X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
শহিদ জননী ও জায়া আনোয়ারা বেগম

‘আমার বুক তো ছিঁড়া গেছে’

সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও ভূমিকা : বাশার খান
১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৩২আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৩৬

শহিদ জননী ও জায়া আনোয়ারা বেগম মারা যান ২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় তাঁর বাসা শান্তিনগরের চামেলি বাগে। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামে। তাঁর স্বামী শহিদ সিরু মিয়া ১৯৭১ সালে ছিলেন ঢাকার মোহাম্মদপুর থানার দারোগা। একমাত্র ছেলে কিশোর কামাল তখন পড়াশোনা করত মতিঝিল গভার্নমেন্ট হাই স্কুলে। সিরু মিয়া পাকিস্তান প্রশাসনের পুলিশ অফিসার হয়েও মুক্তিযুদ্ধের আগমুহূর্তের অসহযোগ আন্দোলনে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে। সতর্কতার সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদসহ শীর্ষনেতাদের কাছে পৌঁছে দিতেন পাকিস্তানি প্রশাসনের ষড়যন্ত্রের ভেতরকার খবর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সিরু মিয়া ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে পাঠান ও প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে আনা-নেয়ার দায়িত্বে নিযুক্ত হন। ২৬ অক্টোবর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার সীমান্তে সিরু মিয়া ও তাঁর একমাত্র ছেলে কামালসহ ধরা পড়েন রাজাকারদের হাতে। রাজাকাররা বাবা-ছেলেকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেয়। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলে প্রায় একমাস ধরে অকথ্য নির্যাতনের পর ২০ নভেম্বর ইদের দিন গভীর রাতে সিরু মিয়া ও কামালসহ ৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।
জেলে থাকাকালীন আনোয়ারা বেগম স্বামী ও একমাত্র ছেলেকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা-তদবির করেন। এমনকি গোলাম আযমের (তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জামায়াতের আমির ও শান্তি কমিটি, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু বাঁচাতে পারেননি। মা আনোয়ারার সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ নানা দিক। সাক্ষাৎকার গ্রহণ : ২৪ মে ২০১৭, বিকেল ৪টা থেকে ৫টা, চামেলি বাগ ঢাকা।



প্রশ্ন : মা, ১৯৭১ সালে আপনার বয়স কত ছিল?

উত্তর : আমার বয়স তখন ২৬ বা ২৭ বছর। আমার মেয়ে মেঘলা তখন আমার পেটে।


প্রশ্ন : বাঙালি মুসলমানের হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বিবর্ণ ও নিরানন্দের ইদ ছিল ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বরের ইদ। এই পবিত্র দিনে গভীর রাতে আপনার আদরের ধন কামাল ও স্বামী সিরু মিয়াসহ ৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলায় খালপাড়ে হত্যার করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সেই করুণ ও নৃশংস ঘটনার কথা কতটুকু মনে আছে আপনার?

উত্তর : ওখানে যে ৩৮ জনকে হত্যা করে, আমার ছেলে কামাল ও স্বামী ছাড়াও তাঁদের মধ্যে আরও ৪ জনকে আমি চিনতাম। ধরা পড়ার আগের দিন তাঁরা আমার বাসায় খাওয়া-দাওয়া করে যুদ্ধে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।


প্রশ্ন : বাকি ৪ জন শহিদের কারো নাম-পরিচয় কি মনে আছে আপনার?

উত্তর : দাউদকান্দি থানার বিএলএফ কমান্ডার নজরুল ইসলাম ছিল, কাশেম ও শফিউদ্দিনও ছিল। বাকি জনের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।


প্রশ্ন : আপনার কিশোর ছেলে কামাল ও স্বামীসহ আরও ৪ জন যেদিন আপনার বাসায় খাওয়া-দাওয়া করে বিদায় নেন, সেদিনের কোনো স্মৃতি কি মনে পড়ে?

উত্তর : আমার ছেলে কামাল আগে থেকেই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধ শুরুর আগেই ও দেশপ্রেম, দেশের অধিকায় নিয়ে নানান কথাবার্তা বলতো। তখন কামালের বাবা বলতো, ‘তুমি এখন ছোট। লেখাপড়ায় মন দাও। এগুলো বড়দের বিষয়। পলিটিক্স করার বয়স তোমার হয়নি’। ওর বাবা তো মোহাম্মদপুর থানার দারোগা। খুব রাজনীতি সচেতন ছিলেন উনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাওয়া-আসা করতো।

মার্চ মাসের শুরুতেই তো ঢাকায় থমথমে পরিস্থিতি। এই দিকে মিছিল, ঐদিকে মিছিল। পুলিশের গুলির খবরও আসতো। এসময় কামালের বাবা আমাকে বলে, ‘ছেলের দিকে খেয়াল রেখো। আমি তো আছিই। কামাল যেন মিছিল-মিটিং-এ না জড়ায়। ওকে বুঝাও।’ আমি কামালকে যতই বুঝাই ও তার পালটা যুক্তি দেয়।


প্রশ্ন : আপনার কথায় বোঝাই যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই থেকেই কিশোর কামাল রাজনীতি সচেতন ছিলেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণের দিন কামাল কোথায় ছিলেন?

উত্তর : সেদিন তাঁর বাবার সঙ্গে কামাল রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে ৭ মার্চের ভাষণ শোনে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ সিরু মিয়া দারোগা প্রশ্ন : ২৫ মার্চ আপনারা কোথায় ছিলেন? কী দেখলেন-শুনলেন?

উত্তর : সেদিন আমরা ঢাকার শান্তিনগরে চামেলি বাগের বাসায় ছিলাম। কামালের বাবা ছিল মোহাম্মদপুর থানায় ডিউটিতে। সন্ধ্যায় (রাত বাড়লে) উনি দৌড়ে বাসায় এসে বলেন, ‘পরিস্থিতি খুব খারাপ। তোমরা রেডি হও। তোমাদেরকে গ্রামে পাঠিয়ে দেব।’ আমি ও কামাল রেডি হয়ে সিঁড়ির কাছে যেতেই দৌড়ে কয়েকজন লোক আসে। তারা কামালের বাবাকে বলল, ‘আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। আপনি দ্রুত আসেন, আর্মি ঠেকাতে হবে।’ আমাদেরকে আপাতত বাসায় থাকতে বলে কামালের বাবা ওখান থেকেই লোকগুলোর সঙ্গে বেরিয়ে যায়। এরপরই গুলি শুরু হয়ে যায়। কারা যেন মাইকে বলতে থাকে, ‘আপনারা কেউ বাসার বাতি জ্বালাবেন না।’ এরপর পুরো শহরেই আর্মি বের হয়ে গেল। এ সময় কামালের বাবা বাসায় চলে আসে। দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। তখন চারপাশে দুনিয়া কাঁপানো গুলি ও বোমার শব্দ। আর্মি রাজারবাগে ট্যাংক নিয়ে আক্রমণ করে। আমাদের বাসা রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টারের পাশেই। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেও আক্রমণ করে। সারা রাত আমরা ঐভাবেই থাকলাম। ভোরে কামালের বাবা বলে, ‘দেখো পাকিস্তানিরা আমাকে চেনে-জানে। আমাকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করবে। তোমরা এখানে থাকলে কামালকেও ধরে নিয়ে যেতে পারে।’ আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম, ‘চুপ করো। এ কথা বলো না।’

২৬ মার্চও গোলাগুলি হলো। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল করে পাকিস্তানি আর্মি। তখন কামালের বাবা আমাদের গ্রামের বাড়ি (কুমিল্লার হোমনা উপজেলার রামকৃষ্ণপুর গ্রাম) পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে বলল, ‘তোমরা যাও। আমি বঙ্গবন্ধুর খবর জেনে আসি।’ এরপর কয়েকজন লোকের সঙ্গে বের হয়ে গেলেন।


প্রশ্ন : এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে গ্রামের উদ্দেশ্যে কীভাবে গেলেন? পথে কী দেখলেন?

উত্তর : আমরা প্রথমে খিলগাঁওয়ে যাই। সেখানে আমার বোন মায়ার বাসা। যেতে যেতে পুরো রাস্তায় দেখলাম, এখানে-সেখানে লাশ পড়ে আছে। আমার বোন আমাদেরকে দেখে কান্না শুরু করে। সে ভেবেছিল, আমাদেরকে মেরে ফেলছে। ও বলল, ‘দুলা ভাই কোথায়?’ আমি বললাম, ‘রাতে খিলগাঁও আসবে বলছে।’ আমরা শনিবার সারাদিন বোনের বাসায়ই থাকলাম। রাতে কামালের বাবা আসে এবং বলে, ‘বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। তাজউদ্দীন, কামরুজ্জামান সাহেবসহ সব নেতারা পালিয়ে আছেন।’

এরপর আমরা অনেক কষ্টে হাঁটতে হাঁটতে মুরাদনগরের রামচন্দ্রপুর আমার বাবার বাড়িতে যাই। রামচন্দ্রপুর পৌঁছতে রাত হয়ে যায়। ওখান ৭/৮ দিন থেকে কামালদের বাড়ি হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর যাই।


প্রশ্ন : বিভিন্ন উৎস থেকে যে তথ্য পেয়েছি, তা হল—আপনার স্বামী ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তৈরি করা এবং তাদেরকে ভারতে আনা-নেয়ার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন।

উত্তর : হ্যাঁ, উনি তো হোমনা পৌঁছেই যুবক ছেলেদেরকে সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আলাদা ঘর তৈরি করেন। শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, অনেক শরণার্থীকেও তিনি নিরাপদে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার ব্যবস্থা করতেন। বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা হয়ে সীমান্ত পাড় করে দিতেন শরণার্থীদের। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তৈরি করা ঘরে আশ্রয় দিতেন, খাওয়াতেন। কয়েকমাস ধরে উনি এই কাজই করতে থাকলেন।


প্রশ্ন : প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন ও তাঁর ছেলে-মেয়েদেরকেও সীমান্ত পাড় করে দিয়েছিলেন আপনার স্বামী?

উত্তর : হ্যাঁ, জোহরা তাজউদ্দীন ও তাঁর সন্তানদের নিয়ে আমার স্বামী খুব ভয়ে ছিলেন। জোহরা তাজউদ্দীন তো পরিচিত, অনেকে চিনে ফেলতে পারে, তাই তাঁকে আমাদের ঘরে রাখেননি। কারণ আমাদের ঘরে লোকজনের আসা-যাওয়া ছিল। কেউ যাতে টের না পায়, গোপন জায়গায় নিয়ে তাঁদেরকে রাখেন। হোমনা থানাও তো বেশি দূরে না। জানতে পারলে জোহরা তাজউদ্দীনকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাওয়ারও ভয় ছিল। এরপর কামালের বাবা সুযোগ বুঝে তাঁদেরকে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। অনেক কষ্টে নৌকায় এই নদী সেই নদী পার হয়ে সীমান্ত পার হন। তাজউদ্দীন সাহেবের ছেলে সোহেল তাজ তখন কোলের শিশু। হাঁটার পথগুলোতে কামালের বাবা সোহেল তাজকে কোলে রাখতেন। জোহরা তাজউদ্দীন ভয়ে কান্না করেছিল সেসময়। তখন কামালের বাবা বলে, ‘ভাবি, আমি থাকতে আপনাদের কোনো ভয় নাই।’ অনেক কষ্ট করেই কামালের বাবা তাজউদ্দীন সাহেবের পরিবারকে ভারতে পৌঁছে দেন।


প্রশ্ন : তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারকে ভারতে পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে আপনার স্বামী সিরু মিয়া দারোগার অকৃত্রিম সহযোগিতার কথা তাঁর মেয়ে শারমিন আহমদ রচিত ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। সেখানে সীমান্ত পার হওয়ার তারিখ লিখেছেন ২৫ মে। তাজউদ্দীন আহমদের আরেক মেয়ে সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমির স্মৃতিকথায়ও আপনার স্বামীর সহযোগিতার প্রসঙ্গটি কৃতজ্ঞাচিত্তে তুলে ধরেছেন। মে মাসের পর আপনার স্বামীর কার্যক্রম কী ছিল?

উত্তর : এরপর কামালের বাবা একই কাজ করতে লাগলেন। ভারতে যায়। আবার আসে। আবার যায়। একদিন ভারত থেকে এসে বলে, ‘আমি ভারতে কাজে যোগদান করেছি।’ আমি বললাম, ‘কীসের কাজে যোগদান করেছেন?’ বলল, ‘মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজে।’ তখনও মুক্তিবাহিনী আমাদের ঐ ঘরে আসতো-যেত। খাওয়া-দাওয়া করতো। কয়েক মাস পর তো ধরা পড়ে গেল।


প্রশ্ন : ধরা পড়ার আগে আপনার স্বামী ও ছেলে কামাল যেদিন ভারতের উদ্দেশ্যে আপনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যান, তখন আপনাকে কিছু বলে গিয়েছিলেন?

উত্তর : কামালের বয়স তখন ১৪ বছর। দেখতে খুব লম্বা ছিল। সে মতিঝিল গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ত। ছোট বলেই কামালকে আমি এতদিন যুদ্ধে যেতে দেইনি। নানাভাবে বুঝিয়ে অনেকটা জোর করেই তাকে আটকে রাখতাম। অক্টোবর মাসে ওর অবস্থা এমন হল যে, ওকে আর রাখাই যাচ্ছে না। ও যুদ্ধে যাবেই। ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নেবে। মুক্তিযুদ্ধ করবে। আমার কোনো কথাই শুনছিল না।

যাওয়ার দিন কামাল আমাকে একটা কাগজ আর একটা কলম এনে দিয়ে বলে, ‘আম্মা, লেখো (কান্না)।’ আমার খালাতো ভাই মুক্তিযোদ্ধা মনির ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার ছিল। কামাল বলল, ‘আম্মা, তুমি মনির মামার কাছে লেখো যে, কামালকে ট্রেনিং করার জন্য পাঠালাম।’ আমি তখন কান্না শুরু করলাম। কিন্তু কামাল যাবেই। ওকে আটকানো যাবে না বুঝতে পেরে কিছুক্ষণ বকা দিলাম। পরে কামালের জোড়াজোড়িতে লিখলাম, ‘ভাই মনির, একমাত্র ছেলে কামালকে আর রাখতে পারলাম না। ও দেশের জন্য যুদ্ধ করবেই। তাই অরে ট্রেনিংয়ের জন্য দিয়ে দিলাম (কান্না)।’ কামাল তখন চিঠিটা হাতে নিয়েই হেসে ওঠে।


প্রশ্ন : তাঁরা ভারতের উদ্দেশ্যে কখন রওয়ানা হয়?

উত্তর : রাতে সবাই খাওয়া-দাওয়া করে একটি নৌকা করে রওয়ান হয়। এই যাওয়া যে তাঁদের শেষ যাওয়া, বুঝতে পারিনি। কামালের জন্য মন কাঁদতো। পরের দিন শুনি মুক্তিবাহিনীর ৬ জন ধরা পড়ছে। এদের মধ্যে কামালের বাবা, কামাল ও নজরুলও আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার রাজাকার তালেব টাকার বিনিময়ে এতদিন নজরুল ও কামালের বাবাকে লোকজন সীমান্ত পারাপার করার সুযোগ করে দিতো, সেই তালেবই তাঁদেরকে ধরিয়ে দেয় বলে শুনতে পাই।


প্রশ্ন : কামাল ও তাঁর বাবার ধরা পড়ার খবর কখন কীভাবে পেলেন?

উত্তর : লোকে বলতে থাকে, সিরু দারোগা ও তাঁর ছেলে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছে। এরপর আমার চাচা শ্বশুরের ভাশুর খোঁজ নিতে যায়। উনিও এসে বলেন, ৬ জন ধরা পড়ছে। ঐদিনই খবর পাই। আমার চাচা শ্বশুর বাজারে গিয়ে শুনতে পান, ৬ জন ধরা পড়ে গেছে।


প্রশ্ন : পরে আপনি তাঁদেরকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য অনেক চেষ্টা করেন। জামায়াতের আমির গোলাম আযমের সঙ্গেও দেখা করেন?

উত্তর : অনেক চেষ্টা-তদবির করেছি। গোলাম আযমের কাছে আমি যাইনি। আমার বোনের স্বামী মহসিনকে পাঠাই। মহসিন গোলাম আযমের কাছ থেকে চিঠি লিখিয়ে এনেছিল। মহসিন স্কুলশিক্ষক ছিল। সে গোলাম আযমের দুই ছেলেকে প্রাইভেট পড়াতো।


প্রশ্ন : চিঠিতে গোলাম আযম কী লিখেছেন? চিঠি খুলে কি আপনারা দেখেছিলেন?

উত্তর : না, দেখি নাই। এই চিঠি নিয়ে মহসিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলে জমা দেয়।


প্রশ্ন : তারপর?

উত্তর : ঈদের আগে আমার ভাইরে পাঠাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলে। জেল থেকে আমার ভাইকে জানানো হয়, আমার স্বামী সিরু মিয়া দারোগাকে ছাড়া হবে না। কামালকে ছেড়ে দেবে। আরও জানায়, ইদের দিন বা ইদের পরের দিন যেন কামালকে এসে নিয়ে যায় কেউ।


প্রশ্ন : ইদের আগে জেল থেকে পাঠানো কামালের ঐতিহাসিক চিঠিটি কীভাবে পান আপনি?

উত্তর : ইদের কিছুদিন আগে কামাল এক লোককে দিয়ে গোপনে আমার কাছে চিঠি লিখে পাঠায়। চিঠিটা লিখেছিল সিগারেটের ঠোঙার ভেতরে থাকা কাগজে। ঐ লোকটা চিঠিটা হোমনায় রামকৃষ্ণপুর আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। তখন তো আমি বাড়িতে নাই। ঢাকা আসছি গোলাম আযমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আমাকে না পেয়ে ঐ লোকটা চিঠিটা বাড়িতে রেখে যায়। পরে আমি বাড়িতে গিয়ে কামালের চিঠিটা হাতে পাই।

আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ কামাল
প্রশ্ন : ঐ চিঠি তো এখন ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে’ আছে।

উত্তর : কিছু দিন আগে কামালের চিঠি ও জামাকাপড় পুলিশ জাদুঘরের লোকজন এসে নিয়ে গেছে। আমি দিতে চাই না, কইছে, যত্নে থাকবো। তাই দিছি।


প্রশ্ন : কামাল হৃদয়ছোঁয়া ও আবেগঘন ভাষায় চিঠিতে সবাইকে ইদ মোবারক জানায়। ইদের দিন কামালকে আনতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলে কাকে পাঠিয়েছিলেন?

উত্তর : কামালকে আনতে ইদের পরের দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাঠাই আমার ভাই ফজলুকে। কিন্তু... (কান্না) কামালকে তো দেয় নাই। কামালের জামা-কাপড় দিছে। আমার স্বামীসহ সবাইরে রাত্রেই মাইরা ফেলছে... (কান্না)। আমার বুক তো ছিঁড়া গেছে। আমি কই, যেখানে মারছে, আমি সেখানে যামু। আমারে সবাই ধইরা রাখছে, যাইতে দেয় নাই। কেউ আমারে নিয়াও যায় নাই (কান্না)।


প্রশ্ন : আপনি শান্ত হোন মা। ইদের পবিত্র রাতে আপনার ছেলে ও স্বামীসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলে বন্দি ৩৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। তাঁদেরকে হত্যা করে কোথায় ফেলে দিয়েছিল, পরে কি জানতে পেরেছিলেন?

উত্তর : তখন জানতে পারিনি। পরে শুনছি।


প্রশ্ন : শহিদ জননী ও জায়া হিসেবে সরকারি কোনো সম্মাননা বা সহযোগিতা পেয়েছেন?

উত্তর : কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে পাঁচ লাখ টাকা প্রদান করেছেন।


প্রশ্ন : শহিদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে মাসে ৩০ হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা প্রদান করছে সরকার। আপনি সে ভাতা পাচ্ছেন?
উত্তর : না।


প্রশ্ন : বলেন  কী!

উত্তর : ভাতা পেতে হলে অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। আমার একমাত্র মেয়ে ছাড়া কেউ নাই। এত সব কাজ কে করে দেবে, বাবা?

(সংক্ষেপিত)

 

 

জেড-এস
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার, নদীতে ঝাঁপিয়ে পালালো পাচারকারীরা
ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার, নদীতে ঝাঁপিয়ে পালালো পাচারকারীরা
তীব্র গরমে কাজ করার সময় মাথা ঘুরে পড়ে দিনমজুরের মৃত্যু
তীব্র গরমে কাজ করার সময় মাথা ঘুরে পড়ে দিনমজুরের মৃত্যু
বাংলাদেশে সামাজিক বিমা প্রবর্তনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে: মন্ত্রিপরিষদ সচিব
বাংলাদেশে সামাজিক বিমা প্রবর্তনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে: মন্ত্রিপরিষদ সচিব
ট্রাকের চাকায় পিষে দেওয়া হলো ৬ হাজার কেজি আম
ট্রাকের চাকায় পিষে দেওয়া হলো ৬ হাজার কেজি আম
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড