১৩ মে ছিল বাংলা ট্রিবিউনের জন্মদিন। নিরন্তর শুভ কামনা এই গণমাধ্যমকে। শুধু সাংবাদিকতাই এখানে একমাত্র কাজ নয়। রয়েছে দর্শন, জীবনবোধ, চিন্তা ও মননের দারুণ এক ক্ষেত্র। বলা যায়, প্রতিদিনের কাজের অনুপ্রেরণা ও আগামী দিনের পথচলার রসদ জোগাড় হয় এখান থেকে। এখানে রয়েছে সহকর্মীর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর আন্তরিকতা। কর্মী ও পাঠকদের অর্জন, আস্থা আর বিশ্বাসের মিশেলেই বাংলা ট্রিবিউন।
স্বাভাবিক দিনের চেয়ে একটু ভিন্ন ছিল ২৪ মার্চ (শুক্রবার) দিনটি। ভোর সাড়ে ৬টার দিকে সিলেট মহানগর পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙে। দ্রুত দক্ষিণ সুরমার শিববাড়িতে চলে আসার তাড়া দেন তিনি। জানান, জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে আতিয়া মহল নামের একটি ভবন ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। সেই থেকে শুরু। টানা ১১১ ঘণ্টা কাজ! সঙ্গে ছিল উত্তেজনা, আতঙ্ক, দ্বিধা, সংশয়। তবে সংবাদের সার্বক্ষণিক প্রবাহ ধরে রাখার চেষ্টা, সহকর্মীদের সহযোগিতা ও তথ্যপ্রবাহের দিক থেকে অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের চেয়ে আমাদের এগিয়ে থাকা সব ক্লান্তি দূর করে দিয়েছে।
জঙ্গিবিরোধী অভিযান কাভার করতে গিয়ে প্রথম দিন রাতে ঘুমাতে হয়েছে পুলিশের পিকআপভ্যানের সিটের ওপর। পরের দিন ঘুমাতে হয়েছে শিববাড়ির পাশের এলাকা জৈনপুরের মসজিদের বরান্দায়। পরে কাছেই পরিচিত একজনের বাসা খুঁজে পেয়ে সেখানে বিশ্রাম নিতাম। তবে সবসময় সঙ্গে ছিল খবর বের করে নিয়ে আসার চিন্তা।
সেই টানা ১১১ ঘণ্টা যেন জঙ্গির সঙ্গে আমাদেরও সম্মুখযুদ্ধ! নিদারুণ উৎকণ্ঠায় কাটল সিলেটবাসীর। সেই সঙ্গে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি-পাঠান-পাড়াবাসীর উদ্বেগ ছিল আরও বেশি। সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের ওই এলাকার ‘আতিয়া মহল’ নামের পাঁচতলা বাড়ির দিকে তাকিয়ে আতঙ্কিত হয়েছেন ছোট-বড় সবাই। এর মধ্যে গ্রেনেড হামলার ঘটনাও ঘটে। আতিয়া মহলের বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে এই হামলায় র্যা বের গোয়েন্দা প্রধানসহ সাতজন নিহত হন। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ ৪৪ জন। পরিস্থিতি আরও সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে।
সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসে সংবাদ সম্মেলনে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’-এর সমাপ্তির ঘোষণা আসে, তখন সবাই খুব বিপর্যস্ত। সংবাদ সম্মেলনে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’কে জাতীয় দুর্যোগে সামরিক- বেসামরিক মেলবন্ধনের অপূর্ব উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ভবনটিতে জঙ্গিরা ছাড়াও যে ২৮টি পরিবার ছিল, তাদের নিরাপদে বের করে আনাটা ছিল অন্যতম কঠিন কাজ। কমান্ডোরা জীবনবাজি রেখে অভিনব কৌশলে বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে কাজটি নিরাপদে শেষ করেন। ২৫ মার্চ ভবন থেকে ৩০ জন পুরুষ, ২৭ জন নারী ও ২১ জন শিশুসহ মোট ৭৮ জনকে নিরাপদে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। আর নিচতলার বাসিন্দাদের উদ্ধার করা ছিল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। টানা তিন দিন বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে অবশেষে ২৭ মার্চ বিকেল ৪টার মধ্যে চার জঙ্গিকে নির্মূল করা হয়। জঙ্গি নির্মূল হলেও ভবনে অনেক বিস্ফোরক থাকায় ২৮ মার্চও অভিযান চলে।
লাশগুলোতে সুইসাইডাল ভেস্ট বাঁধা থাকায় সেগুলো বের করাও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। নিরাপত্তা বিবেচনায় ভবনের ভেতরেই সেসব সুইসাইডাল ভেস্টের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। শুধু ২৮ মার্চ ১০টি বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। সুইসাইডাল ভেস্টের বিস্ফোরণের আগে প্রয়োজনীয় ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করা হয়েছে। সেদিন চরম উদ্বেগ আর ঝুঁকি নিয়ে কাজের মধ্যেই সাংবাদিক হিসেবে আমরা পেয়েছি অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা।
(বাংলা ট্রিবিউনের প্রিন্ট সংখ্যায় প্রকাশিত লেখা। সামান্য পরিবর্তিত)।