বাংলা সংগীতের মান উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে সম্মিলিত উদ্যোগ আর দেখা যায় না। এ বিষয়ে যার যেটুকু ভাবনা, তার সবটুকুই যেন ব্যক্তিগত পর্যায়ে থমকে থাকে। তেমনই এক থমথমে পরিবেশে গানের জন্য কিছু ভাবার ও করার প্রয়াস নিয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন।
২৭ এপ্রিল সংগীত সংশ্লিষ্ট প্রায় সব স্তরের শিল্পী-কুশলী ও গবেষকদের ডেকে এক টেবিলে বসানো হয় ঢাকা কেন্দ্রের সভা কক্ষে। হয় সংগীত নিয়ে বিস্তার আলোচনা। উঠে আসে অনেক অভিমত, পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের তাড়না।
‘অংশীজন সভা’ নামের এ আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘বাংলাদেশের সংগীত: ঐতিহ্য ও সমকালীন চর্চা’। এতে অংশ নিয়েছিলেন দেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পীদের পাশাপাশি, সংগীত পরিচালক, গীতিকবি ও সুরকারবৃন্দ। উপস্থিত ছিলেন বিটিভির মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম, সংসদ সদস্য অণিমা মুক্তি গোমেজ, ঢাকা কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার মাহফুজা আক্তারসহ বিটিভির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
উপস্থিত সংগীত ব্যক্তিত্বদের তালিকায় ছিলেন খুরশিদ আলম, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ফরিদা পারভীন, কিরণ চন্দ্র রায়, চন্দনা মজুমদার, শেলু বড়ুয়া, সালমা আকবর, ফকির শাহাবুদ্দিন, মকসুদ জামিল মিন্টু, নাসির আহমেদ, হাসান মতিউর রহমান, আবু বকর সিদ্দিকী, আনিসুর রহমান তনু, ইউসুফ, চম্পা বণিকসহ আরও অনেকে।
আলোচনা অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে কণ্ঠশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার ‘পদ্মশ্রী’ পদক প্রাপ্তিতে ফুল ও ক্রেস্ট প্রদান করে তাকে অভিনন্দন জানানো হয়। অংশীজন সভার শুরুতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলা একাডেমির উপ-পরিচালক ও লোক সংস্কৃতি গবেষক সাইমন জাকারিয়া।
বিটিভির মহাপরিচালক উপস্থিত শিল্পীদের প্রতি আহ্বান জানান এই বলে, ‘আমাদের সংগীতের ভবিষ্যৎ কি ক্ষয়িষ্ণু, এটা কি ক্রমশ ধূসর হতে যাচ্ছে? বর্তমান সময়ে এ প্রশ্নটা অনেক কষ্টদায়ক ভাবে আমাদের মধ্যে কাজ করছে। বাংলাদেশের সংগীতের ঐতিহ্য, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এটাকে ঠিক করার জন্য করণীয় কী? আমরা কেন বাংলা গানের ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলছি, লোকজ গান কেন হারিয়ে যাচ্ছে? এখানে শিল্পী, রাষ্ট্র ও বিটিভির কী করণীয়? এ ব্যাপারে আপনাদের পরামর্শ দিন; আপনারাই পলিসি মেকার হিসেবে কাজ করুন। আপনাদের মতামত ও পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিতে বিটিভি মুখপাত্র হিসেবে কাজ করবে।’
সংসদ সদস্য ও লোকসংগীতশিল্পী অণিমা মুক্তি গোমেজ তার বক্তব্যে বলেন, ‘আজকের আলোচনার যে বিষয়বস্তু সেটি সময়োপযোগী একটি বিষয়। সংগীতের সমকালীন অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সমস্ত শিল্পীদের একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে।’
নিয়মিতভাবে এমন মতবিনিময় সভা করা জরুরি বলেও তিনি মনে করেন।
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বলেন, ‘বাংলাদেশ টেলিভিশনের মধ্যে শিল্প সৃষ্টির পাগলামিটা থাকতে হবে, অভিনব চিন্তাধারা থাকতে হবে। সস্তা জনপ্রিয়তার দিকে ছুটলে চলবে না। বিটিভির অনুষ্ঠানের ধরন ও মনন সবই হবে পরিশীলিত। গবেষণামূলক কাজ থাকতে হবে, নতুন ভাবনার প্রতিফলন থাকতে হবে। এখানকার কর্মীদের শুধুমাত্র টেলিভিশনে চাকরি করলে হবে না, টেলিভিশনটাকে ভালোও বাসতে হবে।’
কিরণ চন্দ্র রায় তার বক্তব্যে বলেন, ‘ঐতিহ্য সমকালীন চর্চা দিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হলে তখন ঐতিহ্য আর ঐতিহ্য থাকে না। সংগীত সাধনার ক্ষেত্রেও এ ব্যাপারটা মাথায় রাখা জরুরি।’
ফরিদা পারভীন বলেন, ‘বাংলা গান আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি, এটাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে। বাংলা গানের শুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে এবং এ প্রজন্মের মধ্যে তা ছড়িয়ে দিতে হবে। আমি লালনের গানের একজন সাধক হিসেবে চাইবো-রবীন্দ্র ও নজরুল চর্চা যেমন ঘটা করে হয়, লালনের গানের চর্চাটাও যেন তেমন হয়।’