X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

কবির সান্নিধ্য

আহমেদ রেজা
০৮ আগস্ট ২০২৩, ১৭:৫৩আপডেট : ০৮ আগস্ট ২০২৩, ১৭:৫৫

আহমেদ রেজা লেখক, অনুবাদক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। শিক্ষাজীবনে তিনি সদ্য প্রয়াত কবি মোহাম্মদ রফিকের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। রেজা নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সংগ্রামে কবির সহযোগী ছিলেন। হেমায়েতউল্লাহ ইমনের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেছেন কবির জীবন ও কর্মের নানা দিক


হেমায়েতউল্লাহ ইমন : কবি মোহাম্মদ রফিক আপনার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে ছাত্রাবস্থায় নিশ্চয়ই কবির সান্নিধ্য পেয়েছেন। তার ‘খোলা কবিতা’ প্রকাশের পর পর যে আলোড়ন তৈরি হয়েছিল তখন মোহাম্মদ রফিকের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? 
আহমেদ রেজা : আমার ছাত্রাবস্থায় স্যার ইংরেজি বিভাগের সভাপতি ছিলেন। তিনি আমাদের ক্লাসও নিতেন। সেই সূত্রে তাকে কোর্সের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। ক্রমশ মিশতে গিয়ে দেখেছি, তিনি আপাদমস্তক কবি এবং সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো তিনি একনিষ্ঠ সংস্কৃতিকর্মীও।

তখন আমাদের ক্যাম্পাসে ‘ধ্রুবপদ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংঘ ছিলো। আমি সেখানে একটা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলাম। স্যার প্রতিদিন অনুশীলন তত্ত্বাবধান করতেন, পরামর্শ দিতেন এবং নতুন নতুন পরিকল্পনাও করতেন। মনে আছে আমরা বসন্ত উৎসব করেছিলাম।

আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু করি ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে। পাস করি ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে। এই সময় অনেক কিছু দেখেছি। যেমন, ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একটা সেনা-ক্যুতে নিহত হন। এরপরেই ক্ষমতা নেন জেনারেল হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ। ক্রমশ তার স্বৈরাচারী রূপ উন্মোচিত হলো। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রথম ভীষণভাবে যে কবি প্রতিবাদ করেছেন, তিনি আমার শিক্ষক মোহাম্মদ রফিক। তিনি নিউজ প্রিন্টের কাগজে একটি বই প্রকাশ করলেন, এক ফর্মার, নাম ‘খোলা কবিতা’। এই ‘খোলা কবিতা’র হাজার হাজার কপি পুরো বাংলাদেশে কয়েক মাসের মধ্যে ছড়িয়ে গেল। সেই কবিতায় তিনি এরশাদের নানা কৃতকর্মের প্রতিবাদ করেন, যেমন: একশাদের স্বৈরাচারী আচরণ, ক্ষমতার লোভ, অন্যকে দিয়ে কবিতা লেখানো, গান লেখানো—এসব।

নব্বইয়ের আগে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে স্যারের যে ভূমিকা, শুধু এটা বিবেচনা করলেই স্যার একুশে পদক পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। আর কিছু না। সেই সময় তিনি উল্লেখযোগ্য আরেকটি কাজ করেছেন। এরশাদ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবিদের নিয়ে দেশীয় কবিতা সম্মেলন করেছিলেন। তখন রফিক স্যার এবং তার যারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি শামসুর রাহমান, আমাদের তখনকার উপাচার্য অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী—ওনারা মিলে ঠিক করেন এর প্রতিবাদে আরেকটি প্ল্যাটফর্ম দরকার। তখন সবাই মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ’। এই সংগঠনের জাতীয় পরিষদের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আমাদের স্যার মোহাম্মদ রফিক। পুরো আশি থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি প্রবলভাবে সক্রিয় ছিলেন। এবং তিনি একইভাবে সক্রিয় ছিলেন আরেক স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে—আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে তিনি যুক্ত ছিলেন। তিনি তখন ছাত্র। রাজশাহীতে আইয়ুব খানের গাড়ি যাচ্ছিল তিনি দূর থেকে ঢিল মেরেছিলেন। নিরাপত্তা কর্মীরা তা দেখতে পেয়েছিল। তাকে কারাগারে অন্তরীণ করেছিল। রফিক স্যার তখন ভীষণ সুর্দশন, দীর্ঘ চুল, স্মার্ট, সুন্দর পোশাক পরতেন। আর দশজন কারাবন্দির মতো নন। একারণে জেলারের নজরে পড়েছিলেন। জেলার জানতে চেয়েছিল, ‘আপনিতো কিছুই চান না। সবাই এটা চায় ওটা চায়।’ উনি বললেন, ‘আমি একটা জিনিস চাই, আপনারা কী তা দিতে পারবেন?’ জেলার সম্মতি দিলে স্যার বললেন, ‘আমি আপনাদের লাইব্রেরিতে বসতে চাই। আমি শুনেছি আপনাদের লাইব্রেরিটা খুব ভালো।’ জেলার দেখলেন কোনো কারাবন্দি এভাবে লাইব্রেরিতে বই পড়ার অনুরোধ করে না। জেলার রফিক স্যারকে সুযোগটা দিয়েছিলেন। যতদিন জেলে ছিলেন লাইব্রেরিতেই সময় কাটাতেন। জেলে বসেই তিনি বিএ পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলেন। এরপর এমএ পাস করেছেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তারপরে ১৯৭৩ কী ’৭৪ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগরে যোগদান করেছেন।

তিনি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, প্রগতিশীল ছিলেন। শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। এজন্য আইয়ুবের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, এরশাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।


ইমন : কবি মোহাম্মদ রফিকের সঙ্গে তখনকার কবি সাহিত্যিকদের কী রকম সম্পর্ক ছিলো? 
আহমেদ রেজা : বাংলাদেশের তখনকার কবিদের সঙ্গে, বিশেষ করে প্রগতিশীল কবি লেখকদের সঙ্গে তার খুবই ভালো সর্ম্পক ছিল।

স্যার একবার ফরিদপুরের আলাওল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। আমি স্যারের সঙ্গে গিয়েছিলাম। আমরা ঢাকা থেকে বাসভর্তি লোক আসাদ গেইট থেকে রওনা হই। শুধু জাহাঙ্গীরনগর নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো অনেক জায়গার ছাত্রছাত্রীরা মিলে গিয়েছিলাম। মনে আছে, কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহও ওই বাসে ছিলেন।

অরুণ সেনের (প্রথম আলোর সিনিয়র সাংবাদিক, কিছুদিন আগে মারা গেলেন) বাড়ি ফরিদপুর। তিনি রফিক স্যারের বড় ভক্ত ছিলেন। ওখানে বিকেলবেলা গিয়ে দেখি কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (তিনি তখন সচিব), সৈয়দ শামসুল হক ও আসাদ চৌধুরী উপস্থিত। অন্যদের কথা মনে নেই।

ডিপার্টমেন্টের সব ছেলে-মেয়ে স্যারের সঙ্গে বই মেলায় যেতাম। বটতলার সামনে তখন এত স্টল হতো না। আশির দশকে, নব্বইয়ের দশকে স্টল এখনকার চাইতে কম হতো আরকি। ওখানে আমরা ঘাসে বসে গল্প করতাম, আড্ডা দিতাম, চা খেতাম। মনে আছে, একদিন আমরা আড্ডা দিচ্ছি, তখনকার সচিব কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ হেঁটে যাচ্ছেন। স্যার তাকে ডেকে ছাত্রছাত্রীদের চা খাওয়ানোর জন্য টাকা চাইলেন, তিনি দিলেনও। তার সান্নিধ্য আমাকে নানাভাবে আন্দোলিত করেছে।


ইমন : শিক্ষক হিসেবে কবি মোহাম্মদ রফিক কেমন ছিলেন? 
আহমেদ রেজা : তিনি খুব নিষ্ঠাবান, সৎ এবং পরিশ্রমী মেধাবী শিক্ষক ছিলেন। তার চরিত্রের আরেকটি বড়ো দিক হচ্ছে, তিনি প্রচুর ক্লাস নিতেন। কখনো কখনো নির্ধারিত সময়ের পরেও নিতেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শুনতাম। ক্লাস শেষে আমরা নিজেরাই বলতাম, ‘উনি কী সক্রেটিস?’ আর একজন বলতো, ‘না! উনি প্লেটো।’ আর একজন বলতো, ‘না না উনি জ্ঞানী লোক, উনি এরিস্টটল।’

তিনি সেকেন্ড ইয়ারেই পৃথিবী-বিখ্যাত সব কবিতা, থার্ড ইয়ারে হোমারের ইলিয়ড-ওডিসি এবং ভার্জিলের ঈনিড পড়িয়েছেন। তিনি রেফারেন্স দিতেন বাংলা সাহিত্য থেকে, চীনা সাহিত্য থেকে, লাতিন আমেরিকার সাহিত্য থেকে। এসব সাহিত্য তার পড়া ছিলো।

আমি চাকুরি জীবনে দেখেছি, অনেক মেধাবী শিক্ষক আছেন, যারা ক্লাসে যান না। কিন্তু স্যারের মধ্যে এই সমন্বয়টা ছিলো। সবাই তাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসতেন। ফেইসবুকে দেখতে পাবেন,  চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে রংপুর, রাজশাহী, সিলেট সব জায়গা থেকে তার ভক্তরা পোস্ট দিয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ শিক্ষক, কেউ কবি, কেউ লেখক, কেউ রাজনৈতিক কর্মী, কেউ অন্য চাকুরি করছেন, কিন্তু রফিক স্যারের প্রতিভার কথা, মেধার কথা, সৃজনশীলতার কথা, দেশপ্রেমের কথা মনে রেখেছেন।


ইমন : এখন তার মতো বহুমাত্রিক মানুষ পাওয়া সত্যিই কঠিন।
আহমেদ রেজা : হ্যাঁ। একটা দিক হচ্ছে তার গণতান্ত্রিক চেতনা এবং লড়াই। আরেকটি দিক হচ্ছে কবি ও স্বাধীনতা প্রিয় দেশপ্রেমিক একজন স্বদেশী কবি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, শিক্ষক হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এবং কবি লেখক ও নিকটজনদের সঙ্গে তার উষ্ণ সর্ম্পক।

আমি এখনকার তরুণ কবি যাদের সঙ্গে মিশি সবাই দেখি রফিক স্যারকে চেনেন। এবং এদের অনেকের সাথে রফিক স্যারের রাতে টেলিফোনে কথা হতো। আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব সিনিয়র যারা বিদেশে আছেন, তাদের সাথে রফিক স্যারের যোগাযোগ ছিলো, ভালো সর্ম্পক ছিলো। তার ভালোবাসা ছিলো মহাসাগরের মতো। আমরা সেই সাগরে হাবুডুবু খেতাম। সেই সাগর থেকে আমরা ভালোবাসা পেতাম। আমি তা একাই পাইনি, এরকম অসংখ্য বাংলাদেশের মানুষ, আজকে তো পৃথিবীতে অনেক ছড়িয়ে গেছে তার ছাত্রছাত্রী, তারা দূরদূরান্ত থেকে তার মৃত্যুতে কষ্ট পাচ্ছেন। রফিক স্যারের জন্য মঙ্গল প্রার্থনা করছেন। তিনি ভালো থাকুন এই প্রার্থনা করি।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার, নদীতে ঝাঁপিয়ে পালালো পাচারকারীরা
ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার, নদীতে ঝাঁপিয়ে পালালো পাচারকারীরা
তীব্র গরমে কাজ করার সময় মাথা ঘুরে পড়ে দিনমজুরের মৃত্যু
তীব্র গরমে কাজ করার সময় মাথা ঘুরে পড়ে দিনমজুরের মৃত্যু
বাংলাদেশে সামাজিক বিমা প্রবর্তনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে: মন্ত্রিপরিষদ সচিব
বাংলাদেশে সামাজিক বিমা প্রবর্তনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে: মন্ত্রিপরিষদ সচিব
ট্রাকের চাকায় পিষে দেওয়া হলো ৬ হাজার কেজি আম
ট্রাকের চাকায় পিষে দেওয়া হলো ৬ হাজার কেজি আম
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড