X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ট্রাভেলগ

টিপু সুলতানের দুর্গে একদিন

ওয়ালিউল বিশ্বাস
১৬ অক্টোবর ২০১৮, ২৩:১৪আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:০১

দেবতা মারুগান এসে নেমেছেন পদ্মপুকুরে। হাতে তীর। রণাঙ্গনে ধনুক হাতে তীরন্দাজ রূপে হাজির তিনি। শত্রুদের ওপর তীর নিক্ষেপ করাই তার উদ্দেশ্য। ঘটনাটা অনেক আগের। যে জায়গায় তিনি নেমেছিলেন, সেই পদ্মপুকুর হলো বর্তমান ভারতের ভেলোর সিটি। তামিলনাড়ু রাজ্যের শহর। 

‘ভেল’ অর্থ বলা হয়ে থাকে ‘স্পেয়ার’ বা ‘যুদ্ধাস্ত্র’। ‘অর’ মানে জায়গা। এই হলো সংক্ষেপে শহরটির নামের অর্থ। ভেলোরে আমি উঠেছিলাম একটি লজে। এর মালিক সেলিম ভাইয়ের কাছে এসব তথ্য অবশ্য তেমন একটা পাত্তা পেলো না। তার মতে, ‘ভেল’ অর্থ সূর্যের উত্তাপ আর ‘অর’ মানে জায়গা। তার অভিমত সত্যি হতেও পারে। কারণ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এই শহরে থেকে উত্তাপ কাকে বলে তা মোটামুটি টের পেয়েছি।

টিপু সুলতানের দুর্গ সেলিম ভাইকে ভেলোর সিটির উইকিপিডিয়া মানি। একদিন হঠাৎ তিনি ভ্রু উঁচিয়ে বললেন, ‘যান, টিপু সুলতান, দ্য টাইগার অব মহীশুরের ফোর্ট (দুর্গ) থেকে ঘুরে আসুন।’ তার কথাকে এড়িয়ে যাবো ভাবলেও ভ্রু উঁচিয়ে বলার মেজাজকে পাশ কাটানো কঠিন। এই ভঙ্গিমার মধ্যে একধরনের গর্ব আছে! এজন্যই একদিন গিয়েছিলাম টিপু সুলতানের দুর্গে।

বাংলাদেশের কাছে ভেলোরের আরেক নাম প্রাণ বাঁচানোর শহর! কারণ এই নগরী গড়ে উঠেছে ‘সিএমসি’ (ক্রিশ্চিয়ান মেডিক্যাল কলেজ) হাসপাতালকে ঘিরে। চিকিৎসা সম্পর্কিত কাজের ফাঁকে আমার মতো অনেকেই ঘোরাঘুরি করেন।
প্রথমেই বলে নেওয়া জরুরি, ভেলোর দুর্গ মূলত স্থাপন করেছেন বিজয়নগর সাম্রাজের রাজা বিজয়নগর। টিপু সুলতানের মূল প্রাসাদ বেঙ্গালুরুর মহীশুরে। বর্তমানে সেই গ্রামের নাম শ্রীরঙ্গপত্তনম। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের মান্ডিয়া জেলায় অবস্থিত এটি।
টিপু সুলতানের দুর্গ রাজা বিজয়নগর ষোড়শ শতকে জলঘেরা দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তোলেন ভেলোরে। এর মধ্যে টিপু সুলতানের নাম আসার কারণ, ১৭৯৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় টিপু সুলতান নিহত হওয়ার পর তার পরিবারকে এখানেই বন্দি করে রাখা হয়। তখন দুর্গে ছড়িয়ে পড়ে বিয়োগান্তক আবহ। তার জীবনের শেষ সময়ের টানাপোড়েনের সঙ্গে এই দুর্গ যুক্ত।

ভেলোরের শহরাঞ্চল খুব একটা বড় নয়। সিএমসি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেওয়ার উদ্দেশে (সাধারণত এজন্যই যান বাংলাদেশিরা) গিয়ে থাকলে সায়দাপেট বাজার পর্যন্ত পা ফেলুন। সেখানে থেকে হেঁটে গেলে ২০ মিনিটের দূরত্বে দুর্গ। অটোতে গেলে ৫০ রুপির মধ্যে যাওয়া যায়। বাসে ২-৩ রুপি লাগতে পারে।

সায়দাপেট বাজারে ফুলের বেচাকেনা চোখে পড়ার মতো এই দুর্গের সবকিছুই পাথর দিয়ে বানানো। এর নির্মাণশৈলী বিস্মিত করার মতো। সব মিলিয়ে অনন্য একটি স্থাপত্য। বিভিন্ন করিডোর আর দুর্গের ছাদেও চাইলে যাওয়া যায়। এত সুরক্ষিত ও শক্তিশালী দুর্গ বা প্রাসাদ আর দেখিনি! ভেতরে প্রবেশ করতে হলে সেতু পেরিয়ে যেতে হয়। কারণ চারদিকে পরিখা (শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রতিরক্ষামূলক সুড়ঙ্গ বা লেক)। এরপরই চোখে পড়বে নিরাপত্তায় নিয়োজিত প্রহরীদের মূর্তি।

শুধু বাইরের সৌন্দর্যই নয়, দুর্গের ভেতরে আছে অসাধারণ একটি জাদুঘর। এতে রয়েছে ৯০০-১৪০০ বছর আগের ব্রোঞ্জের দেব-দেবীর অনেক মূর্তি-ভাস্কর্য। সেই সময়ের প্রাণীদের অবয়ব দেখে চোখ কপালে উঠে যেতে পারে! বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক মিশ্রণ দিয়ে কাচের জারে রেখে দেওয়া হয়েছে জন্তু-জানোয়ার।

টিপু সুলতানের দুর্গ ভারতীয়দের মধ্যে দেশপ্রেম বা স্বদেশিদের জন্য আলাদা একটা টান আছে। অনেক জায়গায় এর প্রমাণ পাবেন। বিশেষ করে যখন কোথাও ফি দিতে হবে। জাদুঘরেও এটি লক্ষ্য করেছি। এর প্রবেশমূল্য ভারতীয়দের জন্য ১০ রুপি আর বিদেশিদের বেলায় ১০০ রুপি! আপনার গায়ের রঙ যদি ভারতীয়দের মতো হয় আর হিন্দিটাও মোটামুটি জানা থাকলে হয়তো ১০ রুপিতেই ঢুকতে পারবেন। তবে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে ১০০ রুপির টিকিট কেনাই ভালো।

জাদুঘরের আরও অনেক কিছু দর্শনীয়। এর মধ্যে অন্যতম খ্যাপাটে দেশপ্রেমিক টিপু সুলতানের ব্যবহৃত যুদ্ধাস্ত্র! রণক্ষেত্রে তিনি কতটা প্রতাপশালী ছিলেন, সেটা বোঝা যায় এখানে। প্রজাদের প্রতি তার প্রেম আর বাঘপ্রীতির নানান উদাহরণও আছে। তিনি যে তলোয়ার ব্যবহার করতেন, তার গায়েও ছিল ডোরা দাগ, হাতলে ছিল খোদাই করা বাঘের মূর্তি। তার ব্যবহৃত রুমালও ছিল বাঘের মতো ডোরাকাটা। এমনকি রাজ্যের সমস্ত সৈনিকের পোশাকে থাকতো বাঘের ছবি। সৈন্যদের ব্যবহার্য তলোয়ার, বল্লম, বন্দুকগুলোর নল, কুদো, হ্যামারও এই খোদাই থেকে বাদ যেতো না।
টিপু সুলতানকে বলা হতো শের-ই-মহীশূর; অর্থাৎ মহীশূরের বাঘ। মজার বিষয় হলো, তাকে এই উপাধি দিয়েছিল তারই আজন্ম শত্রু ইংরেজরা। তার এই বাঘ হয়ে ওঠার পেছনে অনেক কারণে আছে। বরাবরই ইংরেজরা তার কৌশল, অসাধারণ ক্ষিপ্ততা, দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তার কাছে নাস্তানাবুদ হয়েছে। বাঘ বলার আরেকটি বড় কারণ, ছোটবেলা থেকেই বাঘের গল্প শুনতে ভালো লাগতো টিপুর। বাবা মহীশূর রাজ্যের সেনাপতি হায়দার আলী তাকে বাঘের গল্প শোনাতেন। বিস্মিত হওয়ার মতো বিষয় হলো, কিশোর বয়সেই টিপু সুলতান বাঘ পুষতেন! তখন থেকেই তার বাঘপ্রীতি।
বাবার মৃত্যুর পর টিপু সুলতান সিংহাসন নিজের মতো করে সাজালেন। রাজ্যের শ্রেষ্ঠ কারিগর দিয়ে কাঠের ফ্রেমের ওপর সোনার পাত বসিয়ে সেখানে মণিমুক্তা ও রত্নখচিত একটি সিংহাসন বানিয়ে নিলেন। আট কোণার ওই আসনের ঠিক মাঝখানে ছিল একটি বাঘের মূর্তি। ৮ ফুট চওড়া আসনটির রেলিংয়ের মাথায় বসানো হয় সোনা দিয়ে তৈরি দশটি বাঘের মাথা। আর ওপরে ওঠার জন্য ছিল দু’ধারে রূপার তৈরি সিঁড়ি। পুরো আসনই ছিল বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা। এই ব্যাঘ্রাসনে বসেই মাঝে মধ্যে হুঙ্কার ছাড়তেন টিপু সুলতান। কণ্ঠ ঝাঁঝালো করে বলতেন: ভেড়া বা শিয়ালের মতো ২০০ বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মতো দু’দিন বেঁচে থাকাও ভালো! মূলত এই বাক্যেই সভাকক্ষ গা ঝাড়া দিয়ে উঠতো!তবে জাদুঘরে টিপু সুলতানের সিংহাসন দেখিনি। হয়তো খেয়াল করা হয়নি। 


টিপু সুলতানের দুর্গ ব্রিটিশদের রক্ত হিম করে দেওয়া এই যোদ্ধাকে ভোলেনি ভেলোরের মানুষ। নয়তো বিজয়নগর সাম্রাজের নানান কীর্তির পরও এই স্থাপনাকে লোকে টিপু সুলতানের দুর্গ বলতো না। কিংবা সেলিম ভাইদের মতো মানুষেরা বুকটা উঁচু করে ভ্রু তুলে বলতেন না— ‘যান, টিপু সুলতানের দুর্গ থেকে ঘুরে আসুন!’
শক্ত পাথরের এই দুর্গেই মিশে আছে ভারতের স্বাধীনতাকামী প্রচণ্ড প্রতাপশালী বীরের নাম। মহীশুরের ক্ষিপ্র বাঘ টিপু সুলতান সত্যিকার অর্থেই হৃদয় থেকে হৃদয়ে বেঁচে থাকা যোদ্ধার নাম। 

টিপু সুলতানের দুর্গে লেখক ভেলোর যাবেন যেভাবে
বিমানে গেলে চেন্নাই হয়ে ভেলোর। এছাড়া কলকাতা থেকে ভেলোরে বেশ কয়েকটি ট্রেন চলাচল করে। সেক্ষেত্রে যেতে সময় লাগে ২৯ থেকে ৩৪ ঘণ্টা। অনেকে বিকল্প হিসেবে কলকাতা থেকে সরাসরি চেন্নাই চলে যান। এরপর সেখান থেকে আরও তিন ঘণ্টা ব্যয় করে ভেলোরে ফিরে আসেন।

কলকাতা থেকে ভেলোরে ট্রেন ভাড়া ৪০০ রুপি থেকে তিন হাজার রুপি পর্যন্ত। কেবিন ও আসনভেদে ভাড়া কমবেশি। তবে দূরপাল্লার যাত্রীদের টু-টায়ার বা থ্রি-টায়ার কেবিনের আসন নেওয়াই নিরাপদ। চিকিৎসার কাজে গেলে টিপু সুলতানের দুর্গের পাশাপাশি সেখানকার ২৭ মন সোনায় মোড়ানো গোল্ডেন টেম্পল (সোনার মন্দির) দেখতে পারবেন। সেই গল্প অন্যদিন হবে।
ছবি: লেখক


/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
সর্বাধিক পঠিত
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!