X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইউরোপ-আমেরিকা-মধ্যপ্রাচ্যে এরদোয়ানের পররাষ্ট্রনৈতিক ধাঁধা

মাহাদী হাসান
২৫ জুন ২০১৮, ২০:৫৭আপডেট : ২৫ জুন ২০১৮, ২৩:৪০

ইউরোপ-আমেরিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য; গোটা পৃথিবীর শাসকদের কাছেই তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ানের পররাষ্ট্রনীতি এক ধোঁয়াশাপূর্ণ বিষয়। পেন্টাগন নিজেও জানে না সিরিয়া যুদ্ধে তুরস্ক আসলে কার পক্ষে। বিশ্বজুড়েই মার্কিন স্বার্থবিরোধী অবস্থান নিলেও নিজ স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্র কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। কারণ মধ্যপ্রাচ্য ও কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করেছে তুরস্ক। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যুদ্ধবিমান নেওয়ার কথা থাকলেও এখন তুরস্ক ঝুঁকছে রাশিয়ার দিকে। মার্কিন সমর্থিত জোট ন্যাটোর সদস্য হলেও চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট ইউরেশিয়াতে যোগ দেওয়ার কথাও ভাবছেন এরদোয়ান। কাগজে কলমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ সদস্য হলেও প্রায়ই ইউরোপীয় দেশগুলোর সমালোচনায় সরব হয়ে ওঠেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। তবে সিরীয় শরণার্থী ঢলের আশঙ্কার কথা ভেবে নীরব থাকেন ইউরোপীয় নেতারাও।

ইউরোপ-আমেরিকা-মধ্যপ্রাচ্যে এরদোয়ানের পররাষ্ট্রনৈতিক ধাঁধা তুরস্কবাসীর জন্য এক ঐতিহাসিক সপ্তাহ অতিক্রান্ত হচ্ছে। সেটা নির্বাচনের কারণে নয়। নয় এরদোয়ানের বিজয়ের কারণে। আঙ্কারা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে টেক্সাসে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এফ-থার্টিফাইভ এ-এর প্রথম দুইটি জঙ্গিবিমান গ্রহণ করেন। লাইটেনিং টু নামের এই জঙ্গিবিমান বিশ্বের সর্বোত্তম জঙ্গিবিমান। ১৯৯৯ সালে একশ’টি এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান কেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করে তুরস্ক। তুর্কি প্রতিরক্ষামন্ত্রী নুরুদ্দিন জানকিলি বলেছেন, জঙ্গিবিমান ক্রয় সংক্রান্ত চুক্তিতে দেওয়া সব প্রতিশ্রুতি আঙ্কারা পূরণ করেছে। এরইমধ্যে ৮০ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। তবে মুশকিল হলো চুক্তি সইয়ের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন আইন প্রণেতা তুরস্ককে এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান দেওয়ার বিরোধিতা করে আসছে। ওয়াশিংটনের পাশাপাশি ন্যাটোভুক্ত মার্কিন বন্ধুরাষ্ট্রগুলোও তুরস্কের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গিবিমান বিক্রয়ের সিদ্ধান্তে নাখোশ।

এরইমধ্যে গত ২১ জুন, নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহেড মার্টিন এরইমধ্যে টেক্সাসে তুর্কি নৌ-সেনাদের হাতে প্রথম দুইটি জঙ্গিবিমান তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেদিন তুর্কি পাইলটদেরকে ক্রয়কৃত দুইটি জঙ্গিবিমান চালনার সুযোগ দেন। তবে শর্তসাপেক্ষে তুর্কি পাইলটরা এইসব বিমান পরিচালনার দায়িত্ব নিজেদের হাতে নিতে সক্ষম হয়েছেন। তারা কেবল যুক্তরাষ্ট্রে থেকেই এগুলো পরিচালনা করতে পারবেন। বিমান দু’টি তখনই কেবল তুরস্কে নিয়ে যেতে পারবেন যখন তারা দক্ষতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে ফেলবেন। মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, প্রশিক্ষণ কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তুর্কি পাইলটদের বিমান পরিচালনায় দক্ষ করে তুলতে ২ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। এই যখন অবস্থা তখন আরেকদিকে দুই দফায় মার্কিন আইনপ্রণেতারা কংগ্রেসে দুই দফায় আপত্তি তুলেছেন আংকারাকে এই বিমান দেওয়ার প্রশ্নে।

পেন্টাগন এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিক্রি বন্ধ করেনি। তবে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এর দাবি প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করছেন। সিনেটের প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক কার্যক্রম বিল থেকে এটি বাদ দেওয়ারও পরিকল্পনা করছেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তুরস্ক ১০০টি এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান কেনার চেষ্টা করছে। কিন্তু অনেক মার্কিন আইনপ্রণেতা তুরস্কের এ প্রচেষ্টায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মে মাসে ন্যাটো মিত্রদেশ তুরস্কের কাছে এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান বিক্রির বিষয়টি আটকে দিতে কিংবা বিমান সরবরাহে বিলম্ব ঘটাতে মার্কিন সিনেটে একটি বিল পাস করা হয়। তুরস্কের কাছে বিমান বিক্রির বিষয়টি থামিয়ে দিতে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট ও নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে জোর প্রচেষ্টা চলে।

রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টিকেও মার্কিন আইনপ্রণেতারা সহজভাবে নেয়নি। রাশিয়ার কাছ থেকে তুরস্ক এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কিনবে এবং যুক্তরাষ্ট্র এফ-৩৫ বিমান না দিলে রুশ সুখোই-৫৭ জঙ্গিবিমান কেনার কথা ঘোষণা করেছে। মার্কিন সিনেটর ভ্যান হলেন বলেন, ‘আমাদের উদ্বেগ হচ্ছে এফ-৩৫ নিয়ে। এটি সর্বাধুনিক ন্যাটো যুদ্ধবিমান। তুরস্ক এটা পেয়ে যদি রাশিয়াকে তথ্য সংগ্রহ করতে দেয়। তাহলে এটা তৈরি করতে জেনে যাবে রাশিয়া।’

ইউরোপ-আমেরিকা-মধ্যপ্রাচ্যে এরদোয়ানের পররাষ্ট্রনৈতিক ধাঁধা তবে তুরস্কের দাবি এই জঙ্গিবিমান পেলে বৈশ্বিক স্তিতিশীলতা তৈরি হতো। তুর্কি মেজর জেনারেল রেহা উফুক এর বলেন, ভবিষ্যতের হুমকি মোকাবিলায় তুরস্কের এফ-৩৫ ছিল সবচেয়ে বড় সম্পদ। এটা বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা রক্ষায়ও ভূমিকা রাখবে। দেশটির প্রতিরক্ষা দফতরের ডেপুটি আন্ডারসেক্রেটারি সরদার ডেমিরেল বলেন, এফ-৩৫ বিমানগুলো দেশকে সহায়তা করতো। ন্যাটোকে শক্তিশালী করতো।

গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক খোলা চিঠিতে বলা হয়, ‘ন্যাটোর প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলেও তুরস্ক বিশ্বজুড়ে মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বারবার তাদের সেনাবাহিনী মার্কিন স্বার্থবিরোধী কাজ করেছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের শাসনে তুরস্ক গণতন্ত্র ও মানবাধিকার উপেক্ষা করেছে। আর স্পষ্টভাবেই রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মার্কিন-তুর্কি সম্পর্ক। রুশ মিসাইলকে সরিয়ে রাখলেও সিরিয়া নিয়ে এরদোয়ানের অবস্থান ছিল সংশয়পূর্ণ। কুর্দিসেনাদের সহায়তায় আইএসকে দমন করা মার্কিন সেনাদেরও হুমকি দিয়েছেন তিনি। পেন্টাগনও সংশয়ে পড়ে গেছে তুরস্ক আসলে কার পক্ষে। কুর্দি সেনাদের দমনে তুরস্কের সামরিক আগ্রাসনেও পরিস্থিতি অনেকটা অস্থিতিশীল হয়ে যায়।

সিরিয়ায় তুর্কি বাহিনীর লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি ওয়াইপিজি যোদ্ধাদের উৎখাত করা। ওয়াইপিজি যোদ্ধাদের তুরস্ক কুর্দি বিদ্রোহীদের মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে। এরদোয়ানের সঙ্গে ফোনালাপ করার মধ্যদিয়ে তুরস্কের অভিযান বন্ধের জন্য সর্বশেষ চেষ্টা চালালেন ট্রাম্প। ফোনালাপে তিনি উভয় দেশের বাহিনীর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেন। তবে এরপরও অভিযান বন্ধ রাখেনি তুরস্ক। সিরিয়ার আফরিন ও মানবিজে সামরিক অভিযান চালিয়েছে তারা।

ইউরোপ-আমেরিকা-মধ্যপ্রাচ্যে এরদোয়ানের পররাষ্ট্রনৈতিক ধাঁধা

এছাড়া ইরানের সঙ্গে বন্ধুত্বের বিষয়টিতেও উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা।  অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র অনেক ব্যাপারেই তুরস্কের সাহায্য চায়। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ইনকিরলিক বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র। এতে করে ওই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সহজ হয় যুক্তরাষ্ট্রের। তারা এটাও জানে, তুরস্কের সহায়তা ছাড়া সিরিয়ায় প্রভাব বিস্তার সহজ হবে না। কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চল, বলকান ও ককাশাসে রুশ প্রভাব কমাতে যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা করেছিল তুরস্ক।

ইউরোপীয় সরকারগুলোর তুরস্কের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি একইরকম। তারা তুরস্ককে সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক ও পশ্চিমাপন্থী দেশ হিসেবে বিবেচনা করে। যা এই অঞ্চলে যেটা ‍খুবই দুর্লভ। কাগজে-কলমে তুরস্ক এখনও ইইউ এর ভবিষ্যৎ সদস্য। তবে এরদোয়ানের অভ্যন্তরীণ নিপীড়নের অভিযোগ ও ইউরোপ বিরোধী বক্তব্যের কারণে ইইউ সদস্যরাষ্ট্রগুলোও হতাশ। কিন্ত এসব নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলে না তারা। কারণ আইএস দমনে ও ইউরোপে সিরীয় শরণার্থীর ঢল ঠেকাতে এরদোয়ানের সহায়তা প্রয়োজন তাদের।

/এমএইচ/
সম্পর্কিত
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
সর্বশেষ খবর
রাফায় আবারও ব্যাপক হামলা ইসরায়েলের
রাফায় আবারও ব্যাপক হামলা ইসরায়েলের
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল কার্যালয়ে ঠিকাদারকে মারধর২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ