X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এই খেলাঘর আমি পেতেছিনু...

মাহমুদ শাওন
২৫ জুলাই ২০১৭, ১২:৪২আপডেট : ২৫ জুলাই ২০১৭, ১২:৪৫

এই খেলাঘর আমি পেতেছিনু... আমার ধারণা কথাশিল্পী মাহমুদুল হক সারাজীবন তাঁর বিভিন্ন উপন্যাস ও ছোটগল্পে প্রকৃত প্রস্তাবে একটি দীর্ঘ লেখাই লিখতে চেয়েছেন। কিংবা একটি লেখাই তিনি লিখেছেন, শুধু লেখাগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন বইয়ে বিভিন্ন করেছেন। খেলাঘর সেই দীর্ঘ রচনার একটি খণ্ডিত অংশ।

পৃথিবীটা এমন এক খেলাঘর, যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত তার স্বপ্ন ও সাধের ঘর তৈরি করে আর সময় সে ঘর ভেঙে দেয় তার মতো করে। খেলাঘর উপন্যাস বা চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কয়েক দিনে এক নারীর ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনা, তার স্বপ্ন-আশা ও ভালোবাসায় সাজানো খেলাঘর বারবার ভেঙে পড়ার মধ্য দিয়ে এ উপন্যাস বা চলচ্চিত্রের ইতি।

উপন্যাস ও চলচ্চিত্র ভিন্ন ভিন্ন শিল্পমাধ্যম। উভয়ের ভাষা, আঙ্গিক, প্রকাশক্ষেত্র যে ভিন্ন তা বলাই বাহুল্য। ফলে শিল্পের এই দুই মাধ্যমের পার্থক্য নিয়ে কোনো কথা চলে না। যদি কথা চলে তবে তা হলো এদের ঐক্য নিয়ে। একজন লেখক ও পরিচালক উভয়ই শিল্পীত মানুষ। এবং পৃথিবীর সব শিল্পীত মানুষের মধ্যে কোথাও না কোথাও চেতনার ঐক্য থাকে। ফলে কথাশিল্পী মাহমুদুল হকের সৃষ্ট চরিত্র ও চরিত্রের মনোভাষার সঙ্গে খেলাঘর চলচ্চিত্রের পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বোঝাপড়া ছিল চমৎকার। বিশেষ করে রেহানা চরিত্রে সোহানা সাবার অভিনয় দীর্ঘদিন দর্শকের মনে থাকবে। তার অভিব্যক্তি, উচ্ছ্বলতা, অকপটতা, ডায়ালগ থ্রোয়িং দেখে বারবার বইয়ে পড়া সেই রেহানাকেই (কিংবা টেপি কিংবা লতা কিংবা গাব্বু কিংবা আন্নাকে) দেখতে পাই। যেন এইমাত্র বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসে একটি চরিত্র জীবন্ত মানুষের মতো কথা বলছে! বুঝি ওই মেয়েটিই রেহানা। চরিত্রকে ঠিক কতটা গভীরভাবে অনুধাবন করলে বা হৃদয়ে ধারণ করলে একটি চরিত্রকে এভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়, জানি না।

ছবিটি শুরু হয় এভাবে, সবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে ভিটেমাটি ছাড়ছে কেউ কেউ। মুকুল চন্দ্র ও তার বন্ধুরা ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য। তাই দূর কোনো গ্রামে বা শহরে কোনো মিলিটারি ও তার এ দেশীয় দোসরদের কিছু দুঃসংবাদ পেলে তাদের আনন্দের আর সীমা থাকে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে আসা ইয়াকুবের কাছে বন্ধু মুকুল চন্দ্রের উচ্ছ্বাসকে অতিরিক্ত মনে হয়, মনে হয় বাড়াবাড়ি। মুকুল চন্দ্র গ্রামের স্কুলমাস্টার। যাত্রাপালা করেন। মিঠু সারের ঝিলের পাশের পরিত্যক্ত আদিনাথের ভিটেবাড়িতে থাকেন। ইয়াকুবও গ্রামের কলেজে পড়ান। স্বভাবে নম্র-ভদ্র। একদিন ইয়াকুবের বন্ধু টুনু তাকে চিঠি লেখে এবং সঙ্গে একটি মেয়েকে পাঠায়। টুনু লিখেছে, ‘রেহানা আমার চাচাতো বোন; নিজের হেফাজতে রাখিস। কতকগুলো কারণে ওকে ঢাকা থেকে সরিয়ে দিতে হলো। সাক্ষাতে সব কথা বলব। তোকে একটু জ্বালাতন সহ্য করতে হবে, দেশের যে অবস্থা তাতে এই জ্বালাতনটুকু খুব বেশি কিছু নয়, এর চেয়ে দেশের মানুষ অনেক বেশি সহ্য করছে, অনেক বেশি। যত শিগগির সম্ভব আমি এসে যাব, তখন তোর ছুটি। ও খুব ভালো মেয়ে, ওকে ভুল বুঝবি না; সব মানুষের জীবনে একবার না একবার পরীক্ষা আসে, মনে করবি আমাদেরও সেই রকম দিন এসেছে। শিগগির আসছি।’

রেহানার অনেক নাম- ‘দাদাভাই ডাকত ঝুমি, দিদামণি ডাকত আন্না, মামা ডাকত গাব্বু, স্কুলের মেয়েরা ডাকত টেপি। সখী পাতিয়েছিলাম একজনের সঙ্গে, সে নাম দিয়েছিল লতা। ...একবার ইস্কুলের একটা ছেলে আমাকে চুপি চুপি ডেকে নিয়ে বলল, তুই যদি প্যান্ট খুলে দ্যাখাস, তোকে শনপাপড়ি কিনে খাওয়াব। বললাম, আগে কিনে দাও, তারপর। ওর নাম ছিল ভোঁদা। এক দৌড়ে শনপাপড়ি কিনে আনল ভোঁদা। বদমায়েশের হাড্ডি। সেই থেকে সে আমার নাম চালু করে দিল শনপাপড়ি।’ তো এই মেয়েটি খুব উচ্ছ্বল আর অকপট। একটু অন্য ধাঁচের, অনেক কিছুরই ধার ধারে না। এক ধরনের শিশুতোষ সরলতা মাখানো সুন্দর সরল মুখ তার। কথা দিয়ে অন্যকে বিব্রত করতে খারাপ লাগে না রেহানার। তো তাকে রাখা হয় ভোলানাথ কবিরাজ বাড়িতে। একান্নবর্তী পরিবার। রেহানার সমবয়সী চার-পাঁচজন মেয়েও আছে সে বাড়িতে। কিন্তু সেখানে ভালো লাগে না রেহানার। বাড়ির সবাই তার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করলেও রেহানার অস্বস্তি লাগে। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে ওঠে। অগত্যা ইয়াকুব তাকে নিয়ে ওঠে আদিনাথের ভিটেবাড়িতে।

এখানে আসার পর রেহানাকে তার স্বরূপে চেনা যায়। চারপাশে নির্জন, গাছপালাবেষ্টিত প্রকৃতির মাঝে সে যেন তার ফেলে আসা দিনে ফিরে ফিরে যায়। ছেলেবেলার সখী লতার কথা, বাবুর কথা, দাদুর কথা বলতে বলতে আমরাও পেছন ফিরে তাকাই। দেখি, বাবু-লতা-পাতা-দাদুকে ঘিরে তার সাজানো খেলাঘর। দেখি, ইস্টিমার দেখার জন্য লতা-পাতা আর বাবু ছুটে যাচ্ছে রূপসার দিকে। আবার পাতার প্ররোচনায় রূপসার বুকে ঢিল ছুড়ে মারছে তারা। দাদুর জন্য ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথে ঝুমি। সে মালা গলায় জড়িয়ে দাদুর বুক হুহু করে ওঠে। সংসারের সব মায়া ত্যাগ করে একদিন সেও যে বিগত হয়ে যাবে, আর পেছনে পড়ে থাকবে তার আজীবন আগলে রাখা খেলাঘর! এসব বলতে বলতে রেহানার চোখ (অথবা ঝুমির চোখ) ছল ছল করে ওঠে। বর্তমান নিয়ে রেহানার কোনো গল্প নেই, আগ্রহ নেই। তার সব কিছু জুড়ে কেবল ছেলেবেলা।

ছবিটি দেখলে কিছু জায়গায় খুব তাড়াহুড়া মনে হবে। কিছু কিছু ঘটনা ও চরিত্রের যে বিস্তৃতি আমরা উপন্যাসে দেখি, সে বিস্তৃতি চলচ্চিত্রে দেখা যায় না। বিশেষ করে ভোলানাথ কবিরাজের বাড়ি থেকে রেহানাকে যে কারণে নিয়ে আসতে হলো তা যেন কিছুটা তাড়াহুড়ায় প্রকৃত কারণ থেকে একটু সরে যায়। আবার রেহানার দাদার চরিত্রটিকে শুধু একটি দৃশ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। যাহোক, যেহেতু পুরো উপন্যাসটি রেহানাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত, তাই তার কোনো বিষয় যাতে উপেক্ষিত না হয়, বাদ না পড়ে, তা সচেতনভাবে তুলে ধরার জন্য অন্য চরিত্রগুলোকে ঠিক যতটুকু আনা প্রয়োজন, পরিচালক ততটুকুই এনেছেন। আর এ কারণেই চলচ্চিত্রের দর্শক ইয়াকুবের বন্ধু ‘টুনু’ সম্পর্কে বেশি কিছু জানতে পারে না। তার ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ সম্পর্কে দর্শকের অজানা থেকে যায়। তা থাকুক, চলচ্চিত্রটি তাতে কিছুমাত্র সমন্বয়হীন হয় না।

চলচ্চিত্রের শেষ দিকে এসে জানা যায় রেহানার আশ্রয় নেওয়ার কারণ, যখন টুনু এসে হাজির হয়। তত দিনে রেহানার মানসিক আশ্রয়ের জায়গাটিতে অবস্থান নিয়েছে ইয়াকুব। ইয়াকুবকে ঘিরে মনে মনে গড়ে তুলেছে আরো একটি স্বপ্নের খেলাঘর। কিন্তু সেই খেলাঘর ভাঙতে সময় নেয় না। টুনু জানায়, রেহানা মানসিকভাবে অসুস্থ। ২৫ মার্চ রাতে রোকেয়া হল থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায় আর্মিরা। ক্যাম্পে বন্দি রাখে। কয়েক দিন পর মুমূর্ষু অবস্থায় ছাড়া পায়। আরো জানায়, শৈশবে আর একজনের হাত ধরে পালিয়ে যায় রেহানার মা। লজ্জায়, পরাজিতের মতো আত্মহত্যা করে তার বাবা। সব শুনে চুপ থাকতে পারে না ইয়াকুব। হুহু করে ওঠে। পেছনে এসে দাঁড়ায় রেহানা। আড়াল থেকে টুনুর সব কথা শুনেছে সে। টুনুর বুকের শার্টটি ধরে চিৎকার করে ওঠে রেহানা, ‘কী সব বলছিলি তুই। আমি তোর কী ক্ষতি করেছিলাম? কেন তুই ওকে কাঁদালি? কে তোকে আসতে বলেছে, কে?’ যেন ওর জীবনের এই গল্প বলাতেও ওর কোনো ক্ষোভ নেই, দুঃখ নেই; কিন্তু এই ঘটনা ইয়াকুবকে যে আহত-বন্যায় ভাসিয়েছে তার জন্য টুনুকে সে ক্ষমা করতে পারছে না, নিজেকেও না। তাই সব আবেগকে দূরে ঠেলে, সব বন্ধন-মায়াকে আমল না দিয়ে টুনুর সঙ্গে এক্ষুনি চলে যেতে উদ্যত হয় রেহানা। পেছনে পড়ে থাকে কয়েক দিনের, কিছু মুহূর্তের আশ্চর্য খেলাঘর! রেহানাদের নৌ-যাত্রার দিকে একঘেয়ে চেয়ে থাকে ইয়াকুব।

মাহমুদুল হকের লেখাকে শুধু সুখপাঠ্য বললে অবিচার করা হবে। এই লেখকের নিজস্ব ভাষার এক মহৎ কাব্যিক ব্যঞ্জনা আছে। তাঁর লেখার অসংখ্য সংলাপ, দৃশ্য সবুজ পাপড়ি মেলে জাগে বুকের ভেতর। এত জীবন্ত, এত মায়াময়, এত ঘনিষ্ঠ সেইসব দৃশ্য- যা অনুকরণের প্রয়োজন হয় না, শুধু অনুধাবন করতে হয়। খেলাঘর চলচ্চিত্রের প্রতিটি সংলাপ, দৃশ্যের পরম্পরা, দর্শক শুরু থেকে শেষাবধি মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করে, করবে।

কথাশিল্পী মাহমুদুল হকের উপন্যাস অবলম্বনে খেলাঘর ছবিটির চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন মোরশেদুল ইসলাম। মনন চলচ্চিত্র প্রোডাকশন থেকে প্রচারিত খেলাঘর প্রযোজনা করেছেন কণা রেজা, মো. মোখলেছুল হক, হুমায়ুন কবির শিল্পী ও কাজী জাহিদুল ইসলাম। ক্যামেরায় ছিলেন এল. অপু রোজারিও। সংগীত পরিচালনা ও সম্পাদনায় ছিলেন যথাক্রমে ইমন সাহা ও রতন পাল।

চলচ্চিত্রে ইয়াকুবের চরিত্রে অভিনয় করেছে রিয়াজ। রিয়াজের অভিনয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাব প্রায় দুর্লক্ষ্য ছিল। আর মুকুল চন্দ্রের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন আরমান পারভেজ মুরাদ। টুনুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন গাজী রাকায়েত। আবুল হায়াত অভিনয় করেছেন দাদুর চরিত্রে। রেহানার চরিত্রে সোহানা সাবার অভিনয়ের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এই চলচ্চিত্রের দর্শকদের মনে দীর্ঘদিন দাগ কেটে থাকবে সাবা- এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কোনও রান না দিয়ে ৭ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ইন্দোনেশিয়ার বোলারের বিশ্ব রেকর্ড
কোনও রান না দিয়ে ৭ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ইন্দোনেশিয়ার বোলারের বিশ্ব রেকর্ড
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
ঢামেক হাসপাতালে কারাবন্দীর মৃত্যু
ঢামেক হাসপাতালে কারাবন্দীর মৃত্যু
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত