১১ দফা দাবিতে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী লাগাতার কর্মবিরতি শুরু করেছে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন। শুক্রবার (২৯ নভেম্বর) মধ্যরাত থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য এই ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে নদীবন্দর ও লঞ্চ টার্মিনালগুলো নৌযান শূন্য দেখা গেছে। দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা। অনেকে ঘাটে এসে ফিরে যাচ্ছেন।
রাজধানীতে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে পন্টুনে কোনও নৌযান দেখা যায়নি। গতকাল শুক্রবার রাতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লঞ্চ ও জাহাজ যাত্রী নামিয়ে দিয়ে মাঝ নদীতে গিয়ে অবস্থান করছে।
প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
বরিশাল
আজ শনিবার (৩০ নভেম্বর) ভোর থেকে বরিশাল নদী বন্দর থেকে কোনও গন্তব্যে ছেড়ে যায়নি স্থানীয় রুটের যাত্রীবাহী কোনও নৌযান। এসব নৌযান পন্টুন থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ কারণে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য নদী বন্দরে এসেও যেতে পারেননি যাত্রীরা। কয়েকদিন আগে বাস ধর্মঘট এবং সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আবার নৌ ধর্মঘটে যাত্রীরা অতিষ্ঠ। দাবি না মানা পর্যন্ত কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের আঞ্চলিক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক একিন আলী জানিয়েছেন, ‘দাবি না মানা পর্যন্ত কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে। নৌপথে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি বন্ধ, নৌশ্রমিকদের খাদ্য ভাতা প্রদান, সরকার ঘোষিত গেজেট মোতাবেক বেতন প্রদান, ভারতগামী শ্রমিকদের ল্যান্ডিং পাস প্রদান, নৌশ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত ও মৃত্যুকালীন ভাতা ১০ লাখ টাকা নির্ধারণসহ ১১দফা দাবিতে এই আন্দোলন শুরু করেছে নৌ শ্রমিকরা।’
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল নদীবন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ ১০ রুটে ৩৩টি লঞ্চ প্রতিদিন যাতায়াত করে। আর রাজধানীর সঙ্গে যাতায়াত করে প্রতিদিন ১৪টি বিলাসবহুল লঞ্চ।
এর আগে ২০১০, ২০১২, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে এই একই দাবিতে কর্মবিরতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন ও আন্দোলন করেছে শ্রমিকরা। আন্দোলনকারীদের ভাষায়, লঞ্চ মালিকরা তাদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিলেও তা পালন না করায় বারবার কর্মবিরতি করতে হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ
বাংলাদেশ জাহাজি শ্রমিক ফেডারেশনের ১৪ দফা ও বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের ১১ দফা দাবি বাস্তবায়নে নারায়ণগঞ্জে ধর্মঘট পালন করছেন নৌযান শ্রমিকরা। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে শুক্রবার দিনগত রাত ১২টা থেকে নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদীবন্দর নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় লঞ্চ টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন সাতটি রুটে ৭০টি যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করে। তবে শনিবার গুটিকয়েক লঞ্চ চলাচল করতে দেখা যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। দীর্ঘসময় ধরে লঞ্চের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে দূরপাল্লার অনেক যাত্রীকে। পাশাপাশি হাতে গোনা দু’একটি বালুবাহী বাল্কহেড চলতে দেখা গেছে। তবে অধিকাংশ বাল্কহেড ও তেলের ট্যাংকারসহ সহশ্রাধিক পণ্যবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
এদিকে, দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শনিবার (৩০ নভেম্বর) সকাল থেকেই কর্মবিরতি দিয়ে নগরীর পাঁচ নম্বর ঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন নৌযান শ্রমিকরা। বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সবুজ সিকদার দাবি করেন, ‘মালিকপক্ষ বারবার আশ্বাস দিয়েও দাবি না মেনে শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। এবার দাবি না মানা পর্যন্ত শ্রমিকরা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবে।’ কোনও আশ্বাসেই শ্রমিকরা পিছপা হবে না বলে হুঁশিয়ারি দেন শ্রমিক নেতারা।
চাঁদপুর
নৌ ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছে চাঁদপুর লঞ্চঘাট। রাত ১২টা থেকে চাঁদপুর থেকে রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, শরীয়তপুরসহ সব রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীসাধারণকে। যাত্রীরা লঞ্চ না পেয়ে অনেকে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বাসে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছেন।
লক্ষ্মীপুর থেকে আসা সাইফুল বলেন, ‘আমি ঢাকায় চিকিৎসার জন্য যাবো। কিন্তু চাঁদপুর লঞ্চঘাটে এসে দেখি লঞ্চ চলাচল বন্ধ। এখন কীভাবে যাবো বুঝতে পারছি না।’ কয়েকজন যাত্রী জানান, ঘাটে এসে দেখি কোনও লঞ্চ নেই। তাই এখন বাসে ঢাকায় যেতে হবে।
ঢাকা-চাঁদপুর রুটে চলাচলকারী বোগদাদীয়া লঞ্চের মালিক প্রতিনিধি বিপ্লব সরকার বলেন, ‘লঞ্চের স্টাফ নেই। যে কারণে চাঁদপুর থেকে কোনও লঞ্চ ছেড়ে যায়নি। তবে সকালে ঢাকা থেকে চাঁদপুরের উদ্দেশে ছেড়ে এসেছে বোগদাদীয়া এবং সোনারতরী লঞ্চ।’
চাঁদপুর বন্দর কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৮টা থেকে লঞ্চ চলাচল একবারে বন্ধ। সুকানী-মাস্টার-ড্রাইভারসহ লঞ্চের কোনও স্টাফ নেই। সবাই পালিয়ে গেছে। মালিক পক্ষ লঞ্চ ছাড়ার উদ্দ্যোগ নিলেও স্টাফ ছাড়া লঞ্চ চলবে কীভাবে।’
খুলনা
নৌযান শ্রমিকদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের কারণে শনিবার সকাল থেকেই খুলনা অঞ্চলের যাত্রীরা দুর্ভোগে পরেছেন। আর বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা করে, আড্ডা দিয়ে অলস সময় পার করছেন নৌযান শ্রমিকরা।
নৌযান শ্রমিক ইউনিয়ন খুলনার সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘নৌযান শ্রমিকরা ১১ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন।’
কয়রা যেতে আগ্রহী আজমল হোসেন বলেন, ‘স্বল্প খরচে যাতায়াতের মাধ্যম নৌপথ। এ কারণে আমি এখনও কয়রায় লঞ্চে যাতায়াত করি। শনিবার সকাল সাড়ে ৬টার লঞ্চ পেতে ৬টার মধ্যে খুলনার লঞ্চ ঘাটে আসি। কিন্তু লঞ্চ শ্রমিকরা জানান লঞ্চ বন্ধ রয়েছে। ফলে পরিবার নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে।’
কয়রা রুটে চলাচল করা লঞ্চের শ্রমিক ইমরান হোসেন জানান, ধর্মঘট চলার কারণে তাদের অলস সময় পার করতে হচ্ছে।
মোংলা
নৌযান শ্রমিকদের কর্মবিরতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে মোংলা বন্দরে। শুক্রবার রাত থেকেই মোংলায় বন্ধ হয়ে গেছে নৌপথে পণ্য পরিবহণের কাজ। কর্মবিরতি শুরু আগ থেকে বন্দরে অবস্থানরত বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজের কাছে যে সব নৌযান ছিল সেগুলোতে শনিবার সকালে স্বল্প পরিসরে পণ্য খালাসের কাজ চলে। কিন্তু দুপুরের পর থেকে তাও বন্ধ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। অন্যান্য জাহাজে পণ্য ওঠানামার কাজ বন্ধ রয়েছে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার কমান্ডার ফখর উদ্দিন বলেন, ‘নৌযান শ্রমিকদের কর্মবিরতির প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। সকালের পালায় জাহাজের পণ্য ওঠানামার কাজ হলেও দুপুরের পর থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন’র (কেন্দ্রীয়) সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম জানান, ১১ দফা দাবিতে শুক্রবার মধ্যরাত থেকে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেছে নৌযান শ্রমিকেরা। দেশের বিভিন্নস্থানে থাকা প্রায় ২০ হাজার নৌযানের (কার্গো, কোস্টার, বাল্কহেড, বার্জ ও লঞ্চ) প্রায় দুই লাখ শ্রমিক-কর্মচারী তাদের কাজকর্ম বন্ধ রেখে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট পালন করবেন বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘১১ দফা দাবির বিষয়ে গত ২৭ নভেম্বর শ্রম মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে কিছু ইতিবাচক প্রস্তাব উঠে আসলেও সামগ্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য সমাধানের রাস্তা তৈরি না হওয়ায় শ্রমিকেরা তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাই কর্মবিরতি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়া মালিকদের অনীহাই শ্রমিকদের বিক্ষুদ্ধ হওয়ার মূল কারণ। অধিকাংশ নৌযান মালিক শ্রম মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে উপস্থিত হন না।’
এর আগে একই দাবিতে গত ২৩ জুলাই মধ্যরাত থেকে কর্মবিরতি পালন শুরু করেন নৌযান শ্রমিকেরা। এরপর দাবি পূরণের আশ্বাসে তারা কর্মবিরতি স্থগিত করেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও সেই সব দাবি বাস্তবায়ন হওয়াতেই ফের কর্মবিরতি শুরু করছেন নৌযান শ্রমিকেরা।
পটুয়াখালী
শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে পটুয়াখালী থেকে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। শুক্রবার রাতে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ডাবল ডেকার লঞ্চগুলো আজ শনিবার সকালে পটুয়াখালী নদীবন্দরে অবস্থান করছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন লঞ্চ যাত্রীরা।
প্রিন্স আওলাদ লঞ্চের মাস্টার মো. ইসরাফিল জানান, ১১ দফা দাবিতে এ ধর্মঘট চলছে। দাবি না মানা পর্যন্ত আজ থেকে অনির্দিষ্টকালের এ ধর্মঘট চলবে।
পটুয়াখালী নদী বন্দরের সহকারী পরিচালক খাজা সাদিকুর রহমান বলেন, ‘সারাদেশের মতো পটুয়াখালীতেও লঞ্চ ধর্মঘট চলছে। গতকাল ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা যুবরাজ-৭, প্রিন্স আওলাদ-৭ ও সত্তারখান-১ লঞ্চ পটুয়াখালী টার্মিনালে অবস্থান করছে।’
আরও পড়ুন- মধ্যরাত থেকে ১১ দফা দাবিতে সারাদেশে নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘট