক্ষার্থীরা শিক্ষায় হয়ে পড়ছে অনিয়মিত

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজিবুল আলম রাতুল বলেন, ‘সুপেয় পানি বৃদ্ধির জন্য সরকার নানা ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। প্রাকৃতিক স্বাদু পানির যে জলাশয়গুলো ছিল সেগুলো খনন করে ব্যাপ্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে। যেখানে নলকূপের মাধ্যমে স্বাদু পানি পাওয়া যায় সেখানে নলকূপ দেওয়া। এ ছাড়া বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য প্রতিবছর অনেক পরিবারের মাঝে পানির ট্যাংক বিতরণ করা হয়ে থাকে। সুপেয় পানির সংকট কমাতে এলাকাভিত্তিক পুকুর খনন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে বিভিন্ন ধরনের উপবৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা উৎসাহিত হয়।’

/কেএইচটি/
সম্পর্কিত
রাসায়নিক দিয়ে পাকানো ৪০০ কেজি আম জব্দ
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সর্বশেষ খবর
ইলেক্ট্রোলাইট পানীয় কী? কখন খাবেন?
ইলেক্ট্রোলাইট পানীয় কী? কখন খাবেন?
‘উপজেলা নির্বাচনে এমপিদের প্রভাব খাটানোর প্রমাণ পেলে আইনি ব্যবস্থা’
‘উপজেলা নির্বাচনে এমপিদের প্রভাব খাটানোর প্রমাণ পেলে আইনি ব্যবস্থা’
দেবিদ্বারে পানিতে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু
দেবিদ্বারে পানিতে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু
‘গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড’ পাচ্ছে ২৯ প্রতিষ্ঠান
‘গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড’ পাচ্ছে ২৯ প্রতিষ্ঠান
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুন: এখনও অপেক্ষায় স্বজনরা
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুন: এখনও অপেক্ষায় স্বজনরা