X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

নীল সবুজের টাঙ্গুয়ার হাওর

আশরাফুল আযম খান
১৫ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:১৫আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:৩১
image

শেষ কবে বুক ভরে খোলা আকাশের নিচে নিঃশ্বাস নিয়েছি মনে নেই। ভুলে গেছি জোছনা রাতে হাস্নাহেনার মায়াময় ঘ্রাণ। এ শহরে নাগরিক শৃঙ্খলের বেড়িতে বাঁধা আমাদের সময়। তাই এবার পূজার ছুটিতে সপরিবারে ছুটে গিয়েছিলাম টাঙ্গুয়ার হাওর দেখতে।

টাঙ্গুয়ার হাওর

সুনামগঞ্জ শহর থেকে ৩৭ কিলোমিটার দক্ষিণে ভারতের সীমান্তঘেরা তাহিরপুর আর ধর্মপাশা উপজেলার একশ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে এ হাওরের অবস্থান। ঢাকা থেকে সকালে রওনা দিয়ে বৃষ্টির কারণে একটু দেরিতে পৌঁছলাম তাহিরপুর উপজেলা সদরের একটি হোটেলে। রাতে হাওরের তাজা বোয়াল মাছের ঝোল দিয়ে স্থানীয় জাতের চালের ভাত খাওয়ার স্বাদ ভুলবার নয়। হাওরে নাও ভাসাতে হলে পরের দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে। ছুটিতে অনেকে এসেছেন হাওর দেখতে । তাই নাওয়ের সংকট। পরের দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে আগেভাগে গেলাম ঘাটে। ছোট-বড় মিলে কেবল চার-পাঁচখানা নৌকা ভাসছে ঘাটে। আমাদের আগেই অনেকে নৌকা নিয়ে ভাসান দিয়েছে হাওরের জলে। একটি যন্ত্রচালিত নৌকা নিয়ে আমরাও ঘাট ছাড়লাম টাঙ্গুয়ার উদ্দেশে। সাথে নৌকার তিন মাঝি আর আমরা সাত জন। সশব্দে দুলতে দুলতে নৌকা যেতে থাকলো সংকীর্ণ জলপথ ধরে। কিছু সময়ের মধ্যে এই সংকীর্ণ জলপথ মিশে গেল বিস্তীর্ণ জলরাশিতে। মাঝি জানালেন মূল হাওর যেতে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।

টাঙ্গুয়ার হাওর

মাঝির এ কথায় আমরা সকলে রোমাঞ্চিত বোধ করলাম এই ভেবে যে, এ জলের রাজ্য কতটা বিস্তৃত! মূল হাওরে যাওয়ার আগেই আমরা কোনও কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মাঝিদের যিনি প্রধান তার বয়স আটত্রিশ কি চল্লিশ বছর। তিনি জানালেন, নৌকা চালানো ও মাছ ধরাই এ এলাকার মানুষের প্রধান জীবিকা। এবার বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে সব ধান। ফলে দুইবেলা খাবার জুটছে না তাদের। মাঝি বললেন, ‘স্যার হাওরের যে জল দেখতে এসেছেন, এ জলে আমাদের সকলের কান্নার জল মিশে আছে।’ বেদনায় আর্দ্র হয়ে গেল হৃদয়। এমন সময় আরেক মাঝি আমাদের সচকিত করে বললেন, ‘স্যার আমরা টাঙ্গুয়া এসে গেছি।’

টাঙ্গুয়ার ওয়াচ টাওয়ার

টাঙ্গুয়ার সীমানাজুড়ে অসীম জলরাশি। তখন সূর্য প্রায় মাথার ওপর এসে দাঁড়িয়েছে। সূর্যের আলো এসে পড়েছে টাঙ্গুয়ার নীল জলে। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম হাওরের জলের ভাঁজে ভাঁজে আলোর নাচন। আলো আর জলতরঙ্গের লুকোচুরি খেলা।পুরো আকাশটা যেন নুয়ে পড়েছে হাওরের ওপর। আকাশের নীল আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে হাওরের রূপ। ভেতরে আবার যেন এক গভীর বিষাদ। বজরা এগোতে থাকলে চোখে পড়লো বিস্তৃত জলরাশির নিঃশব্দতা ভেদ করে ডেকে উঠছে সারস। দলবেঁধে ভেসে বেড়াচ্ছে পিঙল হাঁস। পানকৌড়ি আর হাঁসেরা মিলে যেন ডুব খেলার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে কিছু সময়ের জন্য। যেদিকে চোখ যায় পানি আর পানি। দেখলাম, এই জলের স্বাধীন রাজ্যে অবাধ লুকোচুরি ডাহুক, বালিহাঁস, গাংচিল, বক, বৈদের আর কালেমের মতো কত অসংখ্য পাখপাখালির।

টেকেরঘাট
এ জলরাজ্যের কোন উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম বোঝা ভার। দিগন্তে চোখ মেললে দেখা যাবে, দিগন্তের শেষে কোথাও কোথাও সে অপার জলরাশির পায়ে বেড়ি পাড়িয়েছে সবুজ প্রকৃতি। ধু ধু জলের মাঠে কোথাও কোথাও দল বেঁধে কোথাও বা একা নীল জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট হিজল করচ। কোথাও ঢেউয়ে লুটোপুটি খাচ্ছে নল খাগড়া, দুধিলতা, শোলা, হেলেঞ্চা, স্বর্ণলতা আর নীল শাপলা। দূর হতে আসা দুরন্ত শীতল বাতাস পরম মমতায় তাদের গায়ে যেন আদরের পরশ লাগিয়ে ছুটে চলছে অজানা দেশে। এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে স্বপ্নের আবিষ্টতা নেমে এলো চোখে। চলতে চলতে চোখে পড়লো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেঘালয়ের খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ের হাতছানি। পাথরের গায়ে ঘন সবুজের অবাধ রাজত্ব। বিস্তীর্ণ পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা মেঘ দেখে মনে হলো পাহাড় আর মেঘের মধ্যে গভীর প্রণয় জমে উঠেছে যেন।

জাদুকাটা নদী

হাওরের এই প্রকৃতি হাজার বছর ধরে সে অঞ্চলের মানুষকে ভাবুক বানিয়েছে, কবি বানিয়েছে, বানিয়েছে গায়ক-সাধক। রাধা রমন, হাছন রাজা, শাহ আব্দুল করিম এই এলাকারই সন্তান।

বিশাল সুন্দরের স্রোতে ভাসতে ভাসতে আমরা এগোতে থাকলাম খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়সংলগ্ন টেকেরঘাটে। টাঙ্গুয়ার হাওরের মূল পয়েন্ট ওয়াচ টাওয়ার থেকে টেকের ঘাটে পৌঁছতে আমাদের সময় লাগলো প্রায় দেড় ঘণ্টা। টেকেরঘাটে এসে চোখে পড়লো এ এলাকার মানুষের জীবনপ্রবাহ। কেউ কেউ ছোট ডিঙি ভাসিয়ে ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে  মাছ ধরছে, ছোট ছোট নৌকায় ভারতীয় সীমান্ত থেকে কেউ কয়লা বোঝাই বস্তা এনে হাওরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বড় মালবাহী বজরায় তুলছে। কারো নাওয়ে লাল বালি।

টেকেরঘাটের সবুজ পাড়ে পৌঁছে কিছু পথ পায়ে হেঁটে সামনে যেতে চোখে পড়লো নীলাদ্রির চারপাশের সবুজ চাদরের বিছানা। নীলাদ্রির নিশ্চল নীল জলরাশি। এই কৃত্রিম লেকটি তৈরি হয়েছে পাহাড় কেটে চুনা মাটি আর চুনা পাথর খনন করতে গিয়ে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে এর পাড়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ। শ্যাওলা জমে স্মৃতিস্তম্ভে প্রকাশ পেয়েছে অবহেলার স্মৃতিও। নীলাদ্রি লেকের নীল জলেও যেন খুঁজে পাওয়া যায় অজানা বিষাদ। পুরাতন দিনের পরিত্যক্ত রেল লাইন, জীর্ণ বগি যেন জীবনের হারানো সুরকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

বারিক্কা টিলার উপর থেকে জাদুকাটা নদী

এবার বারিক্কা টিলায় যাওয়ার পালা। এখানে যাওয়ার একমাত্র বাহন স্থানীয় মোটর বাইক। বাইকারের পেছনে উঠে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে আধা ঘণ্টার কম সময়ে গেলাম বারেক্কা টিলার পাদদেশে। টিলার মাথায় ওঠার সাথে সাথে চারপাশের সমস্ত প্রকৃতি যেন মেলে ধরলো আরেক মোহনীয় রূপ। টিলার ওপারে মেঘালয়ের সুউচ্চ সবুজ পাহাড়, নিচে সর্পিলাকার জাদুকাটা নদী। এখানে যতক্ষণ থাকা যায় ততক্ষণ নদীর স্বচ্ছ পানির সঙ্গে লাল বালু আর পাহাড়ের অমিত প্রেমের মুগ্ধতা আবিষ্ট করে রাখে।

জাদুকাটা নদীর স্বচ্ছ পানি আর নীল আকাশের নিচের দু'ধারের সবুজ পাহাড় দেখে যেন মনে হলো এক শক্তিমান শিল্পীর নীলাভ চিত্রকর্ম এটি। দেখা গেল জাদুকাটার বুকে অসংখ্য ডিঙ্গি নৌকার চলাচল। মূল্যবান শুভ্র নুড়ি, লাল বালি আর কালো কয়লার মতো রত্নসম্ভার রয়েছে এ নদীর তলে।

টেকেরঘাট থেকে এবার আরেক রূপরাজ্যের জলপথ ধরে রাতের আশ্রয়ের জন্য ফেরার পালা। পরদিন সুনামগঞ্জে ফিরে বন্ধুসান্নিধ্য আর হাছন রাজার জাদুঘর দেখে সড়ক পথে ফিরতেই হলো ইট পাথরের শহর ঢাকায়। এই শহরেও একদা জল ছিল, ছিল বাঁধভাঙ্গা পূর্ণিমার চাঁদ। অনেক দিন হলো নিয়ন আলো এসে সে পূর্ণিমাকে করেছে শহরছাড়া। তাই সন্ধ্যা নামলে এ শহরের সব বন্ধ্যা গলিতে নামে গাঢ় অন্ধকার। টাঙ্গুয়া হাওর ঘুরে এসে এই নাগরিক অন্ধকারেই আমি খুঁজে ফিরি সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। 

লেখক: শিক্ষক, কলামিস্ট এবং টিভি উপস্থাপক

/এনএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পদ্মশ্রী পাওয়া শিল্পী এখন দিনমজুর!
পদ্মশ্রী পাওয়া শিল্পী এখন দিনমজুর!
সিলেটে এয়ার অ্যাস্ট্রার বিজনেস পার্টনার মিট
সিলেটে এয়ার অ্যাস্ট্রার বিজনেস পার্টনার মিট
ডি মারিয়ার সঙ্গে চুক্তির গুঞ্জনে যা বললেন মায়ামি কোচ
ডি মারিয়ার সঙ্গে চুক্তির গুঞ্জনে যা বললেন মায়ামি কোচ
রাজশাহীতে হাসান আজিজুল হক সাহিত্য উৎসব, পদক পাচ্ছেন ৬ জন
রাজশাহীতে হাসান আজিজুল হক সাহিত্য উৎসব, পদক পাচ্ছেন ৬ জন
সর্বাধিক পঠিত
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি সরকারি কর্মচারীদের
নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি সরকারি কর্মচারীদের
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
মুক্তির পর থেকেই মামুনুল হককে ঘিরে অনুসারীদের ভিড়
মুক্তির পর থেকেই মামুনুল হককে ঘিরে অনুসারীদের ভিড়