X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ট্রাভেলগ

ইলিশের বাড়িতে সারাবেলা

জান্নাতুল ফেরদৌস শ্রাবন্তী
১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:৫৭আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:১৪

বেড়ানোর পরিকল্পনা করা বরাবরই ভালোলাগার ব্যাপার। এর সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া যুক্ত থাকলে তো কথাই নেই! তাই চাঁদপুর ভ্রমণের সঙ্গে মেশানো ছিল অন্যরকম আনন্দ। ইলিশের বাড়ি বলে কথা! বন্ধুরা মিলে সারাবেলা কাটিয়ে এলাম সেখানে। সকালে গিয়ে রাতের মধ্যে ফিরে আসার সেই গল্পটা বলি।

আগে কখনও লঞ্চ ভ্রমণ করিনি। তাই আনন্দের সঙ্গে একচিমটি উত্তেজনাও ছিল। সদরঘাট গিয়ে পৌঁছালাম সকাল ৮টার মধ্যে। একেক গন্তব্যের লঞ্চ থাকে একেক ঘাটে। সিএনজিতে গেলে চালককে সেটা জানাতে হবে। আর নিজেদের গাড়ি থাকলে চালকেরই সেটা জানার কথা।

বুড়িগঙ্গার রূপ ঘাটে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে থাকা চাঁদপুর যাওয়ার যেকোনও লঞ্চে উঠে নিচতলা থেকে টিকিট কাটতে হয়। আমরা চড়েছিলাম এমভি মিতালিতে। এসি কেবিন খালি ছিল না। তাই নন-এসি কাটতে হয়েছে। নন-এসি সিঙ্গেল কেবিন হলে ৫০০ টাকা। একজনের বেশি যতজন ওই কেবিনে থাকবেন, প্রত্যেকের জন্য পৃথক ডেকের টিকিট কাটতে হবে।

লঞ্চ ছাড়লো সকাল সাড়ে ৯টায়। চারপাশে শুধু নদীর জল। এর মধ্যে ভেসে ভেসে চলার অনুভূতি অন্যরকম। নদীর সৌন্দর্য দেখার ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা, গান, লুডু খেলা চললো। সবাই মিলে তিন তলায় লঞ্চের একেবারে উঁচুতে উঠে সেলফিতে মেতে উঠলাম। গন্তব্যে আসার ৩০ মিনিট আগে কেবিনের চাবি ফেরত নেন দায়িত্বরত কর্মী। তবে লঞ্চ নোঙর না ফেলা পর্যন্ত চাইলে কেবিনের ভেতরেই অবস্থান করা যায়।

মেঘনার তীরে পর্যটকরা আমরা চাঁদপুর পৌঁছালাম দুপুর ১টায়। লঞ্চ থেকে আগেভাগে নামতে চাইলে গন্তব্য কাছাকাছি চলে এলে সাইরেন বাজান নাবিক। তখনই মূল ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালে ভালো। লঞ্চ থেকে নামার পরই স্বাগত জানাবে একটি নীলরঙা বিলবোর্ড। তাতে লেখা— ইলিশের বাড়িতে স্বাগতম।

তিন নদীর মোহনা রিকশা কিংবা অটোতে চড়ে তিন নদীর মোহনা দেখতে গেলাম। ফটক দিয়ে ঢুকতেই চোখের সামনে পড়লো ইলিশ মাছের একটি ভাস্কর্য। বড় স্টেশন পার্ক থেকে একসঙ্গে মিলে যাওয়া তিন নদীর মোহনা (মেঘনা, ডাকাতিয়া ও পদ্মা) দেখা যায়। তিন নদীর স্রোত একসঙ্গে মিশে হয়েছে মেঘনা। চাঁদপুর শহরের কাছেই এই নদীতে বেশকিছু চর জেগেছে। বড় স্টেশন ঘাট থেকে ট্রলারে বা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে মাঝ নদীতে গিয়ে ত্রিমোহনার সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি চরে ঘুরতে যাওয়া যায়। কেউ কেউ ট্রলার রিজার্ভ নিয়ে চলে যাচ্ছেন বিভিন্ন চরে। শীতকালে এসব চরে ভিড় থাকে বেশি।

বড় স্টেশন পার্কে ঝালমুড়ি পার্কে দাঁড়িয়ে ভালোভাবে দেখা যায় কীভাবে তিনটি নদী মিশে যাচ্ছে। ত্রিমোহনার জলের রূপ এককথায় চোখজুড়ানো। নদীর পাশে এই জায়গাটা বেশ শীতল। পার্কের চারদিকে বিভিন্ন খাবার বিক্রি হয়। এর মধ্যে আছে ঝালমুড়ি, আমড়া, জাম্বুরা, বেলপুরি, ডাব, বাদাম। শুরুতেই সবাই হাতে নিলাম ঝালমুড়ি। দারুণ স্বাদ। এখনও মুখে লেগে আছে! এরপর আমড়া ও জাম্বুরা ভর্তার স্বাদ নিতে দেরি করলাম না। খাওয়া-দাওয়া শেষে শুরু হলো সেলফি পর্ব।

ইলিশের আড়ত তিন নদীর মোহনা দেখা ও পার্কে ঘোরাঘুরির পর্ব শেষে আমরা গেলাম ইলিশ মাছের আড়তে। ত্রিমোহনা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। হেঁটেই যাওয়া যায়। আমাদের লেগেছে তিন মিনিট। চাঁদপুর রেলস্টেশনের ঠিক উল্টো পাশে। ইলিশের আড়তে ঢোকার পর সবার চোখ তো ছানাবড়া! এর আগে একসঙ্গে এতো ইলিশ দেখিনি আগে। আমার তো মনে হচ্ছিলো, সব মাছ কিনে বাসায় এনে রেখে দিই! যেদিকে তাকাই সেদিকেই ইলিশ। আর লোকে গিজগিজ করছে। মাছে বরফ দেওয়ার পদ্ধতি দেখে সময় কাটলো কিছুক্ষণ। থরে থরে সাজানো বিপুল পরিমাণ ইলিশ। এখানে প্রতিদিন প্রচুর ইলিশ বেচাকেনা হয়। দরদাম করে কেনাই ভালো। আড়তের সামনে মাঝারি আকারের বিলবোর্ডে নদীর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতামূলক কয়েকটি বার্তা দেখলাম। যেমন— জাটকা মাছ (১০ ইঞ্চি পর্যন্ত) ধরা নিষেধ, ডিম ছাড়ার ডিমওয়ালা মাছ ধরা নিষিদ্ধ, কারেন্ট জাল, বেহুন্দি জাল ও অন্যান্য অবৈধ জাল ব্যবহার করা নিষেধ,   

ইলিশের বাড়িতে সারাবেলা ইলিশ দেখতে দেখতে খাওয়ার লোভ আর সামলাতে পারছিলাম না। তাই আর দেরি না করে আড়ত থেকে বেরিয়ে ঢুকে পড়লাম হোটেলে। হোটেল খুঁজতে বেশিদূর যেতে হলো না। ত্রিমোহনা ও ইলিশের আড়তের আশেপাশে আছে বেশকিছু হোটেল। যেকোনও একটাতে ঢুকে পড়লেই হলো। অবশ্য হোটেলে আসন পেতে একটু অপেক্ষা করতে হতে পারে। আমাদের বেলায় যেমন হয়েছে। কারণ ইলিশ খাওয়ার ধুম লেগেই থাকে এসব হোটেলে। আগে থেকে ভাজা মাছ খাওয়া যায়। কেউ চাইলে আস্ত ইলিশ কিনে এনে হোটেলে দিতে পারেন। বাবুর্চি সামনেই সেটি কেটে ও ধুয়ে ভাজা করে দেন। আমরা ভাজা করে দেওয়া মাছ খেয়েছি। পুরনো ভাজা প্রতি পিস ৮০ টাকা। আর ভাজা করে দেওয়া মাছ প্রতিটি ১০০ টাকা। ভাত আর ডাল যতোটুকু খাবেন সেই অনুযায়ী খরচ হবে। প্রতি প্লেট ভাত ১০ টাকা। সঙ্গে শুকনা মরিচ ভাজা ও লেবু ফ্রি। পানির কথা না বললেই নয়। চাঁদপুরের টিউবওয়েলের পানি খুব শীতল। গরমে সেই পানি লেগেছে শরবতের মতো!

ইলিশের বাড়িতে সারাবেলা চাঁদপুর যাওয়ার আগে অনেকের কাছে শুনেছিলাম একটি আইসক্রিমের কথা। এর নাম ‘ওয়ান মিনিট আইসক্রিম’। দুপুরের খাওয়া শেষে সেই খাবারের সন্ধানে ছুটলাম। তবে রিকশাচালকে বাংলায় বলে বিপাকে পড়তে হয়েছে আমাদের। এক মিনিটের আইসক্রিম কথা শুনে তিনি একটু হেসে বললেন, ‘আপারা, এটা ওয়ান মিনিট আইসক্রিম। এক মিনিট আইসক্রিম বললে তো কেউ চিনবে না।’ ‘ওয়ান মিনিট আইসক্রিম’ বিক্রির দোকানে মানুষের জটলা চোখে পড়ার মতো। দোকানের নামই ওয়ান মিনিট। এটি মূলত মিষ্টির দোকান। তবে আইসক্রিমের চাহিদাই বেশি। প্রতিটির দাম ৮০ টাকা।

মেঘনার তীর আইসক্রিম খেতে খেতে আমরা গেলাম লঞ্চ ঘাটে। এখানেও ঘাটে ঢোকার টিকিট জনপ্রতি ৫ টাকা। ইমাম হাসান লঞ্চের কেবিনের টিকিট কাটলাম। এবার সিঙ্গেল এসি-কেবিন মিলেছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বলে টিকিটের মূল্য ৬০০ টাকা। সঙ্গে প্রত্যেকের জন্য ১০০ টাকা করে ডেকের টিকিট। লঞ্চ চাড়বে সন্ধ্যা ৬টায়। তখনও দুই ঘণ্টা বাকি। তাই সবাই মিলে ফের গেলাম তিন নদীর মোহনার টানে। বড় স্টেশন পার্কের সামনে ‘রক্তধারা’ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে। রক্তের ফোটার মাধ্যমে মানুষের শরীর থেকে রক্ত ঝরার প্রতীকী ফুটে উঠেছে এতে। এই জায়গা মূলত বধ্যভূমি। শহীদদের স্মরণে ২০১০ সালে বিজয় দিবসে এর ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন জেলা প্রশাসক প্রিয়তোষ সাহা। 

ইলিশের বাড়িতে সারাবেলা বিকালের ত্রিমোহনা অবাক হওয়ার মতো। নদীর ঢেউ এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে পাথর। এসব পাথর বসানো হয়েছে নদীভাঙন রোধে। ঘাটে সারি সারি নৌকা আর ট্রলার। এর মধ্যে গোধূলি রঙে তিন নদীর মোহনার সৌন্দর্য উপভোগ করছেন ভ্রমণপিপাসুরা। আমরাও প্রকৃতি দেখার সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছি খাওয়া-দাওয়া ও সেলফি। পশ্চিমমুখী হয়ে সূর্যাস্ত দেখাও ছিল বেশ চমৎকার।


সারাদিনের ভ্রমণের পর আমরা ঢাকায় যখন পা ফেললাম, ঘড়ির কাঁটা তখন রাত সাড়ে ৯টার ঘরে। হিসাব করে দেখলাম, আমাদের প্রত্যেকের চাঁদপুরে ইলিশ খেয়ে ও ঘুরে আসতে লেগেছে ৮০০ টাকা। দল যত ভারী হবে, আনন্দ তত বেশি। খরচও তত কম!

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ