X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পালিয়ে বেড়াচ্ছে প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গারা!

আবদুর রহমান, টেকনাফ
১২ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:৫০আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০১৮, ১৬:০২

পালিয়ে বেড়াচ্ছে প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ-মিয়ানমার ১৫ নভেম্বর দিনক্ষণ ঠিক করেছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের দাবি,তাদের নাগরিকত্ব,নিরাপত্তা ও নিজ জমিতে ফেরার কোনও নিশ্চয়তা না দেওয়ায় মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনও সৃষ্টি হয়নি। এ কারণে প্রত্যাবাসন নিয়ে ভয়ে আছে রোহিঙ্গারা। এদিকে প্রত্যাবাসনের তালিকায় নাম রয়েছে,এমন খবরে কক্সবাজারের টেকনাফের একটি রোহিঙ্গা শিবিরের ৯ জন রোহিঙ্গা ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। শরণার্থী প্রত্যাবাসনের কাজে সম্পৃক্ত বাংলাদেশি বা আন্তর্জাতিক কোনও কর্মকর্তা বা অতিথির আগমনের খবর পেলেই ঘর ছেড়ে আশেপাশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তালিকাভুক্ত আরও অনেক রোহিঙ্গা। স্বেচ্ছায় যাওয়ার কথা থাকলেও তারা এখনও আছেন প্রাণভয়ে। রবিবার বিকালে একাধিক রোহিঙ্গা শিবিরে সরেজমিন পরিদর্শন করে এমন চিত্র দেখা গেছে।
জামতলী রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়ে দেখা গেছে,বেশ কয়েকটি ঘরের দরজা বন্ধ। আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা সবাই অন্যত্র চলে গেছে। কারণ,তাদের নাকি মিয়ানমার ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।
সম্প্রতি,ঢাকায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার তৃতীয় যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গাদের প্রথম দল মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কথা রয়েছে।ওই দলে থাকছে ৪৮৫ পরিবারের ২ হাজার ২৬০ জন সদস্য। এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক। এর কিছু দিন আগে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে ঘুরে একই কথা ব্যক্ত করেছিলেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব উ মিন্ট থু। এছাড়া হিন্দু শরণার্থীদেরও প্রত্যাবাসন সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানানো হয়। কিন্তু প্রত্যাবাসনের কাছাকাছি সময়ে পৌঁছালেও এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে কারা, কীভাবে, কোন ঘাট দিয়ে যাবেন। এ বিষয়ে কারও সু-নির্দিষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ফলে নভেম্বরে মাঝামাঝি সময়ে প্রত্যাবাসন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
তবে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম জানিয়েছেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য স্থল-জলপথের ঘাট দুটিই প্রস্তুত রয়েছে। উভয় দেশের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী স্বেচ্ছায়, নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে কাজ শুরু হয়েছে।’
নভেম্বরের মাঝামাঝি প্রত্যাবাসন শুরু হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি, দেখা যাক।’
এদিকে রোহিঙ্গারা বলছে, নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, নিজ জমিতে ফেরার নিশ্চয়তাসহ ৮ দফা না মানলে তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না। শরণার্থীদের শঙ্কা, মধ্য রাখাইন রাজ্যে যেভাবে ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গাকে এক জায়গায় আটক রাখা হয়েছে, প্রত্যাবাসনের আওতায় ফেরত গেলে তাদেরও সেভাবেই রাখা হবে। রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জের ধরে মধ্য রাখাইন অঞ্চলে ২০১২ সাল থেকে ছয় বছর ধরে তাদের ক্যাম্পে আটক রাখা হয়েছে।
রোহিঙ্গা নেতা আমির হোসেন বলেন, ‘বার্মাকে (মিয়ানমার) বিশ্বাস নাই। ওরা মোনাফেক। তারা আইকাব ক্যাম্পে (২০১২ সালে দাঙ্গায় বাস্তচ্যুত হওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইনে শরণার্থী ক্যাম্প) যারা আছে, তাদের আগে নাগরিকত্ব দিক, তারপর আমরা যাবো। আমরা আবার খুপরিতে ঢুকতে চাই না।’
এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য কক্সবাজারের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও টেকনাফের কেরণতলীর (নয়াপাড়া) ঘাট দুটির কাজ শেষ হয়েছে। ঘুমধুম পয়েন্ট দিয়ে স্থলপথে এবং কেরণতলী পয়েন্ট দিয়ে নাফ নদী হয়ে নৌপথে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠানো হবে। চলতি মাসে (নভেম্বর) মাঝামাঝি নাফ নদী পেরিয়ে টেকনাফের কেরণতলী (নয়াপাড়া) প্রত্যাবাসন ঘাট দিয়ে প্রথম ব্যাচ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টেকনাফ থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পথে নাফ নদীর তীরে প্রধান সড়কে লাগানো কাঁটাতারের ভেতর একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে, কেরণতলী (নয়াপাড়া) প্রত্যাবাসন ঘাট, বাস্তচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের জন্য। ভেতরে ঢুকলে দেখা মিলে টিনের তৈরি আধাপাকা সারি সারি ঘর। প্যারাবন থেকে নদীর দিকে ঝুঁকছে লম্বা কাঠের জেটি, এক লাইনে ১১টি করে তিন লাইনে ৩৩টি সেমি-টিনের থাকার ঘর, চারটি শৌচাগার ও চারটি টয়লেট। এখানে প্রত্যাবাসনকারী রোহিঙ্গাদের রাখা হবে বলে জানা গেছে। তাদের দেখভালের জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের আলাদাভাবে চারটি ঘর রয়েছে। পুরো কাজটি বাস্তাবায়ন করেছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়।
তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে আরও উন্নত পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকা ও এশিয়ার শরণার্থী ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক উপ-সহকারী মন্ত্রী রিসার্ড অলব্রাইট। তিনি রবিবার কক্সবাজারের ঘুমধুম প্রত্যাবাসন ঘাট পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
তিনি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিরাপদ, মর্যাদা ও স্বেচ্ছামূলক হওয়া উচিত বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। রাখাইনে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও বিভিন্ন দাতা সংস্থাকে অবাধে কাজ করার সুযোগ দেওয়া দরকার।’
তবে রোহিঙ্গাদের জোর করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে না বলেও আশ্বাস দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিবের রোহিঙ্গা সংকটবিষয়ক বিশেষ দূত ক্রিস্টিন এস বার্গনার। গত শনিবার (১০ নভেম্বর) সকাল ১১টার দিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন-সংক্রান্ত পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে কক্সবাজার টেকনাফ শালবাগান শরণার্থীর ক্যাম্পের চার নারীসহ ৯ জন রোহিঙ্গা নেতাদের মুখে নির্যাতনের কথা শুনেন জাতিসংঘ মহাসচিবের রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ক বিশেষ দূত ক্রিস্টিন এস বার্গনার।
বৈঠকে থাকা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, নির্যাতিত রোহিঙ্গারা যাতে বিচার পায় সেজন্য জাতিসংঘের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত। এ ছাড়া জোর করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে না বলেও তিনি আশ্বাস দেন।
গত ৩০ অক্টোবর রাজধানী ঢাকায় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) বৈঠকে দুই দেশের কর্মকর্তারা নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রোহিঙ্গাদের প্রথম দলকে পাঠানোর পরিকল্পনা করে। তবে এ নিয়ে আপত্তি রয়েছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর। সর্বশেষ শুক্রবার ৪২টি সংস্থা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশ ছেড়ে মিয়ানমারে যেতে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আতঙ্কবোধ করছে। মিয়ানমারের রাখাইন ও বাংলাদেশের কক্সবাজারে সক্রিয় এই সংস্থাগুলোর দাবি, মিয়ানমারে এখন ফিরে গেলে কী হবে তা ভেবে আতঙ্কিত রোহিঙ্গারা এবং এ ব্যাপারে তথ্য না পেয়ে তারা বিপর্যস্ত।
গত বছরের ২৪ নভেম্বর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি করে। চুক্তিতে দুই মাসের মাথায় প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনও রোহিঙ্গা রাখাইনে ফেরত যেতে পারেনি।
রোহিঙ্গা বিষয়ক অন্য এক কর্মকর্তার সঙ্গে জানা গেছে, প্রত্যাবাসনের তালিকায় যেসব রোহিঙ্গার নাম রয়েছে তারা ভয়ে আছে। সরকারি-বেসরকারি কোনও লোকজনের আনাগোনা দেখলে তারা ঘর বন্ধ করে অন্যত্র চলে যায়। আবার পরিস্থিতি দেখে ফিরে আসে।
টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল মতলব বলেন, ‘রোহিঙ্গারা সবসময় স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পক্ষে রয়েছে। তার জন্য আমরা আমাদের নাগরিক অধিকার, নিশ্চিত নিরাপত্তা ও যাবতীয় ধন-সম্পদ ফিরে পেতে চাই। তাহলে আমরা মিয়ানমারে চলে যাবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শরণার্থী এখন বাংলাদেশে, যা এদেশের মানুষ ও সরকারের জন্য বড় একটি বোঝা। রোহিঙ্গারা এর প্রতিদান কখনও শোধ করতে পারবে না।’

/এআর/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ