X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৪৬ বছরেও স্বীকৃতি মেলেনি কুড়িগ্রামের প্রথম শহীদদের

আরিফুল ইসলাম, কুড়িগ্রাম
১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ২৩:০০আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ২৩:০৩

চার শহীদের কবর (ছবি- প্রতিনিধি)

একাত্তরের ৭ এপ্রিল কুড়িগ্রাম শহরে সম্পূর্ণ বিনা বাঁধায় প্রবেশ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ওই দিনই তারা শহরের বর্তমান সার্কিট হাউজের সামনে এসে তৎকালীন উপ-কারাগারে অতর্কিতভাবে হানা দেয় এবং ডেকে নিয়ে উপ-কারাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ পাঁচ জন কারারক্ষীকে ব্রাশ-ফায়ার করে। এতে এক কারারক্ষী ছাড়া পাঁচ জনই শহীদ হন। স্বাধীনতা লাভের ৪৬ বছর পরও কুড়িগ্রামের মাটিতে প্রথম শহীদ হওয়া এই পাঁচ জনের স্বীকৃতি মেলেনি। শুধু তাই নয়; রাষ্ট্রীয়ভাবে আজও এই পাঁচ শহীদের সমাধিস্থলও সংরক্ষণের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি জেলার কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা চরম অভিমান নিয়ে এ প্রতিবেদককে কথাগুলো জানান।

সরেজমিনে দেখা যায়, জেলা কারাগারের প্রবেশপথের দক্ষিণে কারা প্রাচীর সংলগ্ন আবাদি জমির মধ্যে সামান্য উঁচু একটি জায়গা রয়েছে। এটাই কুড়িগ্রামের প্রথম শহীদদের সমাধিস্থল। শহীদের নাম সম্বলিত একটা ফলকও রয়েছে এখানে।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ৭ এপ্রিল লালমনিরহাট এবং রংপুর থেকে সাঁজোয়া বহর নিয়ে গুলি করতে করতে কুড়িগ্রামের দিকে আসতে থাকে পাকিস্তানি হানাদাররা। ওই দিন বিকাল প্রায় ৫টার দিকে তারা কুড়িগ্রাম শহরে প্রবেশ করে। এরপর উপ-কারাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ হেদায়েত উল্লাহ এবং কারারক্ষী লাল মোহাম্মদ প্রামাণিক, আনসার আলী আকন্দ, সাজ্জাদ হোসেন, ফকর উদ্দিন ও আব্দুল জলিলকে ডেকে নিয়ে সার্কিট হাউসের সামনের রাস্তার পূর্ব প্রান্তের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ-ফায়ার করে। এতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন লাল মোহাম্মদ প্রামাণিক, আনসার আলী আকন্দ, সাজ্জাদ হোসেন ও ফকর উদ্দিন। উরুতে গুলি লেগে গুরুতরভাবে আহত হন শেখ হেদায়েত উল্লাহ ও আব্দুল জলিল। পাকিস্তানি বাহিনী চলে গেলে ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাদৎ হোসেন ও মাহফুজার রহমান চৌধুরী আহত শেখ হেদায়েত উল্লাহ ও আব্দুল জলিলকে উদ্ধার করেন। কিন্তু ওইদিন রাত ১১টার দিকে হেদায়েত উল্লাহ মারা যান।

মুক্তিযোদ্ধারা আরও জানান, ওই দিন রাতে স্থানীয় বাসিন্দা ও মুক্তিযোদ্ধা হারুনুর রশিদ লাল, মতিউল ইসলাম চৌধুরী নয়া এবং রজব আলী চার শহীদ কারারক্ষীর লাশ উদ্ধার করেন। পরের দিন সকাল ১০টা-১২টার মধ্যে বর্তমান জেলা কারাগারের প্রবেশপথের দক্ষিণে কারা প্রাচীর সংলগ্ন আবাদি জমির মধ্যে একটি বড় গর্ত করে ইউনিফর্ম পরা অবস্থাতেই চার শহীদকে সমাহিত করা হয়। পরে কারাগারের পশ্চিম প্রান্তে সাবেক পৌর চেয়ারম্যান আব্দুস ছালামের বাড়ির উঠানে সমাহিত করা হয় শেখ হেদায়েত উল্লাহকে।

কুড়িগ্রাম কারা সূত্রে জানা গেছে, সেদিন বেঁচে যাওয়া আব্দুল জলিল এখনও জীবিত আছেন এবং বগুড়ায় অবসর জীবন যাপন করছেন। তবেও তিনি আজও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি।

মুক্তিযোদ্ধা ও সলিডারিটি কুড়িগ্রামের নির্বাহী হারুনুর রশিদ লাল বলেন, ‘একাত্তরের ৩১ মার্চ কুড়িগ্রাম শহরের পুলিশ, আনসার, ছাত্র-জনতা এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সদস্যদের নিয়ে যে সম্মিলিত বাহিনী গড়ে তোলা হয়, তাতে শেখ হেদায়েত উল্লাহসহ শহীদ কারারক্ষীরাও ছিলেন। তারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। ইচ্ছে করলে তারা পালিয়ে গিয়ে জীবন বাঁচাতে পারতেন। সরকারের উচিত, তাদের (শেখ হেদায়েত উল্লাহসহ চার কারারক্ষী) শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া।’

হারুনুর রশিদ লাল আরও বলেন, ‘আমার চোখের সামনে কাররক্ষীদের শহীদ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সেদিন আমাদের হাতের কাছে অস্ত্র ছিল না। আমাদের অস্ত্র সে সময় একটু দূরে রাখা ছিল। তা না হলে আমরা তৎক্ষণাৎ প্রতিরোধ গড়ে তুলতাম। কিন্তু আকস্মিক এ ঘটনায় আমরা হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। পরে এই সহযোদ্ধাদের দাফনের ব্যবস্থা করি।’

শহীদের স্বীকৃতি ও সমাধিস্থলের সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এটা দুঃখজনক। তবে শেষ পর্যন্ত শহীদদের যে তথ্য জেলা কারাগারের পক্ষ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে, তার জন্য বর্তমান জেল সুপার এবং জেলারকে ধন্যবাদ জানাই।’

জেলা কারাগার সূত্র জানায়, প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী কারাগারে আটক স্বজনদের দেখতে আসেন। অনেকে কারাগারের প্রবেশপথের ধারে গাছের ছায়ায় সময়ও কাটান। কিন্তু এর সামান্য দূরে থাকা সমাধিস্থল কারও মনোযোগ আকর্ষণ করে না। ঘাস আচ্ছাদিত হয়ে থাকা শহীদদের কবর কারও কৌতূহল জাগায় না। বর্তমান জেল সুপার উমর ফারুক এবং জেলার মো. লুৎফর রহমান যৌথভাবে শহীদ কারারক্ষীদের নিয়ে একটি তথ্যকণিকা তৈরি করলেও তাদের সমাধি সংরক্ষণ বা কোনও স্মৃতিফলক আজও নির্মিত হয়নি।

শহীদ কারারক্ষীদের স্বীকৃতির ব্যাপারে জেল সুপার মো. উমর ফারুক বলেন, ‘যতদূর জেনেছি, এ ব্যাপারে শহীদদের পরিবারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘সমাধি সংরক্ষণ ও স্মৃতিফলক নির্মাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। আমি যতদূর জানি, বর্তমানে কারা অধিদফতর থেকে স্থাপত্য অধিদফতরকে একটি নকশা প্রণয়নের অনুরোধ করা হয়েছে।’

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার (ভারপ্রাপ্ত) আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে একটি প্রস্তাব কারা অধিদফতরে পাঠানো হয়েছে। কারা অধিদফতর এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

 

/এমএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিক্রির জন্য সবজি কিনে ফেরার পথে দুই ব্যবসায়ী নিহত
বিক্রির জন্য সবজি কিনে ফেরার পথে দুই ব্যবসায়ী নিহত
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
রাজধানীতে খেলাফত মজলিসের বিক্ষোভ
রাজধানীতে খেলাফত মজলিসের বিক্ষোভ
প্রচণ্ড গরমে দই-ফলের এই ডেজার্ট বানিয়ে খান
প্রচণ্ড গরমে দই-ফলের এই ডেজার্ট বানিয়ে খান
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি