X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জল-জঙ্গলের নিঝুম দ্বীপে ক্যাম্পিং

নওরিন আক্তার
২০ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:৪৫আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:৫৬
image

মৃদু বাতাসে ঠাণ্ডাটা বেশ টের পাওয়া যায়। হিম হিম ঠাণ্ডায় তাঁবু বাসের বাসনাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো না। তার উপর আকাশে যদি থাকে পূর্ণিমার বিশাল চাঁদ! শীতের কুয়াশা ভেদ করে গড়িয়ে পড়া জোছনায় স্নান করার তীব্র নেশা তখন আমাদের চোখেমুখে। ঘুরতে ঘুরতে দিশা হারিয়ে যায় আমাদের, তাই দলের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বেদিশা ট্যুরিস্টের দল।’ দলের সদস্যরা সবাই নড়েচড়ে বসলো আসন্ন অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। ঢাকা থেকে অনেক অনেক দূরের ছোট্ট নিঝুম দ্বীপে আমরা দুই দিনের বসতি গাড়বো বলে ঠিক করলাম। 

সাগর পাড়ের অস্থায়ী বসত

নিঝুম দ্বীপের জঙ্গলে চলছে হরিন দেখার চেষ্টা    
এক পূর্ণিমার রাতে শহর ছেড়ে পালালাম আমরা ২৬ জনের বিশাল দল। যাত্রা শুরুই হলো টানটান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে। সদর ঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার কথা সাড়ে ৫টায়। সময় প্রায় হয়ে এলো, অথচ দলের দুই সদস্য তখনও এসে পৌঁছায়নি। তীব্র জ্যাম ঠেলার চিন্তাভাবনা জলাঞ্জলি দিয়ে তখন হাদি ভাই আর তামান্না ভাবী আকাশ-পাতাল এক করে ছুটছেন। পাক্কা সাড়ে ৩ কিলোমিটার দৌড়ে এসে লঞ্চে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিশাল সাইরেন বাজিয়ে লঞ্চ ছাড়লো। আমাদের হইচই দেখে কে! এ এক বিশাল প্রাপ্তি যেন। কারণ প্রায় ছয়টা পর্যন্ত দলের সদস্যরা আঁটকে রেখেছিল লঞ্চ! শুরু হলো আমাদের অ্যাডভেঞ্চার। নদীর বুকে ভেসে ভেসে চাঁদ দেখা, হু হু ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে গলা ছেড়ে গান গাওয়া, আধো ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে গরম গরম চা খাওয়া। ভোরে লঞ্চ আমাদের নামিয়ে দিলো হাতিয়ায়। 

নিঝুম দ্বীপের জঙ্গলে
হাতিয়ার তমুরদ্দি ঘাট থেকে ট্রলারে করে রওনা দিলাম নিঝুম দ্বীপ। অ্যাডভেঞ্চার যাদের নেশা, তারা বুঝি চাইলেও সেটাকে ছুঁড়ে ফেলতে পারে না। তা না হলে আমাদের কপালেই কেন পড়বে একজন আনাড়ি মাঝি! ডানে ঘুরতে গেলে সে কীভাবে যেন বামে চলে যায়। আবার সামনের এগুতে এগুতে কখন যেন বালুচরে আঁটকে যায়। সেখান থেকে অন্য ট্রলারের মাঝি এসে উদ্ধার করে। এভাবেই কয়েক ঘণ্টার জার্নিকে টেনে হিঁচড়ে প্রায় দ্বিগুণ করে আমাদের মাঝি শেষ পর্যন্ত আমাদের নামাতে সক্ষম হলো নিঝুম দ্বীপে। নোয়াখালী জেলার বঙ্গোপসাগরের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত কাদা-জল আর লোনা পানির নিস্তব্ধ নিঝুম দ্বীপ। এখানেই জমবে আমাদের পরবর্তী অ্যাডভেঞ্চার।

নিঝুম দ্বীপ

নিঝুম দ্বীপ

নিঝুম দ্বীপের জঙ্গলে
নিঝুম দ্বীপে নেমেই জঙ্গলে জঙ্গলে হরিণ খুঁজে বেড়ানোর অ্যাডভেঞ্চার শুরু হলো আমাদের। গহীন জঙ্গলের মাঝে বাঁশের সাঁকো, শুনশান নিরবতায় পার হয়েছি সেই সাঁকো। যদি হরিণের দেখা পাওয়া যায়! গাছের পাতা নড়েচড়ে, আমরা পা টিপেটিপে এগুই। সামনে থেকে আসা কেউ একজন বলে সামনেই রয়েছে এক পাল হরিণ। আমরা আরও গভীর জঙ্গলে ঢুকি। নাহ! দেখা নেই হরিণের। তখনও কি জানতাম পরদিন সকালে ঘুম ভাঙবে তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হরিণ দেখে! গভীর জঙ্গল থেকে বের হয়ে আসি হরিণ না দেখেই। সাদা বালির বিচে বসে চাঁদের আলোয় স্নান, মুরগি পুড়িয়ে বার-বি-কিউ আর তুমুল আড্ডা চলেছে রাতভর। সকালে তাঁবুর বাইরে হইচই শুনে বের হয়েই তো চক্ষু চড়কগাছ! একটি আস্ত হরিণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাতা খাচ্ছে! জানা গেল এটি পোষা হরিণ। এখানেই ঘোরাঘুরি করে।

নিঝুম দ্বীপে হরিণদর্শন
পরদিন কবিরার চরে আমরা হাজির হই আমাদের অস্থায়ী বসত নিয়ে। সেখানে পৌঁছেই প্লাস্টিক আর অপচনশীল জিনিস খুঁজে বের করলাম সবাই দলবেঁধে। সেগুলো এক জায়গায় জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে শুরু হয় আমাদের অ্যাডভেঞ্চার। দিনভর ক্যাম্পিং, ইলিশ মাছ ভাজি আর সদ্য রান্না করা গরম গরম খিচুড়ি দিয়ে খাওয়া, সাগর জলে পা ভিজিয়ে অজানায় হেঁটে চলা। রোদে পুড়তে পুড়তেই খেয়াল করলাম বদলে যেতে শুরু করেছে বাতাসের গতিবিধি। হিম হিম ঠাণ্ডা নামতে শুরু করেছে আটঘাট বেঁধে। শুরু হলো আমাদের রাত্রিযাপনের তোড়জোড়। ঠিক হলো গভীর জঙ্গলে তাঁবু বিছিয়ে থাকা হবে।

চলছে তাঁবু টাঙানোর প্রস্তুতি

অপচনশীল জিনিসে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল

চলছে লাকড়ি সংগ্রহ

জঙ্গলের মাঝে মোটামুটি একটা ফাঁকা জায়গায় আমরা তাঁবু টাঙালাম। দলের কয়েকজন সদস্য গেল লাকড়ি টোকাতে। ফিরে আসার পর দেখা গেল একজন লাকড়ি খুঁজে বের করার উত্তেজনায় তার সদ্য কেনা মোবাইলখানা জঙ্গলেই ফেলে চলে এসেছেন! আবার দে ছুট জঙ্গলে! চাঁদের আলোয় এবার খোঁজ চলল মোবাইলের!

নিঝুম দ্বীপে ক্যাম্পিং

নিঝুম দ্বীপের সন্ধ্যা
সেদিন রাতটা ছিল রোমাঞ্চে ঠাসা। পূর্ণিমার চাঁদের উপচে পড়া জোছনায় তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। সেই আগুনের লালচে আলো তখন কেওড়া বনজুড়ে। আগুন ঘিরে ছোট ছোট তাঁবু। এক অপার্থিব  সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে আছে শহুরে ছেলেমেয়েগুলো। গভীর রাত তখন একটু একটু করে ভোর হওয়ার পথে। তখনই হঠাৎ ঘটলো ঘটনাটা। একঝাঁক বুনো শেয়ালের চিৎকারে রাতের নীরবতা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। ভয়ার্ত আমরা টর্চ জ্বালিয়ে দেখি জ্বলজ্বলে চোখে বুনো শেয়ালের পাল তাকিয়ে আছে আমাদের দিকেই!

আগুন জ্বালিয়ে চলছে ক্যাম্পিং

চাঁদের আলোয় তাঁবুবাস

ভোর তখন চারটা। ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক তাঁবু। ‘বস্তিবাসী জাগোওওও...’ শাহেদ ভাইয়ের চিৎকারে প্রতিটি তাঁবু থেকে বের হয়ে আসলো বেদিশা ট্যুরিস্টের এক একজন সদস্য। আগুন জ্বালানো কাঠের টুকরা হাতে নিলো। দেখতে দেখতেই পালিয়ে গেল শেয়ালের দল। হাসান ভাই আশ্বস্ত করলেন, ‘ওরা খাবারের খোঁজে এসেছিল, ভয়ের কিছু নেই।’

তাঁবুবাস

রোমাঞ্চে টইটুম্বুর রাত শেষে ভোরের আলো ফুটলো। সেদিন মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। আমাদের তাঁবুতে টাঙানো হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পতাকাটা। হিম হিম বাতাসে পতপত করে উড়তে থাকলো আমাদের প্রিয় পতাকা। সূর্যটা সবে আলো ছড়াতে শুরু করেছে। লাল-সবুজের বাংলাদেশ তখন আমাদের দৃষ্টিজুড়ে। ও আচ্ছা, গল্পটা কিন্তু প্রায় বছরখানেক আগের!

জাতীয় পতাকা উড়ছে তাঁবুতে

প্রয়োজনীয় তথ্য

  • নিঝুম দ্বীপ ঘুরতে যাওয়ার জন্য শীতকালই ভালো। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস নিঝুম দ্বীপ ঘোরার আদর্শ সময়।
  • সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায় ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে যায় হাতিয়ার উদ্দেশে। হাতিয়া পৌঁছাতে সময় লাগবে ১২ ঘণ্টা।
  • তমুরদ্দি ঘাটে নেমেই ট্রলার নিয়ে নিন নিঝুম দ্বীপের জন্য। রিজার্ভ নিলে ভাড়া পড়বে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত। মোক্তারঘাট থেকেও ট্রলার নিতে পারেন। সেজন্য মোটরসাইকেলে যেতে হবে। সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে তারপর যেতে পারবেন নিঝুম দ্বীপ।
  • থাকার জন্য মোটামুটি মানের বেশকিছু হোটেল পাবেন নামার বাজারে। ডরমিটরি রুম রয়েছে থাকার জন্য। সরকারি উপজেলা কমপ্লেক্স অথবা বন বিভাগের বাংলোয় রাত্রিযাপন করতে চাইলে আগে থেকেই অনুমতি নিতে হবে।
  • ক্যাম্পিং করতে পারেন দ্বীপে। সংখ্যায় অনেকজন না হলে মূল দ্বীপের বাইরে ক্যাম্পিং করতে যাবেন না। নিরাপত্তাসংক্রান্ত ঝামেলায় পড়তে পারেন।

পড়ন্ত বিকেলে নিঝুম দ্বীপ

সাবধানতা

  • নিঝুম দ্বীপে অসংখ্য হরিণ ও পাখি রয়েছে। অতিরিক্ত হইচই বা এমন কিছু করবেন না যাতে তারা ভীত হয়ে পড়ে।
  • জঙ্গলে বা দ্বীপে কোনও প্লাস্টিক অথবা অপচনশীল পদার্থ ফেলে আসবেন না। 
  • জঙ্গলে ক্যাম্পিং করলে বন্যপ্রাণীদের ক্ষতি হয় এমন কিছু যেমন করবেন না, তেমনি বন্যপ্রাণী যেন আপনার ক্ষতি করতে না পারে সেদিকেও লক্ষ রাখবেন।
/এনএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সরকারি না হয়েও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হয়েও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত