X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শতবর্ষী শিমুলের তলে...

ফারুখ আহমেদ
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১২:৫৮আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:১৯
image

ঘুটঘুটে অন্ধকার পথ ধরে এগিয়ে চলেছি। এমন নির্জন অচেনা পথে রাত দশটার মানে অনেক রাত! ভয় দূর করতে নিজে নিজেই গল্প শুরু করলাম। গল্পে গল্পে হঠাৎ দেখি জোনাকি পোকার উৎসব! ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি পোকা ছুটে চলেছে দিকবিদ্বিক। যেন আকাশ থেকে তারারা নিচে নেমে এসেছে। জোনাকিময় তারাভরা সে পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি সাখুয়া গ্রামে।

ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার ছোট্ট গ্রাম সাখুয়া। ঢাকা থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে গ্রামটি। সারাদেশের সবুজই দিনদিন বিলিন হচ্ছে। সাখুয়া গ্রামও এর বাইরের নয়। এখানকার সবুজ প্রকৃতিকে দিনদিন গ্রাস করেছে ফিসারিজের ব্যবসা, ইটের ভাটা এবং নতুন কিছু ইন্ডাস্ট্রি। এসবের মাঝেও এখানকার সবুজ সত্যিকার অর্থে আমার সোনার বাংলাকে মনে করিয়ে দেয়। এখানকার মেঠোপথ আমাদের সবুজ বাংলার প্রতিচ্ছবি। এসব গল্প এবং শতবর্ষী এক শিমুল গাছের মায়ায় একদিন চলে গেলাম সাখুয়া গ্রামে। সন্ধ্যার এনা বাসে চেপে তিন ঘন্টা পর নামলাম রাঘামারা বাসস্ট্যান্ড, সেখান থেকে রিকশায় সাখুয়ার পথ। রাঘামারা বাজার সেই রাতেও কেমন সরগরম। মূল বাজারের পথটুকু পেরিয়ে আসতেই অন্যরকম পরিবেশ। বোঝা গেল রাস্তার দুপাশেই ধান ক্ষেত। রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম সাখুয়া কতদূর। তার নির্লিপ্ত জবাব একঘন্টা! ভয় সঙ্গে নিয়ে চলা সে একঘন্টার যাত্রা অস্বস্থিকর হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু জোনাকির দল অসম্ভব ভালো লাগায় ভরিয়ে আমাকে সে পথ অতিক্রম করিয়ে সাখুয়া গ্রামে পৌঁছে দিল।

শতবর্ষী  শিমুল গাছ
পরদিন ঘুম ভাঙলো পাখির ডাকে। জানলার ফাঁক গলে দেখি সূর্যোদয়। সে দৃশ্যে ক্যামেরা ক্লিক চলে সমানে। এরমধ্যে রাকিবের ডাক। ডাক্তার আরিফের ছোট ভাই রাকিব। প্রাতরাশ না সেরেই তাকে সঙ্গে নিয়ে বের হলাম। পথে নামতেই মুগ্ধতা। অসাধারণ পিচঢালা পথ। সে পথ রাতের জোনাকির ক্যানভাস সরিয়ে সেজেছে সবুজ রঙের ক্যানভাসে। চারপাশটা তাকিয়ে দেখতে দেখতে ভাবি স্বার্থক জনম মোর জন্মেছি এই দেশে। 

সাখুয়া গ্রাম
পুরো এলাকা জুড়েই ধান চাষ দেখলাম এখানে। সঙ্গে পাখি ডাকা সকালের মনোরম পরিবেশকে সঙ্গী করে নিস্তব্ধ পথ ধরে তরতরিয়ে হেঁটে চললাম। পথ চলি আর ধানের শিষে শিশির বিন্দু দেখি। এরমধ্যে সামনে চলে আসলো ঘুঁটি বানানোর দৃশ্য। চলতি পথে গোবরের ঘুঁটি বানাতে দেখি এক সনাতন নারীকে। সে কবে শেষ দেখেছি মনে পড়লো না। দেখা হল বাবার বয়সী মোসলেম উদ্দিনের সঙ্গে। রাস্তার ধারে বসে ওম নিচ্ছেন সঙ্গে দম নিচ্ছেন আর হুঁকোয় টান দিচ্ছেন। অনেকদিন পর দেখলাম বিশাল চারি, ফেন আর ভুষি দিয়ে গরুর নাস্তা তৈরির দৃশ্য।

সাখুয়া গ্রামের দৃশ্য
হাঁটতে হাঁটতে চলে আসলাম পশ্চিমপাড়া। পশ্চিমপাড়া পা রাখতেই রাকিব আমাকে দূর থেকে দেখায়, ঐ যে শিমুল গাছ! এবার পিচঢালা পথ ছেড়ে রাঙা মাটির পথ ধরি। তারপর ধীর পায়ে শিমুল গাছের কাছে চলে আসি। গাছটির কাছে গিয়ে বিস্ময় আরও বাড়ে। বিশাল শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে শিমুল গাছ। এ যেন ছবির মত সুন্দর প্রকৃতির মাঝে এক সর্বব্যাপী প্রশান্তি। গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকি অপলক, চোখ সরে না। কাছে গিয়ে দাঁড়াই, ছুঁয়ে দেখি। বুকের ভেতরটা কেমন ভালো লাগায় ভরে উঠে।

শতবর্ষী  শিমুল গাছ

পুরো গাছ যেন টিয়া পাখির বাসভবন। তাদের ছোটাছুট আর কাঠ শালিকের কিচিরমিচির যেন অসাধারণ এক সংগীতের সুর তৈরি করলো। এরমধ্যে আমাকে আর হাতে ক্যামেরা দেখে এলাকার শিশু কিশোর আর বয়স্কদের ভিড় জমে উঠেছে। তাদের মতে শিমুল গাছটির বয়স কম করে হলের পাঁচশ বছর হবে! কেউ কেউ বললেন এর বয়স তিন থেকে চারশ বছরের কম নয়। গাছটির বয়স পাঁচশ শুনে আমার মনে দ্বিধা জাগে। সে দ্বিধা বুঝতে পেরে গ্রামের ৯৮ বছর বয়সি মুকফর প্রামাণিক বললেন, ‘আমি জন্মের পর থেকেই গাছটা এই এক রকম দেখে আসছি। ঠিক এক রকমই বড় আর উঁচু। আমার বাবাও একই কথা বলতেন গাছটির ব্যাপারে, শুনেছি বাবার বাবাও তাই বলেছেন। তাছাড়া এই গাছের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অনেক গল্প।’

শতবর্ষী  শিমুল গাছ

গ্রামবাসী জানালেন দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন গাছটি দেখতে। অনেকে মনে করেন বহু প্রাচীন আর বৈচিত্র্যে ভরা শিমুল গাছটির রয়েছে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা! দিনদিন শিমুল গাছের কাছে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তবে কী মানুষ কেবল মানত করতেই আসে গাছের কাছে? গ্রামবাসী জানালেন, ব্যাপারটা একদমই এমন নয়। গাছটি এলাকার একটি উৎসবের উপলক্ষ শুধু। কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষ নয়, গাছ দেখতে আসেন সব ধর্মের মানুষই। ছুটির দিনগুলোতে শিমুলতলা লোকে লোকারণ্য থাকে। অনেকেই জিলাপি, কলা, মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাবার নিয়ে আসেন এখানে, যেগুলো খান এলাকার লোকজনই।

শতবর্ষী  শিমুল গাছ

শিমুল গাছ নিয়ে এখানে কেউ ব্যবসা পেতে বসেনি, এটা দেখে খুব ভালো লাগল। সে ভালো লাগা সঙ্গে নিয়ে যে পথে পশ্চিমপাড়া শিমুল তলায় গিয়েছিলাম, সে পথেই ফিরে এলাম সাখুয়া গ্রামে। তিন দিন ছিলাম সাখুয়া গ্রামে। তিন দিনের প্রতিদিনই গিয়েছি শিমুল গাছের কাছে। গাছের এক কোণে বসে ডাক্তার আরফি, রাকিব আমি কখনও গল্প করেছি, কখনও আবার ছবি তুলেছি। কখনও কখনও গ্রামবাসীর ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের বাড়িতে চা-নাস্তা খেয়েছি। তারপর একদিন চলে এসেছি হইচই আর হুল্লোড়ের শহরে। শুধু ভুলিনি শিমুল গাছের সেই শান্ত রূপ আর সাখুয়া গ্রামের প্রকৃতি ও তার সৌন্দর্যের কথা, সঙ্গে অবশ্যই ঝিঁঝিঁ ডাকা রাতে সেই জোনাকি পোকার দলকে!

সাখুয়া গ্রামের দৃশ্য

প্রয়োজনীয় তথ্য

বসন্তকাল শুরু হয়েছে। শিমুলকে বলা হয় বসন্তের দূত। এই বসন্তে শতবর্ষী শিমুল গাছটি ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে। এখনই সবচেয়ে ভালো সময় শিমুলতলায় বেড়ানোর। গাছ-ফুল দেখা, টিয়া পাখি আর কাঠ শালিকের গান শোনা হবে একসঙ্গে। এই সময় প্রকৃতিও অসাধারণ। শিমুলতলা আর সাখুয়া গ্রাম আপনাকে নিরাশ করবে না।
সাখুয়া গ্রামে যেতে এনা বাসে চড়ে বসুন। আপনাকে নামতে হবে রাঘামারা বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে রিকশায় সাখুয়া ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়ায় গিয়ে যে কাউকে জিঙ্ঘেস করলেই দেখিয়ে দেবে শিমুল গাছটি। সাখুয়া বাজার বা রাঘামারা বাজারে ভালো খাবারের ব্যবস্থা নাই। তবে সাখুয়া ত্রিশাল উপজেলার গ্রাম, ত্রিশালে মোটামুটি মানের খাবার পাবেন। ফেরার পথে ত্রিশাল জাতীয় কবির স্মৃতিগুলোও হাতড়ে আসবেন। তারপর ত্রিশাল থেকে লোকাল বাসে ঢাকায় ফেরত অথবা একঘন্টার পথ পেছনে ময়মনসিংহ গিয়ে আবার এনা বাসে সরাসরি ঢাকায়।

ছবি: লেখক

/এনএ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
নির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
শনিবার জাতীয় পার্টির বর্ধিত সভানির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ