X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একদিকে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস, অন্যদিকে পুড়িয়ে মারার হুমকি

আবদুল আজিজ, কক্সবাজার
০৪ অক্টোবর ২০১৭, ০৭:৫০আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০১৭, ০৭:৫০

রাখাইনের শীলখালীতে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার দৃশ্য

বাংলাদেশে আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাসের পরও জ্বলছে রাখাইন রাজ্য। প্রতিদিন ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে রোহিঙ্গারা এখনও পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে।আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গারা বলছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী মাইকিং করে রাখাইনে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে আসার নির্দেশনা দিচ্ছে। একইভাবে প্রতিটি গ্রাম-মহল্লায় তল্লাশি অব্যাহত রেখেছে। যারা নিজের ভিটেমাটির টানে এতদিন রাখাইনের জঙ্গলে লুকিয়ে অবস্থান করছিলেন,তারাও আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে।

গত দুই দিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শন করে দেখা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এখনও বিচ্ছিন্নভাবে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সে দৃশ্য এপার থেকে দেখা গেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, রাখাইনে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া যেন মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও মগদের নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ! এ নিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে বসবাসকারী স্থানীয়রা এবং পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে সবসময় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কাজ করছে। কিন্তু উপায় খুঁজে না পেয়ে এমন ভয়াবহ দৃশ্যগুলো তাদেরও গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে।

প্রতিদিন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আর্তচিৎকার, নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা ও আহত নিহতের কথা শুনতে শুনতে কে কাকে সান্ত্বনা দেবেন তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। এখন অবস্থা এমন যে, নতুন যারা আসছেন তাদের কথা আগে আসা রোহিঙ্গারাও আর শুনতেও চাচ্ছেন না। কারণ, প্রায় একইরকম বীভৎস অভিজ্ঞতা সয়ে এসেছেন তারাও।

বিভিন্ন সূত্রমতে,গত দুই দিনে প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গা টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, হোয়াইক্যং উলুবনিয়া, লম্বাবিল ও উখিয়ার পালংখালীর ধামনখালী, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কিয়াংমং ও নাফপুরা গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা যুবক শাহা আলম ও মোজাফ্ফর আহমদ বলেন,‘উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে একসঙ্গে ৫০ জন নারী ও শিশুসহ তিনি বাংলাদেশে ঢুকেছেন। কারণ, মিয়ানামারের সেনাবাহিনী ও মগরা প্রতিদিন মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে আসার নির্দেশনা দিচ্ছে।যদি এক সপ্তাহের মধ্যে রাখাইনে কাউকে পাওয়া যায়, তাহলে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘোষণাও দেওয়া হচ্ছে সেখানে’।

রাখাইন রাজ্যে সেনা ও মগ (ছবি: সংগৃহীত)

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে নাফ নদী পার হয়ে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয়ের জন্য আসা রোহিঙ্গা বৃদ্ধা ছলেমা খাতুন বলেন, ‘আমার বাড়ি মিয়ানমারের শীলখালী গ্রামে। রাখাইনে সহিংসতার পরও না খেয়ে কোনওভাবে পালিয়ে ছিলাম। এরমধ্যে এক সপ্তাহ আগে স্বামী বদিউল আলম নিখোঁজ হয়ে যায়। কিন্তু গত রবিবার রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও মগরা এসে মাইকিং করে বাংলাদেশে চলে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়। এ কারণে প্রাণের ভয়ে অন্যদের সঙ্গে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছি।’

মঙ্গলবার সকালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বলিবাজার গ্রাম থেকে আসা মোহাম্মদ হোসেন ও ফাতেমা বেগম দম্পতি জানান, কোনওভাবেই রাখাইনে থাকা সম্ভব নয়। নানা সহিংসতার পরও আগে কখনোই বাংলাদেশে আসিনি। এবারও থাকার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সেনাবাহিনীর তৎপরতা ও ভয়াবহ টহলের কারণে চলে আসতে বাধ্য হলাম। প্রতিদিন সেনাবাহিনী ও মগরা গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় এলাকায় তল্লাশি শুরু করে এবং খালি পড়ে থাকা বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে।

একইভাবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ঢেঁকিবনিয়া, তুমব্রু, কুমিরখালী, শীলখাল, কিয়াংমং, বলিবাজার, বুচিডং, নাফপুরাসহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে টেকনাফের লেদা, উনচিপ্রাং, উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। এসব রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষদের অনেকে বলেছেন তাদের দুর্দশার কথা। এক পর্যায়ে এ প্রতিবেদক তাদের জানায় যে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে মিয়ানমার। তবে রোহিঙ্গারা একথা বিশ্বাস করতে চায় না। এটি মিয়ানমারের মিথ্যাচার ও রাজনৈতিক কৌশল বলে মন্তব্য করেন তারা।

এদিকে, টেকনাফ উপজেলার উনচিপ্রাং সীমান্তে বসবাসকারী স্থানীয় সিনিয়র সাংবাদিক তাহের নঈম জানান, ‘আজ  সকাল ১০টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত মিয়ানমারের রাখাইনের কুমিরখালী ও শীলখালী এলাকায় একের পর এক গ্রাম জ্বলতে দেখা গেছে। এই দৃশ্য স্থানীয়দের পাশাপাশি বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও দেখেছেন।’ এসময় মিয়ানমারের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে দেখা গেছে বলেও জানান তিনি।

টেকনাফের হোয়াক্যং উলুবনিয়া সীমান্তের স্থানীয় বাসিন্দা বৃদ্ধ নুর আহমদ জানান, ‘মিয়ানমার সরকার কোন সময় কী বলে তার কোনও ঠিক নেই। তারা কোনও বিষয়ে চাপে পড়লে হঠাৎ মিথ্যার আশ্রয় নেয়। কারণ মিয়ানমার একদিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলছে, অন্যদিকে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। এতে অবশ্য আমি অবাক হইনি। এটি তাদের নীতি।’ তাই কুটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার করে মিয়ানমারকে চাপে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

উল্লেখ্য, সোমবার বেলা ১১টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর দফতরের মন্ত্রী উ টিন্ট সোয়ে। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছে মিয়ানমার। একই সঙ্গে দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। এ কারণে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারকে একটি চুক্তির খসড়া দিয়েছে বাংলাদেশ।

 

এএইচ/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা