X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হালদায় ‘জো’, ডিম ছেড়েছে মা মাছ

আনোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম
২২ এপ্রিল ২০১৭, ২০:১৯আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০১৭, ২১:১৩

হালদা নদীতে ডিম ছেড়েছে রুইসহ কার্প জাতীয় মা মাছ। ছবি: রবিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো

পূর্ণিমা ছিল না, ছিল না অমাবশ্যাও। তারপরেও নানা কারণে চট্টগ্রামের হালদা নদীতে ‘জো’ সৃষ্টি হওয়ায় অনুকূল পরিবেশ পেয়ে চলতি মৌসুমে প্রথমবারের মতো ডিম ছেড়েছে মা মাছ। এতে হালদা তীরের মৎস্যজীবীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উৎসবের আমেজ । শুক্রবার (২১ এপ্রিল) সন্ধ্যা থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত এসব মা মাছ ডিম ছাড়ে।

চট্টগ্রামের হালদা নদীকে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র। এই নদী হচ্ছে রুইসহ বিভিন্ন প্রজাতির কার্প মাছের অবাধ বিচরণ কেন্দ্র। একাধিক খরস্রোতা ঝিরি, ঝরনাসহ ছোট ছোট খালের সঙ্গে সংযুক্ত পাহাড়ি নদী হওয়ায় এবং সাগরের সঙ্গে কর্ণফুলী নদীর মাধ্যমে সংযুক্ত থাকলেও দেশের উজান থেকে নামা অন্য কোনও বড় নদীর সঙ্গে এই নদী মিলিত না থাকায় অকৃত্রিম জিনগত বৈশিষ্ট নিয়ে এখনও এখানে টিকে আছে রুইসহ বিভিন্ন প্রজাতির কার্প জাতীয় মাছ।

হালদায় ডিম ছেড়েছে মা মাছ। চট্টগ্রামের মাছুয়াঘোনা এলাকায় শনিবার চলে সেই ডিম সংগ্রহকারীদের উৎসব। ছবি: রবিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো

হালদা নদীর গবেষক প্রফেসর মো. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এবার ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ১ হাজার ৬৮০ কেজি। সেখান থেকে ২৮ কেজির মতো রেণু পোনা সংগ্রহ করা যাবে।

তিনি বলেন, ‘শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে সামান্য পরিমাণে ডিম ছাড়তে শুরু করে মা মাছ;  রাত ১টার দিক থেকে তা বাড়তে থাকে।’

পোনা সংগ্রাহক, বিশেষজ্ঞ ও মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, এবার চাঁদের তিথিতে মিল না থাকলেও সাগরে ঘনিয়ে ওঠা ঝড়ের কারণে প্রবল বর্ষণ, বজ্রপাতসহ পাহাড়ি ঢল আর জোয়ার-ভাটায় নদীর পানি ঘোলা হওয়াসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক নিয়ামক ঠিক থাকায় বিভিন্ন প্রজাতির মিঠা পানির মা মাছ ডিম ছেড়েছে।

হালদায় সংগ্রহ করা ডিম। ছবি- রবিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো

তারা আরও জানান, সাধারণত বর্ষা মৌসুমের শুরুতে পূর্ণিমা-অমাবস্যা তিথিতে পাহাড়ি ঢলের পানির সঙ্গে বজ্রসহ প্রবল বর্ষণ হলে এবং নদীর পানির তাপমাত্রা অনুকূলে থাকলেই মা মাছ ডিম দেয়।ডিম ছাড়ার এই বিশেষ সময়কে স্থানীয়রা ‘জো’ বলে থাকে।

গবেষকদের বর্ণনা অনুযায়ী, এই জো’র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা হতে হবে, সেই সঙ্গে প্রচণ্ড বজ্রপাতসহ বৃষ্টিপাত হতে হবে; আবার বৃষ্টিপাত শুধু স্থানীয়ভাবে হলে হবে না, তা নদীর উজানেও হতে হবে। এসব শর্তে নদীতে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়। এতে পানি অত্যন্ত ঘোলা ও খরস্রোতা হয়ে ফেনাকারে প্রবাহিত হয়। জো এর সর্বশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, নদীতে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি হওয়া। পূর্ণ জোয়ারের শেষে অথবা পূর্ণ ভাটার শেষে পানি যখন স্থির হয় তখনই কেবল মা মাছ ডিম ছাড়ে। আরও অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, মা মাছেরা ডিম ছাড়ার আগে পরীক্ষামূলকভাবে অল্প পরিমাণ ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ পেলে সব ডিম ছাড়ে, না পেলে ডিম নিজের দেহের মধ্যে নষ্ট করে দেয় মা মাছ। এ কারণে ‘জো’ মা মাছ ও মাছের ডিম সংগ্রাহক উভয়পক্ষের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

হালদায় মাছের ডিম শিকার করছে জেলেরা। ছবি: রবিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো

জানা গেছে, মা মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করার পর ১০৫ নৌকায় ৩০০ থেকে ৪০০ পোনা সংগ্রাহক ডিম সংগ্রহ শুরু করে। হাওলদার কাজটিয়া, কাশেমনগর, মোবারকখাল, আজমিরঘাট, অনকুড়িঘোনা, দক্ষিণ ও পশ্চিম গহিরা, আবুর খিল, খালিফারঘোনা, পশ্চিম বিনাজুড়ি, উড়কিরচর, নাপিতের ঘাট, আমোতা ও মাদারসা পয়েন্ট থেকে এসব ডিম সংগ্রহ করা হয়।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মমিনুল হক বলেন, ‘এপ্রিলে বৃষ্টিপাত শুরু হলে অন্যান্য নদী থেকে এসে মা মাছেরা হালদার কয়েকটি পয়েন্টে ডিম ছেড়ে থাকে। পরিবেশ অনুকূলে থাকলেই স্বাদু পানির এসব দেশীয় প্রজাতির মা মাছ ডিম ছাড়ে।’

হালদায় মাছের ডিম শিকার করছে জেলেরা। ছবি: রবিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো

হালদা বাংলাদেশের পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলার নদী । চট্টগ্রামের  রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার প্রায় ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত হালদা নদী। এ নদী দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ এবং দেশের একমাত্র ও বৃহত্তম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র। উইকিপিডিয়া অনুযায়ী, এটি পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী যেখানে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে এবং নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। হালদার সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যান্য প্রধান নদীর সংযোগ না থাকাতে রুই জাতীয় মাছের ‘জিনগত মজুদ’ সম্পূর্ণ অবিকৃত রয়েছে। হালদা নদী কেবল প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্য নয়, এটি ইউনেস্কোর শর্ত অনুযায়ী, বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যেরও যোগ্যতা রাখে। তবে নানা ধরনের দূষণ এবং নদীর জায়গা দখল, বাঁক ভরাট, অব্যাহতভাবে নদীর পানি উঠিয়ে তীরবর্তী চাবাগানসহ কৃষিকাজে এবং কল কারখানায় ব্যবহার, বর্জ্য নিক্ষেপসহ নানা কারণে নদীটির অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। ২০১০ সালে হালদা নদীর নাজিরহাট অংশ থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার এলাকায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে সরকার। এরপরও প্রতিবছর মাছের ডিম ও রেণুর সংখ্যা কমছে।  

হালদা নদীতে জেলেদের ডিম ধরার উৎসব। ছবি-রবিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম

হালদা নদীর গবেষকদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এই নদী থেকে ২০১৫ সালে সংগ্রহ করা ৬ হাজার ৩৬০ কেজি ডিম থেকে ১১৮ কেজি পোনা, ২০১৪ সালে ৩০ হাজার ৪৮০ কেজি ডিম থেকে ৫০৮ কেজি পোনা, ২০১৩ সালে ১৩ হাজার ৫শ’ কেজি ডিম থেকে ৬২৬ কেজি পোনা, ২০১২ সালে ৩১ হাজার কেজি ডিম থেকে ১৫ হাজার ৬৯ কেজি পোনা, ২০১১ সালে ১৩ হাজার ৪শ’ কেজি ডিম থেকে ৩২৬ কেজি পোনা উৎপন্ন হয় এবং বিভিন্ন হ্যাচারির মাধ্যমে তা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়।

/এমএ/টিএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল কার্যালয়ে ঠিকাদারকে মারধর২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ