X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যার হাত ধরে পঞ্চগড়ে তাঁত শিল্পের বিকাশ

সাজ্জাদুর রহমান সাজ্জাদ, পঞ্চগড়
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৩:৪১আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৫:৪৩

আব্দুল মজিদের হাত ধরেই পঞ্চগড়ে তাঁত শিল্প বিকশিত হচ্ছে

পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একসময় অনাহারে-অর্ধাহারে সময় কাটাতেন মো. আব্দুল মজিদ। অভাব-অনটনের সংসারে অর্থের অভাবে পঞ্চম শ্রেণির পর আর লেখাপড়া করতে পারেননি তিনি। দু’মুঠো খাবার জোগাতে ছুটতে হয়েছে এখানে ওখানে। এক পর্যায়ে তাঁত শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরুন মজিদ। দেশের বিভিন্ন তাঁত পল্লি ঘুরে প্রশিক্ষণ নিয়ে আবারও গ্রামে ফিরে আসেন তিনি। এরপর শুরু হয় দন বদলের গল্প। পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরদিঘী ইউনিয়নের মোটা সন্নাসী তাঁতিপাড়া গ্রামের ঘটনা এটি।

২০০৬ সালে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে ৫০ হাজার টাকা ধার নিয়ে চার শতক বসত ভিটার এক কোণে টিনের চালার ঘর তুলে মাত্র চারটি তাঁতে গড়ে তোলেন ‘টাচ ফ্যাশন’ নামের তাঁত কারখানা। পাঁচ ভাই এক বোনসহ ছয় জন শ্রমিক দিয়ে শুরু হয় তাঁতে শাড়ি এবং ওড়না বুননের ব্যবসা। প্রথমদিকে নিজের তৈরি শাড়ি ও ওড়না বিক্রির জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় নমুনা সরবরাহ করেন তিনি। নতুন ডিজাইনে বৈচিত্র্যময় তাঁতের শাড়ি ও ওড়না তৈরি করায় তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর দ্রুতই বাড়তে থাকে কারখানার আকার। আব্দুল মজিদের ‘টাচ ফ্যাশন’ কারখানায় এখন তাঁতের সংখ্যা ৪০টি। এছাড়াও আরও ১৬টি তাঁত রয়েছে গ্রামে। গ্রামের সব তাঁত মিলে টাচ ফ্যাশনে দৈনিক ১০০ থেকে ১২০ পিস শাড়ি ও ওড়না তৈরি হয়।

জানা যায়, অভাব অনটনে লেখাপড়া করতে না পারলেও সততা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের ফলে আব্দুল মজিদ আজ একজন সফল তাঁত ব্যবসায়ী। মজিদ শুধু নিজে স্বাবলম্বী হননি, গ্রামের অসহায় বেকার সাধারণ নারী-পুরুষদের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে স্বাবলম্বী করে তুলেছেন তাদের। এখন শতাধিক শ্রমিক কাজ করছেন তার কারখানায়। তার দেখাদেখি এ গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই এখন দুয়েকটা করে তাঁত গড়ে উঠেছে। তাঁতের খট খট শব্দের ছন্দে কর্মব্যস্ততার রেশ ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে।

টাচ ফ্যাশনে কাজ করছেন নারীরা

স্থানীয়রা জানায়, এই তাঁত কারখানায় সিল্কের শাড়ি, মসলিন শাড়ি, কটন চুমকি শাড়ি, এনডি কটন শাড়ি, ওড়না, চুমকি ওড়না, পাঞ্জাবি, ফ্রক, কামিজসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড় তৈরি হয়। নিত্য নতুন ডিজাইন, কারু খচিত, মানসম্পন্ন ও সৌন্দর্যের কারণে মজিদের ‘টাচ ফ্যাশন’-এর তৈরি সুতি ও রেশমি শাড়ি এবং ওড়নার ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। এছাড়া পঞ্চগড়ে গ্যাস না থাকায় আব্দুল মজিদের একটি ডাইয়িং সেকশন রয়েছে শাহজাদপুরে। সেখানেও তার ১৭ জন শ্রমিক কাজ করে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, টাচ ফ্যাশন তাঁত কারখানাটি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে স্থাপন করা হয়েছে। কারখানায় যাতায়াতের জন্য ভালো রাস্তাঘাট নেই। মালামাল পরিবহন এবং ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের যাতায়াতে সমস্যা হয়।

এই তাঁতের মেশিন অপারেটর লাবলী, আছমা, রাবেয়া ও তানজিনা জানান- আব্দুল মজিদ ভাই তাঁত কারখানা স্থাপন করায় এখানে অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখানে কাজ করে যে টাকা পাই তা দিয়ে ভালোভাবে সংসার চলে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েদের চাহিদা পূরণ করতে পারছি, তাদের স্কুলে পড়াতে পারছি।

তাঁত শ্রমিক রশিদুল ইসলাম বলেন, ‘পঞ্চগড় জেলায় এমন তাঁত কারখানা আর কোথাও নাই। আগে ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কাজ করতে হতো। এখন বাড়িতে বসে সপ্তাহে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা আয় করতে পারতেছি। আরও দুয়েকটা কারখানা গড়ে উঠলে এলাকার বেকার ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থান হবে।’

তাঁত শ্রমিক শামিম, বুলবুল ও আমিনুল ইসলাম জানান, আগে ঘরবাড়ি ফেলে রেখে সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে কাজ করতে যেতে হতো। এখন নিজের এলাকায় কাজ করতে পারতেছি। এই কাজের পাশাপাশি সংসারের অন্য কাজও করা যায়। এখানে কারখানা হওয়ায় আমরা অনেক ভালো আছি।

টাচ ফ্যাশনে কাজ করছেন শ্রমিকরা

উৎপাদনের ব্যাপারে তাঁত শ্রমিকরা জানান, দিনে তিন থেকে পাঁচটি শাড়ি তৈরি করা যায়। যত বেশি প্রোডাকশন হয় তত বেশি মজুরি পাই। সপ্তাহে দুই থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরি পাই।

এ ব্যাপারে আব্দুল মজিদ জানান, ‘১৯৭২ সালে নদী ভাঙনের ফলে সিরাজগঞ্জ থেকে এখানে এসে আশ্রয় নেন আমার বাবা। তিনি তাঁত পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেসময় সিরাজগঞ্জ থেকে ১৯টি পরিবার এখানে এসে আশ্রয় নেয়। একারণে এই পাড়াটিকে ১৯ ঘর তাঁতি পাড়া বলা হয়। জন্মের পর থেকেই আমি বাসায় তাঁত দেখেছি। প্রথমদিকে কাজ শুরু করার পর শ্রমিক সংকটে পড়ি। এরপর গ্রামের বেকার যুবকদের ডেকে এনে প্রশিক্ষণ দিয়ে এ কাজ শেখাই। এ পর্যন্ত দুইশ’ বেকার নারী পুরুষকে আমি এ কাজ শিখিয়েছি। যাদের অনেকেই আমার কারখানাসহ দেশের বিভিন্ন তাঁত কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। ’

আব্দুল মজিদ আর ও জানান, ‘প্রথম দিকে পরিবারের সবাই মিলে এই তাঁত কারখানায় কাজ শুরু করি। পরবর্তীতে একজন দু’জনকে হাতে কলমে কাজ শিখিয়ে কারখানায় কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছি। শ্রমিকরা কেউ তাঁতে কাপড় বুনে, কেউ ডিজাইন করেন, কেউ বা মেশিন অপারেট করেন। এছাড়া সুতার চরকিতেও স্থানীয় অনেক মহিলা কর্মরত রয়েছেন। প্যাকেটিং, বিপণন ও তদারকিতেও অনেক শ্রমিক কাজ করেন।’

ব্যবসা শুরুর ব্যাপারে আব্দুল মজিদ জানান, ‘গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্ট, পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশন ও আরডিআরএস নামের তিনটি এনজিও থেকে ছয় লাখ টাকা ঋণ নিয়ে জমি ক্রয় করে পাকা, আধা পাকা ৫-৬টি অবকাঠামো গড়ে তুলে টাচ ফ্যাশনের তাঁত কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। সব মিলে এই কারখানায় প্রায় ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে।’

টাচ ফ্যাশনে কাজ করছেন শ্রমিকরা

ঢাকার ভালো ব্রান্ডের শো-রুমে এসব শাড়ি বিক্রি হয় জানিয়ে আব্দুল মজিদ বলেন, ‘হ্যান্ডমেড বিডি, ললনা, সাশ্রয়ী ফ্যাশন, নন্দনকানন, সাদাকালোসহ ঢাকার বিভিন্ন হ্যান্ডি ক্রাফট শোরুমের অর্ডারের ভিত্তিতে টাচ ফ্যাশনে শাড়ি তৈরি করা হয়। এছাড়া পহেলা বৈশাখ, নববর্ষ, বসন্ত উৎসব, গায়ে হলুদ বা বিয়েসহ বিভিন্ন উপহারের শাড়িও অর্ডারের ভিত্তিতে তৈরি হয়ে থাকে। দেশের সেরা ফ্যাশন হাউস ও প্রতিষ্ঠানের চাহিদার ভিত্তিতে প্রতি সপ্তাহে সাতশ’ থেকে আটশ’ পিস শাড়ি সরবরাহ করা হয়। চাহিদা বাড়লে এ সংখ্যা কোনও কোনও সময় বেড়ে যায়। দেবীগঞ্জ থেকে কুরিয়ারে করে এসব শাড়ি একদিন পরেই ঢাকায় গিয়ে পৌঁছে।’

জানা যায়, ব্যক্তিগত জীবনে এক কন্যা ও পুত্রের পিতা আব্দুল মজিদ। তার স্ত্রী সুরাইয়া বেগম কারখানার উল সেকশন দেখাশোনা করেন। ব্যবসার বিস্তারের জন্য  ঋণ সহায়তার দাবি জানিয়ে মজিদ বলেন, ‘ঋণের জন্য অনেক ব্যাংকেই ধর্ণা দিয়েছি কিন্তু কোনও ব্যাংকই এগিয়ে আসেনি। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পেলে কারখানার কলেবর বৃদ্ধি করার ইচ্ছা আছে। স্টক করে রাখার মতো টাকা না থাকায় ব্যবসায় অতিরিক্ত মুনাফা করতে পারছি না। টাকা থাকলে চাহিদাকৃত শাড়ি আগাম তৈরি করে রাখা সম্ভব হতো। এছাড়া সারা বছরই চাহিদার অতিরিক্ত শাড়ি ও ওড়না তৈরি করে বাজারজাত করা সম্ভব হতো। এতে ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির পাশাপাশি মুনাফাও বেশি হতো।’

এ ব্যাপারে দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আতিক এস বি সাত্তার বলেন, ‘আমি শুনেছি সেখানে একটি তাঁত শিল্প রয়েছে। ৫০-৬০টি তাঁত রয়েছে। উৎপাদন ভালো এবং তার মার্কেট রেসপন্সও আছে। আর্থিক সমস্যার কারণে বেশিদুর এগুতে পারছে না তারা। সেক্ষেত্রে সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ সহযোগিতা পেতে আমরা চেষ্টা করতে পারি।’

 

 

/এএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
নির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
শনিবার জাতীয় পার্টির বর্ধিত সভানির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ