X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মার্কিন বাহিনীর ইরাক আগ্রাসনেই আইএস-এর উত্থান?

ফাহমিদা উর্ণি ও মাহাদী হাসান
২১ মার্চ ২০১৮, ১৭:৩৬আপডেট : ২২ মার্চ ২০১৮, ১৩:৫১
image

২০১৫ সালে নেভাডার এক বৈঠকে ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ভাই জেব বুশ। হঠাৎই এক কলেজ শিক্ষার্থীর অভিযোগের মুখে পড়েন তিনি, ‘তোমার ভাই আইএস তৈরি করেছে।’ সেসময় রিপাবলিকান এই প্রেসিডেন্ট মনোনয়নপ্রত্যাশী আইএস সৃষ্টিতে ওবামাকে দায়ী করেছিলেন, নিজ ভাইকে আড়াল করতে। বলেছিলেন, ২০১১ সালে ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করার কারণেই আইএস সৃষ্টি হয়েছে। তবে সেনা প্রত্যাহার নয়, ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন থেকেই যে আইএস-এর সৃষ্টি হয়েছে তা উঠে এসেছে বিভিন্ন প্রতিবেদন ও বিশ্লেষকের মন্তব্য থেকে। স্বনামধন্য মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্টারসেপ্ট-এ প্রকাশিত এক রচনায় ব্রিটিশ সাংবাদিক ও কলাম লেখক মেহদি হাসান আইএসের উত্থানের পেছনে মার্কিন আগ্রাসনকে দায়ী করেছেন। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে চিলকট প্রতিবেদনের অংশ হিসেবে প্রকাশিত কিছু গোয়েন্দা নথি বিশ্লেষণ করে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানেও ইরাক অভিযানের কারণে আইএস-এর উত্থান ঘটেছে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। ২০১৫ সালে বিকল্পধারার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ডেমোক্র্যাসি নাউ-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন ভাষাবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক নোম চমস্কি আইএস-এর জন্মকে ইরাক যুদ্ধের প্রধানতম ফলাফল আখ্যা দেন। সেখানকার গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ক্ষত থেকেই আইএস সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মার্কিন বাহিনীর ইরাক আগ্রাসনেই আইএস-এর উত্থান?

বিষয়টি ষরযন্ত্রমূলক কী না সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। আইএস তৈরিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দায়ী করা। তবে ওই কলেজশিক্ষার্থীর অভিযোগ একদমই অমূলক ছিল না বলে মন্তব্য করেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ও কলাম লেখক মেহদি হাসান। মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্টারসেপ্টে লেখা এক কলামে তিনি তুলে ধরেছেন আইএস তৈরিতে ‍যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা। মেহদি হাসান তার নিবন্ধে বুশ শাসনামলের তিনটি বিষয় সামনে নিয়ে আসেন, যা আইএসের সঙ্গে ইরাক যুদ্ধের সংশ্লিষ্টতার প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। প্রথমত বিদেশি সেনাদের অবস্থান সবসময় স্থানীয় জনগণকে উষ্কে দেয় এবং সহিংস মানসিকতা গড়ে তোলে। যেমনটা লেবাননে হিজবুল্লাহ কিংবা গাজা উপত্যকায় আমরা হামাসকে দেখতে পাই। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন থেকে দেশকে বাঁচাতে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ‘নায়কোচিত’ পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করে অনেকে। কিন্তু ফজুল্লায় সাধারণ মানুষের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি চালায় মার্কিন সেনারা। নিহত হন অনেকে। সেই ফজুল্লাহতেই পরে গড়ে ওঠে আইএসের ঘাঁটি। মেহদি হাসান বলেন, ‘গুলি, হত্যা ও নিপীড়ন সবকিছুই সাধারণ মানুষকে সন্ত্রাসী হতে বাধ্য করেছে। ২০০৪ সালে আবু মুসাব আল জারকোয়াই ইরাকে নিজের নামে আল কায়েদা গড়ে তুলেন। উদ্দেশ্য একটাই মার্কিন সেনাদের বিপক্ষে লড়াই। আদতে আইএসের জন্মের শুরু সেখানেই।

ইরাক যুদ্ধ

দ্বিতীয়ত ২০০৩ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র একদমই কাণ্ডজ্ঞানহীন এক পদক্ষেপ নেয়। ইরাকি সেনাবাহিনীকে অকেজা করে দেন তারা। এক রাতের মধ্যেই পাঁচ লাখ প্রশিক্ষিত ইরাকি সেনা কর্মসংস্থানহীন হয়ে পড়ে। বুশের শাসনামলে দায়িত্বপালন করা জেনারেল কলিন পাওয়েলও বলেছিলেন, এই চাকরিহীন সেনারাই বিদ্রোহী গোষ্ঠী গড়ে তোলে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইএসের শীর্ষ কমান্ডারদের ব্যাপারে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, তাদের অনেকেই সাদ্দাম হুসেনের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। এবং তৃতীয়ত, মার্কিন সেনাবাহিনী হাজার হাজার ইরাকিকে গ্রেফতার করেছে। তাদের অনেকেই বেসামরিক। ইরাকে দক্ষিণাঞ্চলের বুকা ক্যাম্পে জঙ্গিদের সঙ্গে বন্দি রাখা হয় তাদের। সেখানে বসেই তাদের জঙ্গিবাদে উৎসাহ দেওয়া হয়, করা হয় হামলার পরিকল্পনা। কমপাউন্ড কমান্ডার জেমস স্কাইলার জেরন্ড বলেন, ক্যাম্প বুকায় আমাদের অনেকেই উদ্বিগ্ন ছিল যে আমরা তাদের আটক না করে বরং জঙ্গিবাদে উষ্কে দিচ্ছি। সেই বুকাতেই বন্দি ছিলেন আইএসের স্বঘোষিত খলিফা আবু বকর আল বাগদাদী। ইরাকে সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিশাম আল হাশিমি বলেন, ‘বাগদাদী জিহাদি আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেকে বড় করে তুলেছে।’ 

ইরাক যুদ্ধ

মেহেদি হাসান তার নিবন্ধের শেষ পর্যায়ে এসে বলেন, ‘স্পষ্টতই আইএস ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের ফসল।’ এক্ষেত্রে ডেভিড কিলকুলেনের বক্তব্য উল্লেখ করেন তিনি। জেনারেল ডেভিড পিট্রাস ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইসের সাবেক পরামর্শক ডেভিড বলেন, ‘আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে অনেক সমস্যাই আমাদের সৃষ্টি।’ চ্যানেল ফোরকে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘ইরাকে আগ্রাসন না চালালে নিশ্চিতভাবেই আইএস তৈরি হতো না।’

চিলকট প্রতিবেদনে বলা হয়, সুন্নি জিহাদি সংগঠনগুলো ২০০৬ সালে ইরাকের শিয়া নেতৃত্বাধীন নুরি মালিকি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করায় ব্রিটিশ নিরাপত্তা সংস্থাগুলো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থা জয়েন্ট ইনটেলিজেন্স কমিটি (জেআইসি)২০০৬ সালের শুরুর দিকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়, জিহাদিদের সংখ্যা কী মাত্রায় বাড়ছে তা ব্যাখ্যা করা জটিল। অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয়তাবাদী ও জিহাদিদের মধ্যকার পার্থক্য অস্পষ্ট। অনেকসময় তাদের লড়াইয়ের কারণগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য পাওয়া যায় এবং তারা একত্রিত হয়ে পড়ে।’ 

ইরাক যুদ্ধ

আইএস সদস্যদের সাংগঠনিক পরিচয় নিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এদের কেউ আল কায়েদার দ্বারা অনুপ্রাণিত ইসলামি চরমপন্থী, কাউকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে, আবার কেউবা এসেছে শিয়াদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে। জিহাদিদের মিডিয়া তাদের ভূমিকাকে সুন্নিপন্থী হিসেবে দেখিয়ে থাকে’।

চিলকটের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরাকে অভিযান চালানোর আগে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে সতকর্তা দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সাদ্দাম হোসেনের নৃশংস শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে দমিয়ে রাখা হয়েছে, তাকে উৎখাত করা হলে সে উত্তেজনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। ফরাসি সরকারের পক্ষ থেকেও ইরাক অভিযানের ব্যাপারে টনি ব্লেয়ারকে সতর্কতা হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে চিলকট প্রতিবেদনে। ফ্রান্সের সে সময়কার প্রেসিডেন্ট জ্যাকস চিরাক ভীষণভাবে ওই অভিযানের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, এ অভিযান অপ্রত্যাশিত ফলাফল বয়ে আনবে। 

ইরাক যুদ্ধ

মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ও যুক্তিবিদ নোম চমস্কি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আগ্রাসনের ফলেই তৈরি হয়েছে আইএস। ২০০৩ সালের সেই আগ্রাসনে তৈরি হয়েছে জাতিগত দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বেরই ফসল আজকের অন্যতম ভয়াবহ এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর। চমস্কি বলেন, ‘তারা হঠাৎ করে চলে আসেনি। তারা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মফল, ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের ফল। এই আগ্রাসনের আরও ভয়াবহ ফল রয়েছে তার মধ্যে এটা একটা। মার্কিন আগ্রাসনের আগে শিয়া সুন্নিরা একই এলাকায় শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতো, নিজেদেরে মধ্যে বিয়ে হতো। অনেকে তো জানতোও না যে তাদের প্রতিবেশী শিয়া নাকি সুন্নি।’ তবে মার্কিন আগ্রাসনের পর পরিস্থিতি পাল্টে গেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এটা হয়তো আদর্শ সমাজ ছিলো না। হয়তো কিছুটা বিবাদ ছিল। কিন্তু জাতিগত দ্বন্দ্ব এতটা প্রকট কখনোই ছিল না। কয়েক বছরের মধ্যে সেখানে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয়। অথচ আগে এমন অবস্থা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।’

মার্কিন বাহিনীর ইরাক আগ্রাসনেই আইএস-এর উত্থান?

আইএস-এর ভূমিকার কারণে সুন্নিদের প্রতি বিদ্বেষ বেড়েছে। তাদের প্রতিহত করা শিয়া সেনাদেরও একই অবস্থা। পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এই জাতিগত বিদ্বেষ। এই বিষয়টি গুলি বা বোমা দিয়ে প্রতিহত করা যাবে না বলেও মন্তব্য করেন চমস্কি। তিনি বলেন, শুধু শিয়া-সুন্নি নয়। এই বিদ্বেষ এখন সর্বত্র। এজন্যই প্রয়োজন কূটনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান। কেউই নির্দোষ নয়। অনেক সাধারণ মানুষের জীবন আজ বিপন্ন। আসিরিয়ান খ্রিস্টান, ইয়াজিদি তাদের মধ্যে অন্যতম। তাদের রক্ষা করছে পিকেকে। তাদের আবার সন্ত্রাসী তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আইএসের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে আসতে গেলে সবকিছুই মাথায় রাখতে হবে। ইরানকে ভুলে গেলেও চলবে না। কারণ তারাই ইরাককে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করছে।

/বিএ/
সম্পর্কিত
ইসরায়েলের আকরে শহরে হামলার দাবি করলো হিজবুল্লাহ
গাজার হাসপাতালে গণকবর, আতঙ্কিত জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ৫ অভিবাসী নিহত
সর্বশেষ খবর
বিক্রির জন্য সবজি কিনে ফেরার পথে দুই ব্যবসায়ী নিহত
বিক্রির জন্য সবজি কিনে ফেরার পথে দুই ব্যবসায়ী নিহত
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
রাজধানীতে খেলাফত মজলিসের বিক্ষোভ
রাজধানীতে খেলাফত মজলিসের বিক্ষোভ
প্রচণ্ড গরমে দই-ফলের এই ডেজার্ট বানিয়ে খান
প্রচণ্ড গরমে দই-ফলের এই ডেজার্ট বানিয়ে খান
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি