X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রহস্যময় পাতালকালী

সাহিল আরমান
০২ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:০০আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:৪৪
image

ভাবুন তো, আপনি এমন এক জায়গায় পা টিপে টিপে এগুচ্ছেন যেখানে প্রতি মুহূর্তে অজানা সব শঙ্কা ওঁত পেতে আছে! ভর দুপুরেও গা ছমছমে চাপ চাপ আঁধারে ছেয়ে থাকে যে জায়গা। যেখানে ভালুক থাকে ঘাপটি মেরে আর শজারুর হেঁটে চলে ঝোপঝাড় ভেঙে। শত বছরের পুরনো কালীমূর্তি উল্টো হয়ে পড়ে থাকে এখানে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এই জায়গা সম্পর্কে খুব কম তথ্যই রয়েছে জনসাধারণের কাছে। জায়গাটির নাম পাতালখালী। সীতাকুণ্ডের গহীনে এর অবস্থান। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনুমতি ও সাহস নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রহস্যময় পাতালকালীতে।

শুরু হলো ট্রেইল



কিশোর ভাই ঢাকা থেকে ফোন করে জানালো সীতাকুণ্ড আসবে পাতালকালী ট্রেইল দেখতে। গত তিন বছর অপেক্ষা করেছিলাম এখানে যাওয়ার জন্য। ওয়াইল্ড অ্যাডভেঞ্চার দলের বন্ধুসহ কিশোর ভাই শেষ পর্যন্ত আসছেন গা ছমছম পাতালকালীতে। দুর্গম পথ ও স্থানীয় ঝামেলার কারণে অনেকেই ঐ পথ মাড়াতে চান না। কিন্তু ওয়াইল্ড অ্যাডভেঞ্চার মানেই বন্য ও রোমাঞ্চকর কিছু। মনে মনে জাগল শিহরণ। বন বিভাগকে জানানো হয়ে গেছে এর মধ্যেই।
সকালে চট্টগ্রাম থেকে ১০ বন্ধু রওনা দিলাম সীতাকুণ্ডের উদ্দেশ্যে। ঢাকার টিম ততক্ষণে সীতাকুণ্ড বাজার পৌঁছে গেছে। আমরা পৌঁছে নাস্তা শেষ করেই রওনা হলাম সীতাকুণ্ড বন বিভাগের বিট অফিসের দিকে। সবাই বিট অফিসে কাঁধের ভারি ব্যাগ হালকা করে রওনা হলো চন্দ্রনাথ মন্দিরের দিকে।

পুরোহিত শিমুল
চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩৭ কিমি উত্তরে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে সাড়ে ৩ কিমি পূর্বে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের অবস্থান। সর্বোচ্চ চূড়ার উচ্চতা ৩৬৫ মিটার। পৌরাণিক স্মৃতিবিজড়িত অসংখ্য মঠ-মন্দির রয়েছে এই পাহাড়ে। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসে শিবচতুর্দশী মেলা হয় এখানে। দেশ-বিদেশের অনেক সাধু-সন্ন্যাসী আসেন মেলায়। প্রচলিত আছে, নেপালের এক রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে পৃথিবীর পাঁচ কোণে পাঁচটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন। এর মধ্যে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের শিবমন্দির অন্যতম। ধর্মগ্রন্থ ও ইতিহাস মতে, এখানে মহামুনি ভার্গব বসবাস করতেন। অযোদ্ধার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র তার বনবাসের সময় এখানে এসেছিলেন। তারা আসবেন জানতে পেরে মহামুনি ভার্গব এখানে স্নানের জন্য তিনটি কুণ্ড সৃষ্টি করেন। এরপর রামচন্দ্রের স্ত্রী সীতা এই কুণ্ডে স্নান করেন। এরপর থেকেই স্থানের নামকরণ করা হয় সীতাকুণ্ড। যেটিতে রাম স্নান করেছিলেন সেটির নামকরণ করা হয় রামকুণ্ড। তবে বর্তমানে কুণ্ডগুলো শুকিয়ে গেছে। ইটের দেয়াল দিয়ে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে স্থানগুলোকে। চন্দ্রনাথ মন্দিরের পাদদেশে রয়েছে উল্টা পাতালকালী মন্দির, ক্রমধেশ্বরী কালী মন্দির, ভোলানন্দগিরি সেবাশ্রম, কাছারি বাড়ি, গিরিশ ধর্মশালা, বিবেকানন্দ স্মৃতি পঞ্চবটি, মহাশ্মশানভবানী মন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দিরসহ আরও অনেক সনাতনী স্থাপনা। চন্দ্রনাথ মন্দিরে যাওয়ার পথে ব্যাসকুণ্ডের পশ্চিম পাড়ে এবং ভৈরব মন্দিরের বাম পাশে একটি বিশাল বটবৃক্ষ আছে। এটি অক্ষয় বট নামে পরিচিত।

শিবলিঙ্গ
লিমন তার কলেজ বন্ধু শিমুলকে আনতে মন্দিরে চলে গেল। উনি চন্দ্রনাথ মন্দিরের পুরোহিত এবং পাতালকালী ট্রেইল একেবারে মুখস্ত তার। লেবু বাগানের ভেতর দিয়ে ট্রেইল শুরু হলো। গরমের মধ্যে মিনিট বিশেক পাহাড়ের চড়াই উঠা-নামা করার পর বেশ কয়েকজন ভাবতে বাধ্য হলো যে সামনে এগুনো বুঝি আর ঠিক হবে না! কারণ মাত্র ট্রেইল শুরু, হাঁটতে হবে এইভাবে আরও ঘণ্টা তিনেক। একজন আর একজনকে সাহস দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে তানবির ভাই ঘোষণা দিলেন তার হার্টে ৪০% ব্লক! এই কথা শুনে সবাই ঘাবড়ে গেলাম। কিছুদূর এগিয়ে সুবিধেজনক স্থানে গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম উনার জন্য। পুরোহিত শিমুলের হাতে একহাত লম্বা শিঙ্গা। কিছুক্ষণ পরপর তিনি এগিয়ে শিঙ্গায় ফুঁক দিয়ে পুরো পাহাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে পুরোহিতের সঙ্গে ৫ জন বেশ অনেকটুকু সামনে এগিয়ে গেল। আমরা বাকি লোকজন  ট্রেইলের শেষ মাথায় এসে পথ ভুলে পাহাড় থেকে বামে না নেমে ডানে ঝিরি পথে নেমে রাস্তা হারিয়ে বসে রইলাম। পুরোহিত অজানা স্থান থেকে শিঙ্গায় ফুঁক দেন আর আমরা ঝিরি পথে বসে বাঁশিতে ফুঁক দিই। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। আধা ঘণ্টা পর যা থাকে কপালে এই ভেবে ঝিরি পথে হাঁটা দিলাম সবাই। অবশেষে দেখা মিললো পাতালকালী মন্দিরের এবং হারিয়ে ফেলা বন্ধুদের।

উল্টা কালী
এখানে এসে রহস্যময় বিভিন্ন স্থাপনার দেখা মিলল। দেখলাম বিশাল বড় একটি পাথর, সবুজাভ শ্যাওলা পড়া থাকা এই পাথর হচ্ছে ‘শিবলিঙ্গ।’ একটু দূরে গেলেই চোখে পড়বে কালো পাথর। ছাউনি দিয়ে ঢেকে রাখা এই পাথরকে স্থানীয়রা বলেন ‘উল্টা কালী।’ ঘুরে ফিরে অনেক কিছুই দেখলাম। শম্ভুনাথ মন্দিরের উত্তর পাশে অন্নপূর্ণা ও বিষ্ণু মন্দির অবস্থিত। এখানে প্রতিদিন পূজা হয়। এই রাস্তায় রয়েছে বিশাল একটি শিলাখণ্ড। একে ছত্রশিলা বা সরস্বতী শিলা বলা হয়। বিরুপাক্ষ মন্দির থেকে চন্দ্রনাথ মন্দিরের দূরত্ব প্রায় আধা মাইল। এটি ভগবান শিবের প্রধান মন্দির। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তেরশ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই মন্দিরে পূজা চলে প্রতিদিনই। শম্ভুনাথ মন্দির থেকে সামান্য পূর্ব দিকে গেলে চন্দ্রনাথ মন্দিরে যাওয়ার পথে বাম পাশে ৩০/৪০টির মতো সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে নামলে গয়াক্ষেত্র দেখা যায়। এখানে একটি কুণ্ডের মতো রয়েছে। শম্ভুনাথ মন্দিরের কাছাকাছি সীতা মন্দিরের সামনে রয়েছে হনুমান মন্দির। বিরুপাক্ষ মন্দির থেকে চন্দ্রনাথ মন্দিরের দিকে যাওয়ার পথে রাস্তার পূর্ব দিকে আধা মাইলের মতো নিচে গেলে দেখা মিলবে পাতালপুরীর। এখানেই পাতালকালী, হর গৌরি, মন্দাকিনী, অষ্টবসু, গোপেশ্বর শিবসহ অন্যান্য দেব-দেবী রয়েছেন। তবে বিপজ্জনক হওয়ার কারণে জনসাধারণ এ পথ মাড়ান না। পরতে পরতে রহস্য ছিটিয়ে থাকা পাতালকালীর খুব সামান্যই আমরা দেখার সুযোগ পেলাম।

বাউয়াছড়া লেকের পাড়ে তাঁবু



এক ঘণ্টা রেস্ট নিয়ে আবার রওনা দিলাম ফিরতি পথের, এইবার গন্তব্য ছোট কমলদহের বাউয়াছড়া লেকের পাড়।
একদিন আগেই এলাকার ইউপি মেম্বার এবং তার ভাতিজা রিয়াজকে জানানো হয়েছিলো আমাদের আগমন সম্পর্কে, স্থানীয় সহযোগিতার জন্য। শেষ বিকেলে সবাই ড্রাইভার হোটেলে ভরপেট খেয়ে রওনা দিলাম ক্যাম্পিংয়ের জন্য। লেকের স্বচ্ছ টইটুম্বুর পানি দেখে ট্রেইলের কষ্ট ভুলে সবাই লাফিয়ে পড়লো। তাঁবু টাঙানোর পরও কেউ ভেতরে যেতে আগ্রহী নয়। সবাই লেকের পানিতে পা ডুবিয়ে চাঁদের আলোয় আকাশের তারা গোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

লেকের স্বচ্ছ পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দলের সদস্যরা
সঙ্গীতের আসর বসলো ব্রিজের উপর। বাংলা ছবি থেকে শুরু করে হিন্দি, উর্দু, ফার্সি, ইংরেজি সুরে-বেসুরে গান চললো রাত দুটা পর্যন্ত। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঘুমাতে চলে গেলাম আর এক গ্রুপ তখনও গান গেয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তাঁবুর মধ্যে সুমন ভাই দাঁড়িয়ে গেল। কারণ গানের দল রবীন্দ্রসঙ্গীত হিসাবে আমার সোনার বাংলা গান ধরেছে। উনার ইচ্ছে ওদের সামনে গিয়ে স্যালুট দিয়ে আসবে, বহু কষ্টে উনাকে থামালাম।
পরদিন সকালে গরম গরম খিচুরি খেয়ে সবাই রওনা দিলাম হরিণাকুণ্ড আর হাঁটুভাঙ্গা ঝরনা দেখতে। ঝরনার পানিতে ঘণ্টা দুয়েক ভিজে আবার লেকে ফিরে এসে আরও ঘণ্টা দুয়েক ডুব সাঁতার প্রতিযোগিতা চললো। দুপুরে ক্যাম্প সাইড গুছিয়ে, সকল ফেলে দেয়া পলিথিন এবং প্যাকেট এক করে বাজারে নিয়ে ডাস্টবিনে রেখে খেতে বসলাম। ঢাকার বাস আসতে তখনও ঢের দেরি। হোটেল থেকে বের হয়ে কমিউনিটি হাসপাতালের পুকুরপাড়ে বসে আড্ডা চললো সন্ধ্যা পর্যন্ত। ঢাকার বন্ধুদের বিদায় দিয়ে চট্টগ্রামের পথ ধরলাম আমরা। সাথে করে নিয়ে এলাম অসাধারণ এক ট্রেইল আর ক্যাম্পিংয়ের সুখ স্মৃতি।
সতর্কতা

  • পাতালকালী ট্রেইল খুবই দুর্গম। প্রয়োজনীয় শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে তবেই যাবেন।
  • বন বিভাগ কিংবা সংশ্লিষ্টের অনুমতি সাপেক্ষে যেতে পারবেন এখানে।
  • সঙ্গে স্থানীয় কাউকে নেবেন গাইড হিসেবে।
  • যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা কিংবা অপচনশীল কিছু ফেলে আসবেন না।
  • বন্যপ্রাণীদের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবেন না।

ছবি: ওয়াইল্ড অ্যাডভেঞ্চার

/এনএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিএনপি গণতন্ত্রে অকার্যকর ডামি রাজনৈতিক দল: ওবায়দুল কাদের
বিএনপি গণতন্ত্রে অকার্যকর ডামি রাজনৈতিক দল: ওবায়দুল কাদের
চারতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মাদ্রাসাছাত্রীর মৃত্যু
চারতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মাদ্রাসাছাত্রীর মৃত্যু
বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী
এবার ঘুমটা ভালো হবে ডু প্লেসির
এবার ঘুমটা ভালো হবে ডু প্লেসির
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী