পালে দো ফেস্টিভাল ভবনের সুবিশাল প্রেক্ষাগৃহ গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে যেদিকে তাকাই শুধু তারকা আর তারকা! এখানে যেন তারার হাট বসেছে! সেলুলয়েডের এই মানুষগুলো প্রত্যেকেই ইতিবাচকভাবে বদলে দিতে পারেন একেকটা পৃথিবী। ৭০ বছর ধরে তারাই বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক চলচ্চিত্র উৎসব ‘কান’-এর বন্ধু।
মঙ্গলবার (২৩ মে) সন্ধ্যায় নামিদামি ও খ্যাতিমান তারকারা লালগালিচায় পা মাড়িয়ে একে একে সমবেত হন গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে। এখানেই বিশেষ ঢঙে জাঁকজমকভাবে উদযাপন করা হলো কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭০তম আসর। এ আয়োজনে ছিল প্রদর্শনী, সম্পাদিত আর্কাইভ, নির্বাচিত ছবির অংশ, সংগীত পরিবেশনা এবং শিল্পীদের উপস্থাপনা।
সাধারণত কান উৎসবের ডিনার পার্টি হয়ে থাকে শুরুর দিনই। কিন্তু ৭০তম মাইলফলক উদযাপন করতে আয়োজকদের এ ভিন্ন উদ্যোগ। এবারের ডিনারে হাজির হয়েছে তামাম দুনিয়ার চলচ্চিত্র শিল্পের রথী-মহারথীরা। ছিলেন পাম দ'র জয়ী এবং উৎসবে ইতিপূর্বে সাফল্য পাওয়া অনেক শিল্পী।
চলচ্চিত্র বোদ্ধারা মনে করেন, কান উৎসব না হলে বিশ্ব চলচ্চিত্র বর্তমানে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, তা দেখা যেতো না। তাই এ আয়োজনকে অভিভাবক মনে করেন অনেকে! সেই অভিভাবকের ৭০ বছর পূর্তি উদযাপন করতে একই প্রেক্ষাগৃহে হাজির গোটা চলচ্চিত্র দুনিয়া!
উদযাপনের চেয়েও এই আয়োজন হয়ে উঠেছিল তাদের জন্য আলোচনার উপলক্ষ্য। বিভিন্ন প্রজন্মের নির্মাতা, অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের একে অপরের সঙ্গে সিনেমা, চলচ্চিত্রের ও কান উৎসবের ইতিহাস নিয়ে আড্ডা দেওয়ার মোক্ষম সুযোগ ছিল এটাই।
এর আগে মঙ্গলবার বিশেষ ফটোকলে এসে একফ্রেমে বন্দি হন বিশ্ব চলচ্চিত্রের ১১৩ জন শিল্পী-কুশলী। স্বর্ণপাম জয়ী নির্মাতা থেকে শুরু করে বিচারকদের সভাপতি ও বিচারকের দায়িত্ব পালন করা তারকারা সন্ধ্যায়ও সমবেত হলেন কানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে।
সন্ধ্যা ৭টায় গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে সব অতিথিকে স্বাগত জানান কান উৎসবের পরিচালক থিয়েরি ফ্রেমো। অতিথি সারিতে তখন এবারের আসরের প্রতিযোগিতা বিভাগের বিচারকদের সভাপতি পেদ্রো আলমোদোভার, স্বর্ণপাম জয়ী একমাত্র নারী নির্মাতা জেন ক্যাম্পিয়ন, বিখ্যাত পরিচালক কেন লোচ, মাইকেল হানেকি, জর্জ মিলার, আলেহান্দ্রো গঞ্জালেজ ইনারিতু, গুইলারমো দেল তোরো, আলফনসো কুয়ারন, সালমা হায়েক, মনিকা বেলুচ্চি, উমা থারম্যান প্রমুখ।
কিন্তু ফরাসি অভিনেত্রী ইজাবেল উপাহকে দেখা যাচ্ছিল না কোথাও। কিছুক্ষণের মধ্যে মঞ্চে শুরু হলো তার দীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য অংশের প্রদর্শনী। তারপর হাজির হন তিনি। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব ছিল তার কাঁধে। ফরাসি এই অভিনেত্রী বলেছেন, ‘আজ রাতে আমরা একসঙ্গে চলচ্চিত্র ও কানের মধ্যকার বিয়ের ৭০ বছর পূর্তি উদযাপন করবো। তবে মনন ও হৃদয়ের আড্ডা হওয়ার আগে তেমন একটা অর্থবহ ছিল না এ উৎসব। কান ও চলচ্চিত্রের মধ্যকার ভালোবাসার ইতিহাসেরও রহস্য হয়তো তেমনই। এ হলো উদ্দীপনা ও অন্তরের মিলন। দাম্পত্য জীবন টিকে থাকার রহস্যও সম্ভবত এটাই।’
অতিথি সারিতে থিয়েরি ফ্রেমোর পাশেই বসেছিলেন ইজাবেল উপাহ। নারীদের ওপর কান উৎসবের ইতিহাসের থিম্যাটিক মন্টেজ উপস্থাপন করেন তিনি। বছরের পর বছর ধরে নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা গল্প ও তাদের চোখে দেখা চরিত্র উপস্থাপন করে আসছে কান।
থিয়েরি ফ্রেমো মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘আমরা ও সিনেমাপ্রেমীরা কেউই বুড়ো হতে চাই না! কারণ সিনেমা এমন কিছু যা আমাদের মধ্যে ঘুমন্ত শিশুকে বিস্মিত করে চলে। সিনেমা আমাদের কাঙ্ক্ষিত একটি পৃথিবী সামনে এনে দেয়।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন উৎসবের সভাপতি পিয়েরে লেসকিউ, মেক্সিকান নিউওয়েভ সিনেমার সবচেয়ে প্রভাবশালী নির্মাতাদের মধ্যে অন্যতম গুইলারমো দেল তোরো, ফরাসি অভিনেতা ভানসেন্ত লান্দন, ইতালিয়ান পরিচালক পাওলো সরেন্তিনো। তাদের মধ্যে বিশ্বজুড়ে সহনশীলতার আহ্বান জানিয়ে অতিথিদের মন কাড়েন দেল তোরো। তাই সবাই দাঁড়িয়ে তাকে করতালিতে অভিনন্দন জানান।
কান উৎসবের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমন কিছু ছবির গান নিয়ে ছিল সরাসরি পরিবেশনা। প্রথমে ‘দ্য লেসন অব পিয়ানো’, ‘অরফেউ নেগ্রো’ ও ‘অ্যা ম্যান অ্যান্ড অ্যা ওম্যান’ ছবির ম্যাডলি গেয়েছেন ক্যামেলিয়া জর্ডানা ও ব্যাবক্স।
এরপর ভিয়ানি পরিবেশন করেন ‘পাল্প ফিকশন’, ‘দ্য লং অ্যাবসেন্স’, ‘ইয়ুথ’, ‘সেইলর অ্যান্ড লুলা’, ‘উই ঔন দ্য নাইট’ ও ‘মুলা রুজ’ ছবির গান। ভিয়ানিকে সঙ্গ দেন ,ম্যানু কাতশি ও লঁহা ভারনারি।
বিদায়ের আগে সবশেষে বিশ্ব চলচ্চিত্র পরিবারের অসংখ্য সদস্য গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরের মঞ্চে জড়ো হন। সবাই মিলে গেয়েছেন ‘হ্যাপি বার্থডে!’ সবার হৃদয়ে তখন ছিল ‘হ্যাপি ফেস্টিভ্যাল!’
/জেএইচ/এমএম/