X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
সাক্ষাৎকার

জাফর পানাহির ঢাকা সফর

সাহিত্য ডেস্ক
১১ জুলাই ২০২৩, ২০:১৮আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২৩, ১৬:১৮

২০০২ সালে আজকের কাগজ পত্রিকার সাহিত্যপাতা সুবর্ণরেখায় সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এ সংস্করণের ভূমিকা লিখেছেন কবি শামীম রেজা।

ফার্মগেটে যখন প্রচন্ড জ্যাম মার্সেডিস ব্রান্ডের প্রাইভেট কারটি অসহায়ের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লো, তখন জাফর পানাহি চিৎকার করে বললেন—
Why should I visit the newspaper office?
Will the editor of the newspaper come to meet me? Please turn the car around.
প্লিজ বলেছিলেন কিনা এতোদিনে আমাদের মনে নেই। তবে এ কথা মনে আছে আমাদের মধ্যে মুরব্বি ছিলেন মসিহউদ্দিন শাকের ভাই (নির্মাতা, সূর্য দীঘল বাড়ি) টিশার্ট পড়া জাঈদ ও আমাকে দেখে তিনি যে একদম পছন্দ করেনি তা আমরা বুঝে গেছি তাকে নিয়ে গাড়িতে উঠতে গিয়েই। শাকের ভাই বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছেন। আমাদের আগেই জানানো হয়েছিল ফারসি ছাড়া তিনি কথা বলবেন না। আমরা ধরে নিয়েছিলাম চলন সই ইংরেজি হয়তো জানেন কিন্তু জাত্যাভিমানের কারণে ঔপনিবেশিক ভাষায় কথা বলবেন না। কিন্তু গাড়িতে যে অন্য রূপ দেখছি, শাকের ভাই কথা চালিয়ে যাচ্ছিলেন ‘Dear Panahi, the newspaper office is not far away. But the way back is far.

আমরাও বিনয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম। পানাহির নীল চোখ থেকে স্ফুলিঙ্গের মত ফুলকির ছায়া বের হচ্ছিল। রাগন্বিত মুখায়াবব আরো লাল আভায় হলুদাভ রঙ ধারণ করেছিল যখন, তখন ইরানি তরুণ আর এক চলচ্চিত্রকার মাজিয়ার মিরি ফারসিতে কী যেন বললেন, পানাহির দৃঢ় মুখ আরো কঠিন থেকে কঠিনতর হলো। আমরা নির্বাক। কিছুই করার নেই। গাড়িতেই যেন বিরক্তির বিজ্ঞাপন-চিত্র নির্মিত হচ্ছিল। এখন মনে হয় এমন না হলে তো গল্পই তৈরি হতো না, এমন না হলে তো স্মৃতিতে আলোর রঙ ধরে না। মূলত বন্ধু জাঈদ আজিজের কারণে আর আমার আগ্রহে ‘আজকের কাগজ’ অফিসের উদ্দেশ্যে (মহাখালী আরজত পাড়ায়) যাত্রা। একুশ বছর পর রাস্তার অবস্থা তথৈবচ। কতদূর এগুলো এই বাস্তবতার পথ। সংস্কৃতবান সম্পাদক শ্রদ্ধেয় কাজী শাহেদ আহমেদ তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িখানা (মার্সিডিজ বেঞ্চ) ফিল্মের কাজে আনা নেয়ার জন্য দিয়েছেন জঞ্জালময় ঢাকার রাস্তায়। আজকের দিনে যেমন প্রায়শ চোখে পড়ে এমন দামী গাড়ির, তখন কিন্তু হাতে গোনা ছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে বিদেশে ঘুরতে গিয়ে দেখেছি মার্সিডিসের গায়ে Taxi লেখা, সে অন্য প্রসঙ্গ। অন্য কোথাও বলবো।

২০০২ সালের ফেব্রুয়ারীর শেষ সপ্তাহে ঢাকায় সপ্তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিতে এসেছিলেন জাফর পানাহি। ভেনিস ফিল্ম উৎসবের গোল্ডেন লায়ন প্রাপ্ত (১৯৯৭) ‘The Mirror’ এর পরিচালককে মূলত ঢাকায় এনেছিলেন রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক আহমদ মুজতবা জামাল। একচল্লিশ বছরের যুবক পানাহিকে নিয়ে আমরা যখন পৌঁছালাম আরজত পাড়ার আজকের কাগজ অফিসে, তখনও তার মনের মানচিত্রে রৌদ্রের জানালা খোলেনি। আড্ডায় বসলেই মেঘের আনাগোনা যে একবারে কেটে যাবে তা নিশ্চিত ছিলাম আমরা।

কারণ আমরা সাধ্যমতো ইরানের প্রায় দুর্লভ সকল চলচ্চিত্র দেখে ফেলেছিলাম বন্ধু জাঈদ আজিজের কল্যাণে। আমরা মানে বন্ধু আহমেদ শামীম, রনজু রাইম, আসাদ আহমেদ, হামীম কামরুল হক, মাহবুব টিপু ও মাসুদ হাসান। তাছাড়া ফারসী সাহিত্যের আরো বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু আবদুস সবুরের (শাকির সবুরের) কল্যাণে জাফর পানাহির সমকালের ইরানি সমকালীন গল্প ও কবিতা, ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে নিজেদের মূর্খ্যতাকে কিছুটা হলেও গোছানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম বছর খানেক ধরে। বন্ধু শাকির সবুর খোঁজ দিলেন তেহরান রেডিওতে চাকুরি করে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন একজন ফারসী বিশেষজ্ঞ। নাম ফরিদউদ্দিন খান। তিনি সেই মুহূর্তে গাজীপুরে অবস্থান করছিলেন। তাকে ফোনালাপে পেয়ে যাওয়ায়, তিনি আনন্দ চিত্তে রাজি হলেন এমন সাক্ষাৎকারে সহযোগিতা করতে। আমাদের দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফলে যে প্রশ্নগুলো তৈরি করেছিলাম পারস্য নিয়ে বিশেষ করে ইরানের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র নিয়ে সেই প্রশ্নগুলো ফরিদ ভাই ফারসীতে এক এক করে যখন প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন তখন পানাহি একগাল হেসে বললেন- আপনার মত সুন্দর পারসিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ কম লোকই আয়ত্ব করতে পারেন। আমি সমস্ত উত্তর দিবো। দরকারে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যাবো না। বলে গায়ে চাপানো কোটটি খুলে চেয়ারে রাখলেন। দীর্ঘ দুই ঘন্টার বৈঠকটি তুলে ধরা হলো নিচে।

দীর্ঘ ২১ বছরে পৃথিবীর কতকিছু পরিবর্তন হয়েছে, জাফর পানাহি কতবার জেলে গিয়েছেন! কত কত নান্দনিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, এরপরে বিশ্বমানের ক্রিমসন গোল্ড (২০০৩), অফসাইড (২০০৬), দিস ইজ নট এ ফিল্ম (২০১১), টেক্সি (২০১৫), ক্লোজ কার্টেন (২০১৩), থ্রি ফেস (২০১৮) এবং সর্বশেষ ২০২২ সালে ‘নো বিয়ার’ মতো চলচ্চিত্র গুলো নির্মাণ করেছেন। কিন্তু ২০০২ সালের ৭ মার্চ আজকের কাগজে ছাপা ইরানি বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জাফর পানাহির এই সাক্ষাৎকারটি ভীষণভাবে আগামী দিনের চলচ্চিত্র ও পারস্য বুঝতে, জানতে কাজে লাগবে বলে বিশ্বাস আমাদের।

জাঈদ আজিজ : বিপ্লব পূর্বের ইরানি চলচ্চিত্র সম্পর্কে আমরা খুব একটা বেশি জানিনা, বিপ্লবের পরের ইরানি চলচ্চিত্র সম্পর্কে আমরা অনেকটা ধারণা পাই—তাতে কী আমরা ধরে নিতে পারি যে বিপ্লবই ইরানি ছবির অগ্রগতির অন্যতম কারণ?

জাফর পানাহি : ইরানের চলচ্চিত্র নির্মাণের ঐতিহ্য দীর্ঘ দিনের। ইরানের চলচ্চিত্রের দীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে শহীদ সোরাওয়ার্দী শাহানশাহ, আব্বাস কিয়ারোস্তমি নাম জড়িত। ...প্রকৃতপক্ষে ইরানের চলচ্চিত্র নির্মাণের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই বিপ্লবের। তবে ইরানের চলচ্চিত্র নির্মাতারা অনেক নতুন অনুষঙ্গ সংযোজন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। বিপ্লবপূর্ব নির্মিত চলচ্চিত্রের তুলনায় বিপ্লব-উত্তর ইরানি চলচ্চিত্র সম্পর্কে জানতে পারছে সাম্প্রতিক বিশ্ব। যদিও আগে বিশ্বব্যাপী ইরানি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যাপক সুযোগ ছিল না কিন্তু বিপ্লবের সাথেও ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাণের সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই। ইরানি চলচ্চিত্র গুলোর বিষয়বস্তু মানুষ বলেই আমরা কোনো নির্দিষ্ট সময় ধরে চলচ্চিত্র নির্মাণ করি না, সেখানে প্রাচীন কালের অনেক চরিত্রও এসে জায়গা করে নিয়েছে।

মসিহ্উদ্দিন শাকের : আমরা দেখেছি শৌখিন অভিনেতা ও সাধারণ মানুষদের নিয়ে ইরানে চলচ্চিত্র হচ্ছে। আর এসব অভিনেতারা যারা পেশাদার তাদের থেকে অনেক ভালো অভিনয় করছে। এই সিদ্ধির কারণ কী? এটা কী আর্থিক কারণে করা হচ্ছে?

জাফর পানাহি : মিরি তুমিই এ সর্ম্পকে বলো।

মাজিয়ার মিরি : ইরানে প্রতিবছর তৈরি প্রায় ষাট থেকে সত্তরটা চলচ্চিত্রের মধ্যে বেশির ভাগেরই উদ্দেশ্য বাণিজ্যিক। অভিনয়ের ক্ষেত্রে পেশাদার লোকের অংশগ্রহণই বেশি। এসব ছবি তৈরিতে বিনিয়োগকৃত অর্থ উঠে আসা এবং পারফর্মারদের পারিশ্রমিকের দিকেও দৃষ্টি দেয়া হয়। প্রতি বছর ইরানে তৈরি চলচ্চিত্র গুলোর মধ্যে স্বল্প সংখ্যক চলচ্চিত্র শৈল্পিক এবং প্রচলিত ধারা থেকে নির্মিত হয়, এসব চলচ্চিত্রের মধ্যে কিছু ব্যতিক্রমও লক্ষ করা যায়। এই নগণ্য সংখ্যক চলচ্চিত্র শৈল্পিকভাবে তৈরি করা হয় বাস্তব ঘটনার প্রতি লক্ষ রেখে এবং সমাজের সাধারণ লোকদেরকেও আমরা কাজে লাগাই চলচ্চিত্র-কে আরও বাস্তবনিষ্ঠ করে তোলার জন্য। আমাদের ইরানের এসব শৈল্পিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করা সাধারণ লোকজন অভিনয়ের উদ্দেশ্য নয় বরং তাদের সাধারণ জীবনকে তুলে ধরার জন্যই চলচ্চিত্রে আসে।
সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রে পেশাদার লোকজন না এলে সমাজের মানুষ তাদের সত্যিকার চিত্রটা দেখতে পায় চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এরকম যেনো না হয় যে এটা কল্পিত বানোয়াট- একারণেই আমরা তাদের সংশ্লিষ্ট করে থাকি। আমরা কেবল তাদেরকে বলি যে তারা যেনো অভিনয় না করে তাদের প্রকৃত জীবনকেই তুলে ধরেন। অবশ্য আমরা প্রযোজক ও পরিচালকরা এর একটা যথার্থ সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে নানা কালাকৌশল অবলম্বন করে থাকি। আমরা পেশাদার অভিনেতার বদলে অপেশাদার এসব লোককে নির্বাচন করার কারণে চলচ্চিত্রে প্রকৃত জীবনটাই উঠে আসে।

শামীম রেজা : ইরানি চলচ্চিত্র সম্পর্কে বলা হচ্ছে এগুলো ডকু-রিয়ালিটি, উচ্চগুণসম্পন্ন শিল্প, হিউম্যানিজম, রিয়েল লাইফ স্টোরি, তবে এর ন্যারেটিভ খুব সামান্য, তুচ্ছ কিন্তু গভীর ঘনঘটা বর্জিত দৈনন্দিন জীবন নিয়ে করা এসব ছবি এর কোনদিকটাকে আপনি গুরুত্ব দেন কিংবা এর বাইরে ইরানি চলচ্চিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য কী?

জাফর পানাহি : চলচ্চিত্র নির্মাণের পেছনে আমাদের মূল চিন্তার দর্শন হচ্ছে মানুষ এবং মানুষের বিভিন্ন অবস্থা বর্ণনা করা। মানুষকে যেসব বিষয় সীমাবদ্ধ ও সংকীর্ণ করে আমরা সেসব বিষয়কে তুলে ধরার চেষ্ট করি। আপনারা আমাদের চলচ্চিত্রের যে সব বিষয় বা প্রবণতার কথা বলছেন এ ছাড়াও আরো কিছু বিষয় আছে যেগুলো দেখার ভার আপনাদেরকে নিতে হবে। দর্শকদের প্রতি বিশেষ সম্মান দেখানো ইরানি চলচ্চিত্রের আরও একটি বিশেষ দিক। এই সম্মানটা এ জন্যে প্রদর্শন করা হয় যাতে দর্শক শ্রোতা এসব চলচ্চিত্র মূল্যায়ন করার সুযোগ পায়। আমরা চলচ্চিত্রে ন্যারেটিভ বিষয়গুলো এজন্য রাখি না কারণ আমারা চাই যে দর্শকরা নিজেই চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত হয়ে এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বা ন্যারেট করার সুযোগ পায়। তখন দেখা যাবে এইসব দর্শকরা সমাজ, অর্থনীতি, নিজ দেশ ও বিশ্বের বর্তমান অবস্থানটা মূল্যায়ন করতে পারে। এভাবেই তাদের বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা বাড়তে থাকবে।

শামীম রেজা : পশ্চিমের মাধ্যমেই ইরানি চলচ্চিত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। তারা ইরানি চলচ্চিত্রের প্রশংসা করলেও ইরানের সংস্কৃতির সমালোচনায় মুখর। ইরানের সংস্কৃতির আমরা যেসব ছবি দেখছি তার সাথে সত্যিকার ইরানি সংস্কৃতির কোনো পার্থক্য আছে কী?

জাফর পানাহি : আমার একধরনের অনুভূতি যে, আমাদের সমাজের মানুষের দুই ধরনের ব্যক্তিত্ব আছে- একটা হচ্ছে তাদের প্রকৃত ব্যক্তিত্ব আর অন্যটা যেটা তিনি প্রদর্শন করেন অন্যের সামনে। অর্থনৈতিক সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক কারণে মানুষ তাদের প্রকৃত ব্যক্তিত্বটাকে প্রদর্শন করতে পারে না। অনেকে সরকারি অফিস আদালতে চাকরি করার ফলে নিজেদেরকে অত্যধিক মুসলমান হিসাবে দেখায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের আসল রূপ এটা নয়। এই বিষয়টাকে দেখানোই আমার লক্ষ্য। এই যে মানুষের দ্বৈত-চরিত্র এটাকে ছবিতে দেখানোর জন্যই আমি কাজ করছি।

জাঈদ আজিজ : বিপ্লবের আগে ইরানে চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য থাকলেও বিপ্লবের পর থেকে আমরা নতুন ধারার চলচ্চিত্র পাচ্ছি- বিশেষ করে ফারাবী ফিল্ম ফাউন্ডেশন-এর মাধ্যমে যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে সেগুলো একেবারেই নতুন ধারার, আমরা জেনেছি এসব চলচ্চিত্রের পিছনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে বিপ্লবই কী ইরানি চলচ্চিত্রের সাম্প্রতিক উত্তরণের কারণ?

জাফর পানাহি : কোনো কিছুর ভিত্তি গড়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগে। আমরা চলচ্চিত্রে যে একটা অবস্থানে গিয়ে পৌঁছেছি এটার ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। আমাদের কবিতা ও কথা সাহিত্যের ইতিহাস দীর্ঘ দিনের এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের পেছনেও মূলত এগুলোই কাজ করেছে বুনিয়াদ হিসাবে। বিপ্লবের পরে কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে শিল্পের ক্ষেত্রে, যেমন ভাস্কর্যশিল্প, সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। তবে ইরানে যারা চলচ্চিত্র নির্মাতা তারা চেষ্টা করেছেন এইসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সৃজনশীলতা যাতে অব্যাহত থাকে। শিল্পকলার ম্যাধ্যমেও তাদের এই সৃজনশীলতাকে তারা চলচ্চিত্রের ভেতর দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন। তবে বিপ্লব যে সহযোগিতা করেছে তা হচ্ছে ইরানের প্রতি সবার মনোযোগ। এর ফলে বহিঃবিশ্বের সবাই ইরান সম্পর্কে মনোযোগী হয়ে ওঠে অতি মাত্রায়। সবাই ইরানি শিল্প ও ইরানি কলা সর্ম্পকে জানতে আগ্রহী হয়। এর ভেতর দিয়ে চলচ্চিত্রকেও তুলে ধরার সুযোগ পায়। এখানে হয় তো বিপ্লবও সহযোগিতা করেছে চলচ্চিত্রের ভেতর দিয়ে নিজেকে তুলে ধরতে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাও আরোপ করেছে। তবে বিপ্লব অস্বীকার করা যায় না।

শামীম রেজা : বলা হচ্ছে ইরানে এখন যত মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে তত চলচ্চিত্র ফরাসী নিউ ওয়েভ-এর পর আর হয়নি—এটা কতটুকু সত্য?

জাফর পানাহি : আামি ১৯৯৭ সাল থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণে আসি এবং মাজিয়ার মিরি এবছর (২০০২ সালে) থেকে ছবিতে কাজ করছেন- কোনো এক দেশে পাঁচ ছয়টা মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র তৈরি হয়ে গেলে এটার মান উঠা-নামা করতে পারে। বিভিন্ন দেশে বিচিত্র ধারার শিল্প নানাভাবে তার শুরুর আগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নেয়- কোনো কোনো রাষ্ট্র প্রধান যখন কাব্যের প্রতি বেশি পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন তখন কাব্যের উন্নতি ঘটে, আর একসময় দেখা যায় অন্য আরেকটা শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন তখন সেটার প্রসার ঘটে। আমাদের দেশে আমার মনে হয় যুব সমাজ তাদের মনের কথাগুলো চলচ্চিত্রের ভাষায় বলতে ও শুনতে ভালোবাসে। অন্যান্য মাধ্যমের পাশাপাশি চলচ্চিত্র-কেও তারা একটি উত্তম মাধ্যম হিসেবে পেয়েছে। কয়েক বছর আগে ইরানি চলচ্চিত্র বিশ্বে যখন সর্বোচ্চ জায়গা দখল করে, তখন অনেকের ধারণা ছিল যে পরের বছর হয়তো এরকম ঘটনা আর ঘটবে না। কিন্তু দেখা গেছে যে পরের বছরগুলোতেও বিশ্বের চলচ্চিত্রে উৎসবগুলোতে ইরান নিজের অবস্থান সমুন্নত রেখেছে এবং নতুনভাবে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। এবং সবাই মনে করে যে এইবার ইরান আমাদের এখানেই বোধ হয় সবচেয়ে বড় অবস্থানটা পেল। এর কারণ অবশ্য আছে- আমাদের কাছে মনে হয় যে ইরানের চলচ্চিত্র বাস্তবতা ভিত্তিক, বাস্তবকে নিয়ে নির্মিত হয়। ইরানে ছবি নির্মাণ করেন যারা, তারা সচেতন থাকেন যেন কোনো চলচ্চিত্রের পুরনাবৃত্তি না হয়। বিশ্বের বোদ্ধা চলচ্চিত্র সমালোচকদের প্রত্যাশা হচ্ছে ইরানী চলচ্চিত্র নির্মাতারা যেনো নতুনভাবে তাদের নতুন নতুন সমস্যাগুলোকে তুলে ধরেন।

জাঈদ আজিজ : খাতামি যখন নির্বাচনে প্রার্থী হন তখন আমরা দেখতে পেলাম ইরানি চলচ্চিত্রকারগণ একজোট হয়ে তাকে সমর্থন জানালেন, এর সমান্তরাল একটি ঘটনা লক্ষ করা যায় চিলিতে সালভাদর আলেন্দের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সময়ে। চিলির চলচ্চিত্রকারগণ তখন তাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এ থেকে কী সিদ্ধান্তে আসা যায় ইরানি চলচ্চিত্রকাররা রাজনীতি সংশ্লিষ্ট?

মাজিয়ার মিরি : একজন সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাতার প্রকৃতই যদি তার সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে থাকে তা হলে তিনি রাজনীতি সংশ্লিষ্ট হতে পারেন না। সাধারণত চলচ্চিত্রকারদের সঙ্গে রাজনীতিবিদের সখ্য থাকে না, চলচ্চিত্রকারদের প্রতি তাদের একধরনের উন্নাসিকতা কাজ করে। তাদের চলচ্চিত্র সেন্সর করা হয় এবং এক ধরনের বাধ্যও তারা সৃষ্টি করে। সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাতারা যেহেতু সমাজের সমস্যাগুলো তুলে ধরতে চান সেহেতু তারা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হতে চান না। রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত হলে সমাজের বাস্তবচিত্র তারা তুলে ধরতে পারবেন না। প্রকৃতপক্ষে রাজনীতির সাথে জড়ানোর চেয়ে তিনি সমাজের সাথেই বেশি জড়িয়ে থাকেন- কারণ তিনি সমাজের সুখ দুঃখ নিয়ে কথা বলতে চান। সমাজের কথা বলতে হলে তার সহায়ক হবে সমাজের জনগণই। যেহেতু তিনি সমাজেই বসবাস করেন তাই তিনি জানেন এই সমাজের কী অবস্থা। সমাজের সমস্যাগুলো নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চান বলেই তাদের চিন্তা-চেতনাগুলো থাকে সমাজের চেয়ে অনেকাংশে এগিয়ে। এখানে এক ধরনের স্বতঃস্ফুর্ততা আছে। আর পৃষ্ঠপোষকতাও তারা পেয়ে থাকেন সমাজ থেকেই। খাতামী সাহেবের প্রতি চলচ্চিত্র নির্মাতা একজোট হয় যে সমর্থন জানিয়েছেন এটা মূলত চলচ্চিত্রের প্রতি খাতামী সাহেবের সমর্থনের কারণেই তাকে সমর্থন জানানো হয়েছে।

জাঈদ আজিজ : শিশু প্রায়ই ইরানি চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ছোটদের নির্ভেজাল তৎপরতার মধ্য দিয়ে বয়স্কদের জগতকে দেখা ইরানি চলচ্চিত্রের একটা সুনির্দিষ্ট অবয়ব তৈরি করেছে। তিনি এর পাশাপাশি নর-নারীর সম্পর্ক, ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সংঘাত, টানাপোড়ন নিয়ে খুব বেশি চলচ্চিত্র আমরা দেখিনি।

জাফর পানাহি : দুঃখজনকভাবে সত্য যে বিপ্লবের আগে ও বিপ্লব উত্তর-কালে ইরানি চলচ্চিত্রে সে সীমাবদ্ধতা ছিল এবং কিছু কিছু এখনও আছে। হয়তো কোনো সময় কোনো একটা বিষয়ের ওপর দেখব সেন্সর করা হয়েছে কিংবা হয়তো অন্য কোনো সময় অন্য কোনো বিষয়ের পর সেন্সর করা হতো। তখন চলচ্চিত্র নির্মাতা লক্ষ করলেন শিশুদের নিয়ে যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হচ্ছে তাতে সেন্সরের দৃষ্টি কম থাকে। এ কারণেই তারা ওদিকে মনোযোগী হয়েছে। ছোটদের মাধ্যমে বড়দের কথাগুলো বলে নিচ্ছে তারা। এই পদ্ধতিটা কয়েক বছর আগে এসে পূর্ণতা লাভ করেছে। এরপর থেকে তার বড়দের কথা বড়দের মাধ্যমে বলতে শুরু করেছেন ছোটদের মাধ্যমে বলার আর প্রয়োজন হয়নি। যেকোনো ভাবেই তারা তাদের কথাগুলো বলার চেষ্টা করছেন। ধর্মীয় বা রাজনৈতিক দৃষ্টিতে এটাকে দেখছি না। আমি শুধু জানাতে চাচ্ছি যে সমাজে এই সমস্যাটা আছে। আমার শৈল্পিক মাধ্যম দিয়ে তুলে ধরেছি সমস্যাগুলো এবং এর সমাধানের ভার দর্শকের ওপর। পক্ষে বিপক্ষে বলার কোনো বিষয় নয় এটি।

শামীম রেজা : ইরানি চলচ্চিত্র বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করেছে। সেই তুলনায় আমরা ইরানি সাহিত্য সম্পর্কে খুব বেশি জানতে পারছি না। দু’একজনের কথা শুনেছি মাত্র। এর কারণ কী?

জাফর পানাহি : এটা আসলে মানুষের ইতিহাস ঐতিহ্য ও কৃষ্টির সঙ্গে জড়িত। আমাকে ক্ষমা করবেন সাহিত্য সম্পর্কে বিশেষ করে সমকালীন সাহিত্য সম্পর্কে আমার ধারণা কম।

শামীম রেজা : ইরানি চলচ্চিত্রে নারীদের অভিনয়ের ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। চলচ্চিত্র একটি সার্বজনীন ও পরিপূর্ণ শিল্পমাধ্যম হিসেবে বিকাশের ক্ষেত্রে এই বাধাকে কীভাবে মোকাবেলা করা হচ্ছে?

জাফর পানাহি : যখন যে সমস্যা থাকে সেই সমস্যাকেই আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করি, বর্তমানে যেহেতু সমস্যায় পড়ে আছে নারী সেহেতু নারীদেরকে বা নারীদের সমস্যা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হচ্ছে। যখন দেখব যে সমস্যা নারীর জন্য নেই, তখন শিশু কিংবা বয়স্কদের জন্য থাকতে পারে। তখন তাদের নিয়েও আমরা ছবি নির্মাণ করব। আমরা আশা করি এমন একদিন আসবে বিশ্বে মানুষের আর চলচ্চিত্র ধরনের সমস্যাই থাকবে না, তখন হয়তো ছবি নির্মাতারা কাল্পনিক বিষয় নিয়ে ছবি নির্মাণ কাজে অগ্রসর হতে পারবে।

জাঈদ আজিজ : আপনার তিনটি চলচ্চিত্রের সবগুলোর প্রধান চরিত্রই নারী। এটা কী কাকতালীয় নাকি সচেতন ভাবেই নারী চরিত্র নিয়ে ছবি করতে চেয়েছেন?

জাফর পানাহি : যেহেতু আমার বিষয়বস্তু বা লক্ষ হচ্ছে সমাজের সমস্যাগুলোকে উপস্থাপন করা, যখন যে সমস্যা বড় হয়ে দেখা দেয় তখন সেটাকে তুলে ধরার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করি। আমাদের সমাজে যেহেতু পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি সমস্যাক্লিষ্ট সুতরাং তাদেরকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

মসিহ্উদ্দিন শাকের : ‘মিরর’-এ বাহেরে এবং অন্যান্যদের কথাবার্তাকে তাৎক্ষণিক ও স্বাভাবিক মনে হয়। আপনি প্রতিটি চরিত্রের জন্য সংলাপ নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন না কি তাৎক্ষণিকভাবে ধারণ করা?

জাফর পানাহি : আমি এই মুহূর্তগুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি, আমাদের সমাজে নারী সম্পর্কে যে সনাতন ধ্যান ধারণা আছে- সেগুলোকে নিয়ে আমি কাজ করেছি। যেহেতু আমাদের মিডিয়াতে তাদের অংশগ্রহণ নগণ্য, বিভিন্ন যানবাহনে তাদেরকে নিয়ে মানুষ নানা ধরনের কথা বলে থাকে- আমি এই মানসিকতা থেকেই ভবিষ্যতে যে চলচ্চিত্রটা নির্মাণ করবো সেটার বীজ হয়তো এখানে অঙ্কুরিত হয়েছে।

মসিহ্উদ্দিন শাকের : চলচ্চিত্রের এক পর্যায়ে আমরা দেখি বাহরে রেগে বাস থেকে নেমে একটা বাড়ির সিঁড়িতে গিয়ে বসে। তখন চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় এবং নির্মাতাকে দেখা যায়। এভাবে নির্মাণ প্রক্রিয়াকে চলচ্চিত্রের মধ্যে আনার কারণ কী?

জাফর পানাহি : চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু যাই-ই হোক সেটা আগে থেকে পরিকল্পিত হয়, কিন্তু একজন অপেশাদার অভিনেতা নিয়ে যখন কাজ করি, তখন সবটা তাদের নিজেদের বিষয়। কোনো দৃশ্যে যদি সংলাপ নির্মাণ করতে হয়- আমরা তাদেরকে একটা চিন্তা দিয়ে বলি যে, তোমরা যেভাবে খুশি তা বলতে পার। তখন দেখা যায় যে সেই ব্যক্তি নিজেই কথাগুলো বলতে থাকে, আমাদের লিখতে হয় না- কেবল পরিকল্পনাগুলো আমরা দিয়ে দিই। আমরা যদি লিখে দিতাম তা হলে এই স্বাভাবিকতা আর থাকতো না। তবে একজন পরিচালকের দায়িত্ব হচ্ছে, যাকে দিয়ে এই অভিনয় তিনি করাবেন তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানা। দেখা যাচ্ছে কেউ যথাযথভাবে বলছে, কেউ বলতেও পারছেনা।

শামীম রেজা : ‘মিরর’ চলচ্চিত্রে ‘বাহারে’ চরিত্রে রূপদানকারী মেয়েটিকে মনে হয়েছে সে কান্না দমিয়ে রাখছে। তাকে কী কাঁদতে নিষেধ করা হয়েছিল?

জাফর পানাহি : প্রথম দিকে কেঁদে ফেলেছে, কিন্তু শেষে যাতে না কাঁদে সে ব্যাপার আমরা তাকে তৈরি করেছি।

জাঈদ আজিজ : আপনি আব্বাস কিয়ারোস্তামি’র সঙ্গে কাজ করেছেন, তার চিত্রনাট্যের উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। আঙ্গিক ও বিষয়ের দিক থেকে আপনাদের দুজনের চলচ্চিত্রে একটা সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। আপনারা দুজনই চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়াকে চলচ্চিত্রতে অন্তর্ভূক্ত করেছেন। আপনাদের চলচ্চিত্রে পারস্পেকস্টিভ কম গুরুত্বপূর্ণ। ন্যারেটিভ সামান্য। আপনি কিয়ারোস্তামির দ্বারা প্রভাবিত?

জাফর পানাহি : আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি সমস্যাগুলো দর্শকরাই শনাক্ত করুক। আমরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করার সময় স্থান কালের প্রতি বিশেষ নজর রাখি। বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির আলোকে তারা কী চায়। যেহেতু আমরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করি সুফীবাদের আলোকে, এই আঙ্গিকে আমরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করে দর্শকদের হাতে ছেড়ে  দিই। আমরা চাই দর্শকই বিচার করুক এর মধ্যে কী আছে কী নেই। এমনও দেখা গেছে তারা বিচার শক্তি খাটিয়ে যা চিন্তা করেছে বা পেয়েছে নির্মাতা নিজেও তা ভাবেনি। আপনারা যেহেতু আমাদের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে থেকে চলচ্চিত্র গুলো দেখছেন- সুতরাং আপনাদের এসব চলচ্চিত্র একটা ভিন্নরকম জিজ্ঞাসার উন্মেষ ঘটায়। কিন্তু আমাদের দেশের দর্শকদের সামনে এটা পরিষ্কার।

শামীম রেজা : বিষয়বস্তুর দিক থেকে আপনার আগের দুটো চলচ্চিত্রের তুলনায় ‘সার্কেল’ অনেক বেশি সাহসী। রাগ কিংবা ক্ষোভটা পরিষ্কার। এটা কী ইরানের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতির ফল নাকি নির্মাতা হিসেবে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তনের কারণে এটা ঘটেছে?

জাফর পানাহি : সত্য হলো আগের চলচ্চিত্র গুলোতে আমি যে গুরুতর বিষয়গুলো বলার চেষ্টা করেছি সেগুলো শিশুদের সমস্যা। ওই চলচ্চিত্র দুটোতে আমার বিকাশের একটা ধারাবাহিকতা আছে। ওগুলো ছিল হোমওয়ার্ক। ‘মিরর’ ও ‘হোয়াইট ব্যালুন’–এর বাচ্চারা যা অর্জন করতে চেয়েছে তার জন্য তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে। প্রশ্ন হলো, বড় হয়েও তারা কী লোকজনের কাছ থেকে একই রকম সহানুভূতি পাবে? আমি এই জিজ্ঞাসার একটা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ছোট-বড়, আমরা সবাই একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে রয়েছি। কেউ এ বৃত্তের বাইরে যেতে চাইলে এর জন্য তাকে মূল্য দিতে হয়। এ পরিস্থিতি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো রাগ নেই; বরং সমাজের মধ্যেই রয়েছে ক্রোধ, যা ‘সার্কেল’–এ দেখানো হয়েছে।

শামীম রেজা : ‘সার্কেল’ চলচ্চিত্রে নারীর পৃথিবীকে দেখানো হয়েছে কারাগারের রূপকে। আমরা মনে করি না কেবল ইরানি নারীদের ক্ষেত্রেই এটা যথার্থ; বরং সারা দুনিয়াই এ পরিস্থিতির একটা অভিন্নতা রয়েছে। এ ধরনের রূপক থেকে কী আমরা ধরে নেবো সারা পৃথিবীকেই পাল্টানো দরকার? আপনি কী আমাদের এ উপসংহারের সঙ্গে একমত?

জাফর পানাহি : আমি মনে করি পৃথিবীর সবাই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে আছে। ব্যক্তি ও সমাজভেদে এই বৃত্তের ব্যাসার্ধ কম-বেশি হয়। ভৌগোলিক অবস্থান যতই ভিন্ন হোক, সবাই একটা বৃত্তের মধ্যে বাস করে। আমার চলচ্চিত্র কাউকে প্রভাবিত করলে আমি আশা করবো তারা তাদের পরিমণ্ডলের ব্যাসার্ধ বাড়ানোর চেষ্টা করবে।

জাঈদ আজিজ: ‘সার্কেল’ দেখে মনে হয় নারীরা ইরানে অবরুদ্ধ, সামাজিক পরিবেশ তাদের প্রতি বিরূপ। এটা কী ইরানের সত্যিকার অবস্থা না অতিরঞ্জন?

জাফর পানাহি : আপনি যখন কোনো কিছুর ওপর নজর দেন তখন বাস্তবের অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় সেটাকে অনেক বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্যতা দেন। আমরা বাস করছি ৬ কোটি মানুষের একটি দেশে। আপনি যখন তাদের একজনের গল্প বলছেন তখন সুস্পষ্টভাবেই আপনি গল্পটাকে মনোযোগের কেন্দ্রে আনছেন।

মসিহ্উদ্দিন শাকের : আপনি প্রচুর লংটেক ব্যবাহর করেছেন।

জাফর পানাহি : চলচ্চিত্র দেখে আপনি যদি বিরক্ত না হয়ে থাকেন, সেটা সম্ভবতঃ প্রতিটি শটে দৈর্ঘ্য ও গতির কারণে। শট-সিনগুলোতে (Shot-Scene) কোনো কাট নেই। আপনি বিভিন্ন কোণ থেকে দৃশ্য দেখছেন কিন্তু কোণের পরিবর্তন ঘটছে ক্যামেরা অবস্থানের পরিবর্তনের ফলে—কাট-এর কারণে নয়।

শামীম রেজা: আপনার সব চলচ্চিত্রে পরিবেশ তৈরিতে রেডিওর একটি ভূমিকা আছে।

জাফর পানাহি : রেডিওর বেশি গুরুত্ব ছিল ‘হোয়াইট ব্যালুন’–এ। বিষয়ের দিক থেকে এ চলচ্চিত্রটা ছিল সময়ের বিরুদ্ধে একটা যাত্রা। এজন্য কাহিনীর Suspense বাড়াতে আমরা সময়ের ব্যাপারটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলাম। আর ‘সার্কেল’-এ আমি রাতের আবহ তৈরি করতে রেডিওর জনপ্রিয় একটি সান্ধ্য অধিবেশনকে ব্যবহার করেছি।

জাঈদ আজিজ : বৈষম্য- অবিচারের মুখোমুখী হয়ে কিংবা বাস্তব প্রয়োজনের তাগিদে কোনো শিল্পী কী তার শিল্প কর্মের ব্যাপারে ছাড় দিতে পারেন? কিংবা কোনো বিষয়ে সরাসরি প্রতিবাদ করার দরকার সেখানে কী ভূমিকা নেবেন?

জাফর পানাহি : আমার ধারণা বিষয়টা কিছুটা আদর্শ সংক্রান্ত। ইতিহাসে দেখা যাবে সামাজিক সমস্যা চেপে গিয়ে বহুবার শিল্পীরা কর্তৃপক্ষের কাছে বিক্রি হয়েছেন। এ মুদ্রার আরেক পিঠ হলো সত্য কী তা দেখাতে গিয়ে শিল্পী নিজেকে বিসর্জন দিয়েছেন। পরিস্থিতি দাবি করলে শিল্পীকে এ ধরনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।

শামীম রেজা : আমাদের শেষ প্রশ্ন আপনার ছবির লক্ষ্য কারা? দর্শক হিসেবে আপনি কাদের প্রভাবিত করতে চান?

জাফর পানাহি : শিল্পের তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব নেই। কোনো শিল্পকর্ম চূড়ান্তভাবে সফল হলে তা সমাজকে স্পর্শ করে এবং বিভিন্ন বিষয়ে লোকজনকে ভাবতে বাধ্য করে। শিল্পের সে সব মানুষ দরকার যে সব মানুষের শিল্প প্রয়োজন। এ সম্পর্কটা আদান-প্রদানের। এখানে একটা বিনিময় ঘটে।

ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করায় পানাহি আমাদের রেকর্ডার বন্ধ করতে বললেন। আমরা বন্ধ করলাম রেকর্ডার এবং খোলামেলা অনেক উত্তর দিলেন শিয়া, সুন্নী সংক্রান্ত। হাদিস নিয়ে বললেন—নবী মৃত্যুর বহু বছর পরের সংগ্রহ নিয়ে সকলের সংশয় আছে, তৃতীয় খলিফার সংকলন নিয়ে শিয়াদের মধ্যে ভীষণ মতভেদ আছে। আমরা সুন্দরকে ধারণ করেছি মাত্র কোরআনের সেই সুন্দর ভার্সের থেকে।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে