সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে সিমেন্ট ও পাথরের তৈরি ব্লকগুলোর ওপর। বহুদূর থেকে ছুটে আসছে বাতাসের দল। একসময় বইয়ের পাতায় বায়ুবিদ্যুৎ কলের গল্প পড়তাম, এখন সেসবের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। বাতাসের দৌরাত্ম্যে ক্লান্তিহীনভাবে দিনরাত অনবরত ঘুরে চলছে বায়ুবিদ্যুৎ কলের পাখাগুলো।
এবারের ভ্রমণ বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রাম থেকে। যাত্রার দিন কাকভোরে হঠাৎ জাগলাম। চোখ মেলে দেখি ঘড়ির কাঁটায় ভোর ৫টা। তড়িঘড়ি অন্যদেরও ঘুম থেকে জাগালাম। ঝটপট প্রস্তুত হয়ে ভোর সাড়ে ৫টার মধ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। যেতে হবে ফিরিঙ্গী বাজার। সেখান থেকে ট্রলারে চড়ে বায়ুবিদ্যুৎ কলের দ্বীপ কুতুবদিয়ায়।
তখনও ঘুম ভাঙেনি চট্টগ্রাম শহরের। রাস্তাঘাট ফাঁকা। গাড়িও নেই। বহুক্ষণ পর একটা সিএনজি পাওয়া গেলো। রিজার্ভ নিয়ে একটানেই চলে গেলাম ফিরিঙ্গী বাজার। কর্ণফুলী নদীতে দাঁড়িয়ে আছে কুতুবদিয়াগামী ট্রলার। ঘাট থেকে ছোট্ট একটি নৌকায় করে গিয়ে উঠতে হলো ট্রলারে। প্রতিদিন চট্টগ্রাম থেকে কুতুবদিয়া কেবল একটি ট্রলারই যায়।
ঠিক সকাল ৭টায় ট্রলার ছুটে চলা শুরু করলো। নদীর দু’পাশে বহু লাইটার জাহাজ। অল্প কিছুদূর এগোনোর পরেই দেখতে পেলাম বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দুটি সাবমেরিন। ধীরে ধীরে ট্রলারটি কর্ণফুলী নদী ছেড়ে সাগরের দিকে ছুটছে। সাগরের বুকে দাঁড়িয়ে আছে নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ।
এদিকে তাপ ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছে সূয্যিমামা। বাতাস বইছে হালকা। দূরে সমুদ্রের মাঝে কন্টেইনার ভর্তি কয়েকটি জাহাজ চোখে পড়লো। এরই মধ্যে দেখলাম ট্রলারের মধ্যে একজন চা, রুটি, বিস্কুট বিক্রি করছেন। গরম ধূমায়িত চায়ে চুমুক দিতে দিতে সমুদ্র দেখার অনুভূতিই অন্যরকম।
প্রায় তিন ঘণ্টা সমুদ্রপথে চলতে চলতে আমরা কুতুবদিয়ার কাছাকাছি পৌঁছালাম। দূর থেকে এই দ্বীপকে সবুজে আচ্ছাদিত একটি ঢিবি মনে হচ্ছিল। সকাল ১১টার দিকে আমরা নামলাম দরবার ঘাটে। সেখানে টমটম, অটোর মতো অনেক গাড়ি আছে। একটি অটো নিয়ে রওনা হলাম লাইট হাউজের দিকে। সাগরে জাহাজ চলাচলে কুতুবদিয়ার এই লাইট হাউজ অনেক সহায়তা প্রদান করে থাকে।
লাইট হাউজের সীমানা প্রাচীরের মধ্যে বিশাল একটি পুকুর। চারদিকে গাছপালা। দূর থেকে মনে হয় সবুজের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এক পথনির্দেশক।
লাইট হাউজ থেকে বেড়িয়ে চলে গেলাম পাশের বিচে। বিশাল সমুদ্র সৈকত। পুরোপুরি জনশূন্য। ছোট ছোট আকারের ঢেউ ভিজিয়ে দিচ্ছিল আমাদের পা। নরম বালিতে জনশূন্য এই সমুদ্রসৈকত ধরে হেঁটে চললাম আমরা।
পথিমধ্যে দেখলাম লম্বা একটি লেক। এর একপাশে ঝাউবন। অন্যপাশে উঁচু হয়ে থাকা মাটির রাস্তা। কিছুদূর পর দেখা পেলাম শুঁটকিঘরের। কাকড়ার শুঁটকি বানানো হচ্ছে সেখানে। দুপুর ঘনিয়ে এলো ততক্ষণে। আমরা একটি অটো নিয়ে চলে এলাম দরবারে। নানান জায়গা থেকে এখানে লোকজন আসে। ঘুরে ঘুরে দেখলাম পুরো মাজার। পাশেই মাছ দিয়ে খেলাম দুপুরের খাবার।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে এবার শুরু করলাম টমটমযাত্রা। দ্বীপের আঁকাবাঁকা সবুজেঘেরা পথ দিয়ে এগিয়ে চললো সে। সাগরপাড়ের রাস্তা দিয়ে ছুটছি আমরা। দূরে শিশু-কিশোররা ফুটবল খেলায় মত্ত। বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে। কিছু নৌকা মেরামতের জন্য উপুড় করে রাখা আছে বালিতে।
চারপাশ দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম বায়ু বিদ্যুৎকল প্রজেক্টের ওখানে। বায়ুবিদ্যুৎ কলগুলো মূলত দুই জায়গায়। কতগুলো সমুদ্র থেকে একটু দূরে। আর কতগুলো একেবারে সমুদ্রের কাছাকাছি। বিদ্যুৎ কলগুলোকে ভাঙন কিংবা সমুদ্রের ঢেউ থেকে সুরক্ষার জন্য শক্ত করে বাঁধ দেওয়া আছে সামনে।
সমুদ্র থেকে বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল ব্লকগুলোর ওপর। সূর্যও ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। শেষ বিকালের মিষ্টি রোদের আলো মেখে সমুদ্র উপভোগ ছিল অসাধারণ। সবাই মিলে দীর্ঘক্ষণ বসে রইলাম সেখানে। ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করলাম জীবনের ক্লান্তিগুলোকে।
এবার ফেরার পথ ধরতে হবে। সাগরপাড় থেকে রাস্তায় এসে উঠে পড়লাম টমটমে। রাস্তার দু’পাশে লবণ ক্ষেত। লবণ চাষ হয় এই দ্বীপে। চারপাশ দেখতে দেখতে চলে এলাম ঘাটে। ট্রলারে চড়ে সমুদ্রের অংশ পেরিয়ে বিপরীত পাশে গিয়ে উঠতে হবে চট্টগ্রামের বাসে। ট্রলারে উঠতেই সন্ধ্যে নেমে এলো। সমুদ্র থেকে সন্ধ্যের সূর্যটাকে খুব মায়াবী মনে হচ্ছিল। হিম হাওয়ার সঙ্গে কুতুবদিয়া থেকে এগিয়ে চললো ট্রলার।
যেভাবে যাবেন
চট্টগ্রাম থেকে ফিরিঙ্গী বাজার যেতে চাইলে অবশ্যই সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যে রওনা দিতে হবে। প্রতিদিন মাত্র একটি ট্রলারই চট্টগ্রাম থেকে কুতুবদিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ফেরার পথে বড়ঘোপ ঘাট থেকে ট্রলারে করে পার হয়ে চট্টগ্রাম ফেরার জন্য সিএনজি পাওয়া যাবে।
এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে গাড়িতেও যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে চট্টগ্রাম থেকে প্রথমে নতুন ব্রিজ। তারপর বাঁশখালি-মহেশখালি যাওয়ার বাসে চড়ে পেকুয়া নামতে হবে। সেখান থেকে টমটম বা সিএনজিতে করে মগনামা ঘাট। তারপর ট্রলারে করে বড়ঘোপ ঘাট (কুতুবদিয়া দ্বীপ)।