X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পুনর্বাসনের তালিকাভুক্ত ৮২ হাজার পারিবারই পাহাড়ি!

জসিম মজুমদার, খাগড়াছড়ি
১৯ অক্টোবর ২০১৮, ০৭:৫০আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০১৮, ১১:৫৭

পুনর্বাসনের তালিকাভুক্ত ৮২ হাজার পারিবারই পাহাড়ি! পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারত প্রত্যাগত উপজাতি শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসনে গঠিত টাস্কফোর্স ৮২ হাজার পাহাড়ি ভূমিহীন পরিবারকে উদ্বাস্তু হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদের মধ্যে কোনও বাঙালি পরিবার না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিরা। তাদের দাবি— পার্বত্য এলাকায় বহু ভূমিহীন উদ্বাস্তু পরিবার থাকলেও তাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এই তালিকাকে বৈষম্য ও ষড়যন্ত্রমূলক অ্যাখ্যা দিয়ে তা বাতিলের দাবি জানিয়ে যাচ্ছে বাঙালিরা। তবে টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান বলছেন, এই তালিকা চূড়ান্ত নয়, যাচাই-বাছাই হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উদ্বাস্তু বাঙালিদের পুনর্বাসনে সরকারের নতুন ভাবনা রয়েছে।     

বিষয়টি নিয়ে বাঙালি নেতারা বলেন, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) আক্রমণে ১৯৮০-১৯৯৭ সাল পর্যন্ত হাজার হাজার বাঙালি পরিবার উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। কিন্তু এসব পরিবারের ঠাঁই হয়নি এই তালিকায়। তারা বলেন, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তি সংবিধান বিরোধী ও বিতর্কিত। পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০১৭-এর ভূমিকাও একই রকম। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্স। এগুলোর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালি উৎখাতের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কোনও ষড়যন্ত্রই পার্বত্য চট্টগ্রামে সফল হতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দেন তারা।

ইস্যুটি নিয়ে গত ৯ অক্টোবর খাগড়াছড়ি শহরের শাপলা চত্বরে পার্বত্য অধিকার ফোরাম, নারী অধিকার ফোরাম, ছাত্র পরিষদ ও সোনা মিয়া টিলা ভূমি রক্ষা কমিটি নামের চারটি সংগঠন এই তালিকাকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে তা ১২ অক্টোবরের মধ্যে বাতিলের দাবি জানান। ১২ অক্টোবরের মধ্যে তালিকা বাতিল না হওয়ায় গত ১৪, ১৬ অক্টোবর বিক্ষোভ সমাবেশ এবং ১৭ অক্টোবর খাগড়াছড়িস্থ টাস্কফোর্স অফিস প্রাঙ্গণে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা।

পুনর্বাসনের তালিকাভুক্ত ৮২ হাজার পারিবারই পাহাড়ি! পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মো. লোকমান হোসেন বলেন, ‘১৯৮০ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত জেএসএস এর শান্তিবাহিনীর আক্রমণে ৫০ হাজারেরও বেশি বাঙালি পরিবার তাদের বসতবাড়ি ছাড়েন। তারা এখানে শতাধিক গুচ্ছগ্রামে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম শরণার্থীবিষয়ক নবম সভায় পাহাড়িদের বিষয় আলোচনা হলো, বাঙালিদের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হলো না। কমিশন কি শুধু পাহাড়ি পরিবারগুলোর জন্য? পার্বত্য চট্রগ্রামে অর্ধেক বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিষয়ে কি সরকারের কোনও আগ্রহ নেই?’ পার্বত্য চট্রগ্রামে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠী সরকারের এই সিদ্ধান্তে হতাশ উল্লেখ করে তিনি অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান।

টাস্কফোর্স শুধু উপজাতীদের জন্য কাজ করেবে এমন সিদ্ধান্তে কথা শুনে লোকমান হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন,‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ৩টি সার্কেলে বিভক্ত, তিনটি সার্কেলের প্রধানরাই উপজাতী নেতা, আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়েছে, তার নেতৃত্বে আছেন উপজাতী নেতারা। পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজাতী নেতা, তিনটি জেলা পরিষদের নেতৃত্বে উপজাতীরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজাতী নেতারা, স্থানীয় সরকারের ৯০ শতাংশ নেতৃত্বে উপজাতীরা, শরণার্থীবিষয়ক টাস্কফোর্সে উপজাতী নেতা। তাহলে বাঙালিরা যাবে কোথায়?’

পার্বত্য নাগরিক কমিটির সভাপতি আলকাছ আল মামুন বলেন, ‘টাস্কফোর্সের নবম সভায় ৮২ হাজার পাহাড়ি পরিবারকে শুধু অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। বলা হচ্ছে— ১২ হাজার ২২২ পরিবার ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও ২১ হাজার উপজাতী পরিবার ভারত থেকে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তন করেছে। সে হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ১ লাখ ৪ হাজার ২২২ পরিবার পুনর্বাসনের তালিকায় আছে। এখন প্রশ্ন হলো এত উদ্বাস্তু পরিবার আসলো কোথা থেকে?’ তিনি পাহাড়ি ও বাঙালি উদ্বাস্তু পরিবারের তালিকা ঠিক করে সবাইকে পুনর্বাসনের দবি জানান।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারত প্রত্যাগত উপজাতী শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্টফোর্সের পঞ্চম চেয়ারম্যান ও খাগড়াছড়ি আসন হতে নির্বাচিত সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, ‘১৯৯৮ সালের ২৭ জুন তৎকালীন টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান দীপংকর তালুকদারের সভাপতিত্বে তৃতীয় সভায় বাঙালি শরণার্থীদের বিষয়টি আলোচনা হয়। সেই সভায় বিস্তারিত আলোচনা শেষে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের অভ্যন্তরীণ শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত করার অবকাশ নেই মর্মে রেজুলেশন পাশ করা হয়। যে বিষয়টি টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় চেয়ারম্যান দীপংকর তালুকদারের সময় সমাধান হয়ে গেছে, সেই ইস্যু নিয়ে ২০ বছর পরে পঞ্চম চেয়ারম্যানের সময় আবার কেন বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে?’

কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা আরও বলেন, ‘টাস্কফোর্স কাউকে এককভাবে পুনর্বাসন করতে পারবে না। প্রাপ্ত তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের পর সুনির্দিষ্ট করে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সরকার যেরকম পদক্ষেপ নেবে সেভাবেই তা বাস্তবায়ন করা হবে।’

পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক বাঙালি পরিবার উদ্বাস্তু হিসেবে আছে উল্লেখ করে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, ‘ইতোমধ্যে বিভিন্ন ফোরামে বলেছি, চলমান টাস্কফোর্সের মাধ্যমে বাঙালিদের পুনর্বাসন করা না গেলেও তাদের পুনর্বাসনে সরকার নতুন করে ভাবছে। প্রয়োজনে নতুন আইন করে, নতুন টাস্কফোর্স করে অথবা দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাঙালি অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০৪১ সালের ভিশন বাস্তবায়নেও প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিতের রূপরেখা আছে। ফলে আমরা কাউকে বাস্তুহারা বা উদ্বাস্তু হিসেবে রাখবো না। আস্থার সঙ্গে অপেক্ষা করতে হবে।’

গত ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত নবম সভায় কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান, পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির প্রতিনিধি গুনেন্দু বিকাশ চাকমা, শরণার্থীকল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষিত চাকমা বকুল, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী, রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা, জিওসির প্রতিনিধি মেজর রফিকুল ইসলাম, বিশেষ আমন্ত্রণে তিন পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসকরা উপস্থিত ছিলেন।

 

/আইএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বাগেরহাটে কৃষককে পিটিকে হত্যা
বাগেরহাটে কৃষককে পিটিকে হত্যা
একসঙ্গে ৭৩ নেতাকে বহিষ্কার করলো বিএনপি
একসঙ্গে ৭৩ নেতাকে বহিষ্কার করলো বিএনপি
চীনে রুপা জিতে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সুকান্ত ও নয়ন
চীনে রুপা জিতে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সুকান্ত ও নয়ন
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
সর্বাধিক পঠিত
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন