X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৃতি ও নারীকে আমি গুরুত্ব দিয়েছি : ওমর আলী

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : এম আবদুল আলীম
১৯ অক্টোবর ২০২৩, ২২:১০আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২৩, ১৩:৪৫

[কবি ওমর আলী ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য বিখ্যাত। বইটি ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য সোনালী বিকেল, অরণ্যে একটি লোক, আত্মার দিকে, একটি গোলাপ ছাড়াও তার ২৭টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ১৯৩৯ সালের ২০ অক্টোবর পাবনার চর কমরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। এই সাক্ষাৎকারটি কবির ৭০তম জন্মদিন কবির গ্রামের বাড়িতে গ্রহণ এবং পরে প্রকাশ করা হয়। ওমর আলী ২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।]


এম আবদুল আলীম : আপনার কবিজীবনের শুরু কীভাবে?
ওমর আলী : শৈশবে মাকে হারিয়েছি। সেই মাতৃস্নেহের বঞ্চনা থেকে আমার ভেতরে বাসা বেঁধেছিল গভীর বেদনা ও বিষণ্নতা, যা আমাকে ভাবুক বানিয়েছে, লেখার তাগিদ দিয়েছে। আমার পরিবারের লোকেরা, অর্থাৎ —আমার দাদা, বাবা ও চাচারা মাঝে মাঝে ছড়া কেটে কথা বলতেন আশপাশের মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্য। সেটাও ছিল আমার প্রেরণা। প্রকৃতি আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। প্রকৃতির মধ্যে কখনও একা আত্মমগ্ন থাকতাম। ঘুড়ি ওড়াতাম, মাছ ধরতাম। আমার ভেতরে কিছু একটা অনুভূতি জাগত এবং বাইরে আসতে চাইত, তা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পেলাম যখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি সেই ১৯৪৮ সালে। কবিতা লিখেছিলাম। সে লেখা অব্যাহত রয়েছে আজও। 


এম আবদুল আলীম : ওমর আলীর কবি হয়ে ওঠার গল্প বলুন।
ওমর আলী : আমি তখন ঢাকায় থাকি। ক্লাস টেনে পড়ার সময় বাংলাদেশ বেতারে কবিতা পড়ার সুযোগ পাই। মুনীর চৌধুরী সে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৫৫ সালে দৈনিক আজাদ-এর ইদ সংখ্যায় আমার ‘বৃষ্টির বিপদে এক চড়ুই’ কবিতা প্রকাশিত হয়। আশরাফ সিদ্দিকী ও কলকাতার কবি নরেশ গুহ প্রশংসা করলেন। আমি উৎসাহিত হলাম। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। এরপর আহসান হাবীব মোহাম্মদী ও সওগাত পত্রিকায় আমার কবিতা ছাপলেন। আমি ঢাকার তরুণ কবিদের কাব্য এবং ত্রিশের কবিদের কবিতাগুলো পড়ে ফেললাম। জীবনানন্দই আমাকে টানল বেশি। আমি ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি ও আমেরিকান ইনফরমেশন সার্ভিস লাইব্রেরিতে গিয়ে ইংরেজি কবিতা পড়া শুরু করলাম। টি. এস. এলিয়টসহ কয়েকজন ইংরেজ কবির কবিতা মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। মার্কিন কবি স্টিফেন ক্রেন ও আরবি কবি কাহলিল জিবরানের সংলাপধর্মী কবিতা আমাকে অভিভূত করল। এই পঠন-পাঠন ও অনুশীলন থেকে, আমার উপলব্ধি থেকে তাগিদ এল নতুন ধরনের বাংলা কবিতা লেখার।


এম আবদুল আলীম : আপনার প্রথম কবিতার বই ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’র কবিতাগুলোয় কী কী বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছিলেন?
ওমর আলী : এ কাব্য রচনার প্রধান বিষয় ছিল প্রেমসৌন্দর্য। এছাড়া প্রকৃতি ও নারীকে আমি গুরুত্ব দিয়েছি। তবে বাস্তব রমণী আমি তখনও পাইনি। কাল্পনিকভাবে একটি নারীকে কেন্দ্রবিন্দুতে এনে তার স্বরূপ তুলে ধরেছি। যে প্রিয়তমাকে কাব্যটি উৎসর্গ করেছি সে ছিল কাল্পনিক।


এম আবদুল আলীম : আত্মপ্রকাশকালে আপনি কোনো কবির দ্বারা কি প্রভাবিত হয়েছিলেন?
ওমর আলী : হ্যাঁ, নরেশ গুহ, আমেরিকান কবি স্টিফেন ক্রেন, আরবি ভাষার কবি কাহলিল জিবরান —এঁদের কবিতা আমাকে প্রভাবিত করেছিল। আর বিশেষ করে, তখনকার পশ্চিমবঙ্গের তরুণ কবিদের কবিতার বই আমি কিনতাম। মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, মৃগাঙ্কু রায় —পুরনোদের মধ্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতাও আমার ভালো লেগেছিল। নরেশ গুহ আমাকে চিঠি লিখেছিলেন। বিশেষ করে, তাঁর ‘দুরন্ত দুপুর’ বইয়ের কবিতাগুলো আমার খুব ভালো লেগেছিল। ওই রকম লিখতে চেষ্টা করতাম। পরিচ্ছন্ন কবিতা আমি লিখতে পেরেছি।


এম আবদুল আলীম : আপনি তো তখন ঢাকায় থাকেন, ‘এক হাতে আঁতুড়ে শিশু অন্য হাতে রান্নার উনুন’ —এমন চিত্রকল্প কেন আপনার ভাবনায় এল
ওমর আলী : আচ্ছা, মানে, আমি তখন দেখলাম নজরুলের ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য’—এর মধ্যে কল্পনা বেশি। আমি চিন্তা করলাম বাস্তবতা নিয়ে কবিতা লিখতে হবে। নতুন ধরনের কবিতা। ওই সময় আমরা যারা লিখতাম, তারা প্রায়ই আরকি নতুন ধরনের চিন্তাভাবনা করে কবিতা লিখতাম।


এম আবদুল আলীম : আপনার ওই সময়কার কবিবন্ধুদের নাম বলুন।
ওমর আলী : আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন। তখন আল মাহমুদ ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওর বাসায় আমি থেকেছি। হোটেলে এক সাথে খেয়েছি। মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় আল মাহমুদ আমার থালার ভাত মাখিয়ে দিত। এই রকম বন্ধু। আমি প্রথম যে ফুলপ্যান্টটি পরেছিলাম, সেটি ওর। যদিও ছোট হয়েছিল, কারণ ও আমার থেকে বেঁটে ছিল।


এম আবদুল আলীম : ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ প্রকাশের পর সেই সময়ের পাঠক কেমন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল?
ওমর আলী : তারা এটাকে সাদরে গ্রহণ করে এবং বইখানা কেনে। তবে এত বেশি পাঠকপ্রিয়তা এ বইটি পাবে, আমি ভাবতেও পারিনি। এত সাফল্য আমার আসবে তা কল্পনাও করিনি। এমনকি মুনীর চৌধুরীর বাংলা বিভাগের যে আলমারি, আমি সেখানেও বইখানা দেখেছি। অধ্যাপক আবদুল হাই সাহেব রেডিওতে বইটির সমালোচনা করেছিলেন। পত্র-পত্রিকায় তেমন একটা আলোচনা হয়নি।


এম আবদুল আলীম : বইটি কোন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল? প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কে?
ওমর আলী : আমি ও আমার বন্ধু দেওয়ান আবদুল কাদির ওটি ছাপাতে গেলাম সাধারণ প্রেসে। তখন আরেক বন্ধু, কোহিনুর লাইব্রেরির মালিক সেটি দেখে বলল, বইটি আমি প্রকাশ করব। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। উনি তখন শান্তিনগরের ওইদিকে থাকতেন। অনেকদিন ঘুরে ঘুরে আমরা প্রচ্ছদটি এনেছিলাম। কালিঘাটের পট অবলম্বনে প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন, তাতে হরিণীর মতো একটি রমণী কলস ধরে আছে। পরবর্তীকালে মোস্তফা কামাল নতুনভাবে প্রচ্ছদ এঁকে বইটি প্রকাশ করেছিলেন, সেটা যে খুব ভালো হয়েছিল তা নয়; তবে নতুন ধরনের হয়েছিল।


এম আবদুল আলীম : ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’র পর আপনার অনেক কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু প্রথম কবিতার বইয়ে ওমর আলীর যে কবিত্বশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়, পরবর্তীকালের বইগুলোয় তা পাওয়া যায় না। কারণ কী?
ওমর আলী : তখন আমার বিবাহ হয়নি। কিন্তু বিবাহ হওয়ার পর আমার কবিতা একটু দুর্বল হয়ে যায়। আগেকার মতো আর থাকে না। ওই যে দৈনিক সংবাদের জহুর হোসেন চৌধুরী, এক সময় বলেছিলেন, আপনি তো বিয়ে করে এলেন, আপনার কবিতা শেষ হয়ে গেল। আপনি আর মনে হয় এ রকম কবিতা লিখতে পারবেন না। সত্যি কথাটিই বলেছিলেন জহুর ভাই। আমি তখন সংবাদের বার্তা বিভাগে চাকরি করতাম, নিউজ টেবিলে।


এম আবদুল আলীম : এই প্রকৃতি ও নারী তো জীবনানন্দ দাশের কবিতাতেও আছে। আপনার স্বকীয়তা কোথায়?
ওমর আলী : আমি জসীম উদ্দীন বা জীবনানন্দ দাশের পর নতুন ধারার কবিতা লিখেছি। মানুষ, প্রকৃতি, নদ-নদী, পাখি হুবহু এসেছে আমার কবিতায়। আমার স্বকীয়তা হল —খুব কাছে থেকে দেখে এগুলোকে কবিতায় স্থান দিয়েছি, কোথাও কৃত্রিমতা নেই। আমি কবিতায় এপিসোড ব্যবহার করি। যেমন চসার থেকে শুরু করে অনেকের সাহিত্য এপিসোড ব্যবহার করেছিলেন টি. এস. এলিয়ট। আমি রবীন্দ্রনাথ, লালন, বৈষ্ণব কবিদের কবিতা এবং বিভিন্ন সাহিত্য থেকে এপিসোড ব্যবহার করেছি।


এম আবদুল আলীম : দেখা যাচ্ছে বর্তমানে আপনি শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার করছেন, তাতে কোনও উৎকর্ষ নেই, নেই নিরীক্ষাও। যেমনটা প্রথম কবিতার বইয়ের কবিতাগুলোয় ছিল। এর কারণ কী? 
ওমর আলী : না, শোনেন, ওই যে ইংল্যান্ডে এক সময় ফ্রি-ভার্স আন্দোলন হয়েছিল, মানে সাধারণ মানুষের ভাষাকে কাব্যে স্থান দেওয়ার বিষয়। যেমনটি করেছিলেন কোলরিজ ও ওয়ার্ডসওয়ার্থ। আমি সেভাবে শব্দের ব্যবহার করেছি বাংলা কবিতায়। দেখলাম যে, আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারে বাংলা কবিতা সহজ ও আনন্দদায়ক হচ্ছে না। আমি চেষ্টা করছি, কীভাবে কবিতাকে সহজবোধ্য ও আনন্দদায়ক করা যায়। আমার মতো অনেকেই এটা করেছেন, আল মাহমুদ করেছেন। যারা পরিবর্তনে অভ্যস্ত নন, তারা ভাবেন, আমার কবিতায় শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। আমার তো মনে হয়, একটি শব্দও আমি বাহুল্য ব্যবহার করিনি।


এম আবদুল আলীম : আপনি এবং আল মাহমুদ যেভাবে যাত্রা শুরু করেছিলেন, আজকে কি বলতে পারবেন, আপনাদের সে অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে?
ওমর আলী : না, পরিবর্তন হয়ে গেছে। উপমার পরিবর্তন হয়েছে, উৎপ্রেক্ষার পরিবর্তন হয়ে গেছে।


এম আবদুল আলীম : আপনি লোকালয়ে এই নিভৃত পল্লিতে বাস করেন, এর কারণ কী? আপনি কি স্বেচ্ছাদারিদ্র্য বরণ করেছেন?
ওমর আলী : শহরের কোলাহল আমার ভালোলাগে না। যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়ায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। এখানে গাছপালা, পাখি ও নির্মল বাতাসের মধ্যে থাকি। স্বেচ্ছাদারিদ্র্য বরণ করিনি, আমি সরলতা পছন্দ করি, আড়ম্বরপূর্ণ জীবন পছন্দ করি না।


এম আবদুল আলীম : আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।
ওমর আলী : আমি ওমর আলী, আমার পূর্বপুরুষ কানাই প্রামাণিক। তাঁরা বিহার থেকে এদেশে আসেন। সেই বিহারের লোক আমরা। এখানে এসে বাঙালি হয়ে যাই। আমার পূর্বপুরুষরা কুষ্টিয়ায় আবগারি ব্যবসা করতেন। তারপর ওই কানাই প্রামাণিকের ছেলে উলি প্রামাণিক ও তাঁর মা চলে আসেন পাবনা জেলায়। উলি প্রামাণিকের ছেলে মালু প্রামাণিক আমার দাদা। উজির প্রামাণিক আমার বাবা। আমার তিন ছেলে চার মেয়ে। আমার জন্ম ১৯৩৯ সালেল ২০ অক্টোবর চরশিবরামপুর মাতুলালয়ে। লেখাপড়া শুরু চরঘোষপুরে। আমার লেখাপড়ায় প্রেরণা দিয়েছিলেন চাচা ইজিবর রহমান। কবিতা লেখার প্রেরণাও তাঁর কাছেই পেয়েছিলাম।


এম আবদুল আলীম : আপনাকে ধন্যবাদ।
ওমর আলী : আপনাকেও ধন্যবাদ।

[সংক্ষেপিত] 

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে