X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টাইগার্স নেস্ট: পাহাড় চূড়ার বিস্ময়

নওরিন আক্তার
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২১:৩৫আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২১:৩৫
image

পারো শহর ঘুরতে আসা অসম্পূর্ণ যদি কেউ টাইগার্স নেস্ট না দেখে- এমনটা বারবারই শুনছিলাম স্থানীয়দের কাছ থেকে। শান্ত, সুন্দর সাজানো গোছানো ভুটানের পারো শহর। এই শহরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ টাইগার্স নেস্ট মিস করতে চাইলাম না আমরা কেউই। পারো শহর থেকে প্রায় ৯০০ মিটার উঁচুতে টাইগার্স নেস্ট। নামের সঙ্গে বাঘ থাকলেও ধারেকাছে বাঘের টিকিটাও মিলবে না। এটি একটি মনেস্ট্রি। স্থানীয়রা টাইগার্স নেস্টকে তাক্তসাং বলে থাকে। শুরু হলো ট্রেকিং
মেঘলা আবহাওয়া সেদিন। টিপটিপ বৃষ্টিও পড়ছে। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা টাইগার্স নেস্ট দেখতে চাইলে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা ট্রেকিং করতে হবে। দেরি না করে তাই সকাল সকালই রওনা দিলাম। সকাল নয়টায় পৌঁছে দেখি কেডস-শর্টস পরে কেতাদুরস্ত হয়ে বহু পর্যটক হাজির পাহাড় চূড়ায় ওঠার জন্য। এদিকে আগের দিনের বৃষ্টিতে আমার কেডস ভিজে কাহিল। ফলে দুই ফিতার স্যান্ডেল আর বাঁশই সম্বল। আমার এহেন অবস্থা দেখে আড়চোখে তাকিয়ে বেশ কিছু টুরিস্ট মুখ ফিরিয়ে হাসলো টের পেলাম। কয়েকজন ঘোড়ার মালিক বলার চেষ্টা করলো স্যান্ডেল পরে এই পিচ্ছিল রাস্তায় ওঠা অসম্ভব। এই বলে বুঝিয়ে সুজিয়ে ঘোড়া গছিয়ে দেওয়ার দুর্দান্ত প্রচেষ্টা চালালো তারা। সবার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে ও সবার টিপ্পনীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমি শুরু করলাম টাইগার্স নেস্ট দেখার যাত্রা।

টানা বৃষ্টিতে পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ

আগের পাঁচদিন টানা বৃষ্টি হয়েছে। ফলে পাহাড়ি রাস্তা ভয়ংকর রকম পিচ্ছিল হয়ে আছে। তার উপর ঘোড়া চলাচলের কারণে একেবারে বাজে ধরনের কর্দমাক্ত রাস্তা। পা টিপে টিপে এগিয়ে চলেছি আমরা। ট্রেকিং এর অভিজ্ঞতা থাকার কারণে খুব বেশি ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না। তবে প্রচণ্ড মেঘ বলে দূরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেখা পাচ্ছি না- এটাই আফসোস। নিচ থেকেই নাকি পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট টাইগার’স নেস্ট দেখা যায়। অথচ মেঘের ঘনঘটার ফলে আমি এক হাত সামনের জিনিসই দেখতে পাচ্ছি না!

মেঘ ও সবুজের সঙ্গে পথচলা
কিছুদূর যাওয়ার পরই ঘোড়ার পাল নিয়ে এগিয়ে এল স্থানীয় এক অধিবাসী। তিনি জানালেন, সামনের রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী। মানুষ তো মানুষ, ঘোড়া নিজেই আছাড় খেয়ে পড়েছে! ফলে তিনি ঘোড়া নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। সামনের রাস্তায় না গিয়ে পেছনের অন্য রাস্তা ধরে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন তিনি। সেই রাস্তা আরও খাঁড়া! কী আর করা। খাড়া রাস্তা দিয়েই এগিয়ে চললাম চূড়ার দিকে।

পাইন বন
পাহাড়ি রাস্তা সবুজে ঢাকা। সঙ্গে মেঘের লুকোচুরি। নাম না জানা কতই না গাছ! সেই গাছের ফাঁক দিয়ে মেঘ এসে উঁকি দিয়েই হারিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত রকম সুন্দর প্রকৃতি এখানে। কিন্তু টাইগার্স নেস্টের নাগাল তো আর পাই না! প্রায় দেড় ঘণ্টা পর দেখলাম যাত্রা শুরুর সময়ে আমার স্যান্ডেল জোড়া দেখে ব্যঙ্গ করা এক দম্পতি রনে ভঙ্গ দিয়ে ফিরতি পথ ধরেছেন। মিনমিন করে তারা জানালেন উপরে যাওয়া সম্ভব নয়, কারণ এখনও নাকি অর্ধেক পথই শেষ হয়নি!

কোথাও সমতল, কোথাও পাহাড়
আরও কিছুদূর যাওয়ার পর পানির পিপাসায় সব অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। পাহাড়ে ওঠার কষ্টটা তখন জেঁকে বসেছে প্রবল তৃষ্ণা হয়ে। কতদূর এসেছি সেটা বোঝারও উপায় নেই মেঘের কারণে। আরেকটু সামনে গিয়ে পেলাম বসে বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা, সঙ্গে পানি পানের ব্যবস্থা। সেই মুহূর্তে চোখের সামনে গোটা টাইগার্স নেস্ট দেখলেও বুঝি এত খুশি হতাম না! বসে বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নতুন করে পথচলা জন্য প্রস্তুত হলাম।  

যেন রূপকথার জঙ্গল!
আবারও সেই খাঁড়া রাস্তা। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখি দাঁড়িয়ে আছি রূপকথার মতো এক বনে! জেদিকে চোখ যায় পাইন গাছের সারি। পাইনের ঝিরিঝিরি পাতায় মেঘ জমে আছে কুয়াশার মতো। ঘন জঙ্গলের রাস্তার দিকে তাকালে চমকে উঠতে হয়। ঝরা পাতায় মোড়ানো রাস্তায় যেন পদচিহ্ন পড়েনি এর আগে! সুনসান নিরব পাইনের জঙ্গলে দাঁড়িয়ে মনে হলো ভুল করে বুঝি রূপকথার কোনও রাজ্যে এসে পড়েছি।

হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া রূপকথার রাজ্যে!


পাহাড়ি পথের বেশ কয়েক জায়গায় দেখলাম রঙিন পতাকার মতো কাপড় টাঙিয়ে রাখা। জানলাম এটি তাদের প্রার্থনার একটি অংশ।

মাঝপথে একটি ক্যাফেটেরিয়া রয়েছে। সেখানে কফি আর বিস্কুট খেয়ে ধীরে ধীরে উঠছিলাম পাহাড়ে। আবারও সঙ্গী মেঘ আর সবুজ। ফুঁ দিয়ে কুয়াশার মতো মেঘ সরিয়ে সরিয়ে অজানা সব গাছগাছালির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে করতে কতক্ষণ হেঁটেছি জানি না। হঠাৎ শুনি ঝরনার কুলকুল শব্দ। টাইগার্স নেস্টের একদম কাছে একটি ঝরনা আছে শুনেছিলাম। তবে কী চলে এসেছি গন্তব্যে?

মেঘ সরে বেরিয়ে এল টাইগার্স নেস্ট
ঘাড় ঘুরিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকাতেই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। চোখের সামনে ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করলো ঘন মেঘের দল। মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো ঝকঝকে সোনালি টাইগার্স নেস্ট। আমরা তাকিয়েই থাকলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। যেন মেঘের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এক কল্পনার বাড়ি। বিশাল পাহাড়ের ছোট্ট এক ভাঁজে কীভাবে অপূর্ব সুন্দর এই স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে সেই ১৬৯২ সালে! মেঘেরা সরে গেলেও একেবারে বিদায় নেয়নি। টাইগার্স নেস্টের একপাশে তখন তারা মিটিং করছে। আমরা তখন মেঘকে সঙ্গে নিয়ে যেন হারিয়ে গেছি কল্পনাকেও হার মানানো এক রাজ্যে।

তখনও দূরে টাইগার্স নেস্ট

তবে বাস্তবে ফিরতে হলো তাড়াতাড়িই। টাইগার্স নেস্ট তখনও দূরে। সামনে কেবল সিঁড়ি আর সিঁড়ি। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে হবে। তারপর ঝরনা ও ব্রিজ পাড়ি দিয়ে আবারও উপরে উঠতে হবে। তবেই পাওয়া যাবে টাইগার্স নেস্ট। ভাবলাম এতক্ষণ কঠিন পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়েছি, আর এত সিঁড়ি! তবে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামাও যে ভয়ংকর কঠিন হতে পারে, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। মনে হলো অনন্তকাল চলে যাবে কিন্তু এই সিঁড়ি আর শেষ হবে না!

দীর্ঘ পথ সিঁড়ি বাইতে হবে

আশার কথা, সিঁড়ি শেষ হয়েছিল। আমরা নাগাল পেয়েছিলাম টাইগার্স নেস্ট তথা বাঘের গুহার। ১৬৯২ সালে এই মন্দির প্রথম প্রতিষ্ঠা করা হয় তাক্তসাং গুহার পাশে। ভুটানের ধর্মীয় গুরু পদ্মসম্ভব তিব্বত থেকে বাঘের পিঠে করে এখানে আসেন। তিনি এখানে ৩ বছর, ৩ মাস, ৩ সপ্তাহ, ৩ দিন এবং ৩ ঘণ্টা ধরে ধ্যান করেছিলেন। তারপরই এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় এই বিস্ময়কর মন্দিরের। তবে টাইগার্স নেস্ট নিয়ে প্রচলিত আছে আরও অনেক গল্প। জনশ্রুতি আছে, রাজা ইয়েশে সগিয়ালের স্ত্রী ছিলেন গুরু পদ্মসম্ভবের অনুসারী। তিনি বাঘের রূপ ধরে পদ্মসম্ভবকে নিয়ে আসেন এখানে। তবে সব গল্পেই রয়েছে বাঘের উপস্থিতি।

টাইগার্স নেস্ট
মন্দিরের ভেতর মোবাইল কিংবা ক্যামেরা নেওয়া নিষেধ। ফলে ছবি না তুলে কেবল ঘুরে ঘুরেই দেখতে হয়েছে ভেতরের অংশ। যতই দেখেছি, ততই বিস্মিত হয়েছি। পাথর কেটে বানানো টাইগার্স নেস্টের ভেতরে রয়েছে চারটি মূল মন্দির। দেয়ালে রয়েছে পেইন্টিং। মন্দিরের প্রতিটি কোণে আভিজাত্যের ছাপ। মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয় পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকে এই অসম্ভব সুন্দর স্থাপনাকে।

টাইগার্স নেস্ট
মন্দির থেকে বের হয়ে ব্যালকনিতে আসা মাত্র আরেকবার স্তম্ভিত হতে হলো। সামনে পারো শহর দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে। তখন সদ্য মেঘ ভাঙ্গা শেষ বিকেলের রোদ। সেই সোনালি রোদে ঝলমল করছে পুরো পারো শহর। মেঘেরা দলবেঁধে দৌড়ে বেড়াচ্ছে সবুজ পাহাড় আর ঝকঝকে রোদ স্পর্শ করে। এই এক জীবনে কত সৌন্দর্যই না দেখা বাকি ছিল!

টাইগার্স নেস্ট থেকে পারো শহর
খুব বেশিক্ষণ সেই সৌন্দর্য দেখা সম্ভব হলো না। সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে শহরে। আবারও শুরু হলো পাহাড়ি পথের সঙ্গে পথচলা। নেমে আসতে খুব বেশি সময় লাগলো না। নিচে এসে দেখি পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে বিস্ময়কর ‘ছোট্ট’ টাইগার্স নেস্ট!

ফিরতি পথে
প্রয়োজনীয় তথ্য
ভুটান যেতে পারেন বাই রোডে। ভারতের ট্রানজিট ব্যবহার করে যেতে হবে ভুটান। চ্যাংড়াবান্ধা বর্ডার পাড়ি দিয়ে জয়গাঁ বর্ডার হয়ে ঢুকতে হবে ভুটানে। ভুটানের ফুন্টসোলিং থেকে পারো যেতে সময় লাগবে প্রায় আট ঘণ্টা। পারোতে যেকোনও ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললেই আপনাকে নিয়ে যাবে টাইগার্স নেস্ট ট্রেকিং রাস্তায়। চাইলে ঘোড়া দিয়ে অর্ধেক রাস্তা উঠতে পারবেন। তবে হেঁটে উঠলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন পুরোপুরি। টাইগার্স নেস্টে ঢুকতে হলে ৫০০ রুপি খরচ করে টিকিট কিনতে হবে। পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দেওয়ার জন্য কেডস অথবা রবারের ফিতাওয়ালা জুতা পরুন। টিশার্ট ধরনের পোশাকই আরামদায়ক হবে। সম্ভব হলে সঙ্গে এক বোতল পানি রাখুন।  

দূরে দেখা যায় ছোট্ট টাইগার্স নেস্ট!

/এনএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা