X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
উড়িষ্যার লোককথা : পর্ব- ৩

মাছের হাসি

অনুবাদ : দিদার মুহাম্মদ
২৭ জুলাই ২০১৭, ০৯:৪৫আপডেট : ২৭ জুলাই ২০১৭, ১৪:০৪

 

 

মাছের হাসি

এক রাজার এক সুন্দরী রাণী ছিল। তাদের এক পুত্রসন্তান ছিল। রাজকুমার ছিল খুব বুদ্ধিমান এবং শিল্পকলায় পারদর্শী। খুব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেই দিন যাচ্ছিল রাজার। কিন্তু সুখের দিন স্থায়ী হয় না। একদিন রাণী হোঁচট খেয়ে পড়ে বুকে দারুণ আঘাত পেলেন। রাজবৈদ্য সব করলো কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। রাণী মারা গেলেন।

রাণী হারানোর ব্যথা ছিল সান্ত্বনার অতীত। নিদারুণ শোকে, কষ্টে রাজা ম্রিয়মান হয়ে পড়লেন। তিনি রাণীকে ভুলতেই পারছিলেন না। তাই রাজসভাসদ আর অনুগ্রহপ্রার্থীরা তার বিবাহের জন্য যার পর নাই অনুরোধ করলো। রাজা শেষ পর্যন্ত তাদের অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে পারলেন না।

ছোটরাণী সৌন্দর্যের দিক দিয়ে প্রথম রাণীর থেকে কোন অংশে কম ছিল না। ছোটরাণী পিতৃরাজ্য ছেড়ে এই প্রাসাদে আসার পর অনেক পরিচারিকা তার সাথে সঙ্গ দিয়ে তাকে খুশি রেখেছে। আর রাজাও ধীরে ধীরে ছোটরাণীর সার্বক্ষণিক তৎপরতা আর ভালোবাসায় অতীতের কষ্ট ভুলে যেতে লাগলেন।

একদিন রাজা কী এক জরুরী বিষয় নিয়ে রাজপুত্রের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এরই মধ্যে এক জেলে প্রকাণ্ড এক মাছ নিয়ে হাজির হলো। রাজা খুশি হয়ে তাকে সঙ্গে সঙ্গে পুরস্কৃত করে আবার রাজকুমারের সঙ্গে কথা বলায় মন দিলেন। কিন্তু কী জানি কী হলো! হঠাৎ মাছটি উচ্চস্বরে হেসে উঠলো! এইভাবে কেন মাছটি হেসে উঠলো তার কারণ খুঁজে পেলেন না রাজা। রাজপুত্রকে বললেন, মাছের হাসির কারণ খুঁজে বের করতে আর তিনি মাছটিকে তার নিজের গোসলখানার বাথটবে রাখলেন।

রাজপুত্র বহু কায়ক্লেশ করেও মাছের হাসির কোন কূলকিনারা করতে পারলো না। একদিন সে খুব সাধারণ মানুষের বেশে পাশের ‍গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে সে এক বৃদ্ধ লোককে দেখলো গাছের ছায়ার বসে আছে কিন্তু তার মাথায় এটি ছাতা বাঁধা। রাজপুত্র বৃদ্ধকে ছায়ায় বসে মাথায় ছাতা বাঁধার কারণ জিজ্ঞেস করলো। বৃদ্ধ বললো, ‘বাবা, মাথায় শুকনো ডাল ভেঙে পড়তে পারে গাছ থেকে। হয়তো বা পাখিতে পায়খানাও করতে পারে। তাই ছায়ায় বসেও আমার মাথায় ছাতা।’

রাজপুত্র ভাবলো বৃদ্ধ নিশ্চয় খুব বুদ্ধিমান, হয়তো মাছের হাসির কারণটা ব্যাখ্যা করতে পারবে। কিন্তু সব কিছু বলার পর বৃদ্ধ জবাব না দিয়েই আস্তে করে উঠে হাঁটতে শুরু করলো। রাজপুত্রও তাকে অনুসরণ করলো। কিছু পথ যাবার পর বৃদ্ধ বললো, ‘আমি আসলে বেড়িয়ে ছিলাম আমার কন্যার জন্য উপযুক্ত বর খুঁজতে। কিন্তু পাইনি। আমার মনে হয় আমার মেয়ে তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে। আমার বাড়ি আসো। আমার সিদ্ধান্তটি আমার কন্যা ও স্ত্রীকে জানাই।’

আরো কিছুক্ষণ পর, বৃদ্ধ তার আবাদি জমি দেখিয়ে বললো, ‘এটা আমার জমি। আমার মেয়েকে বিয়ে করলে এর মালিক হবে তুমি।’ রাজকুমার বললো, ‘ভাল জমি কিন্তু এ জমির মা কোথায়?’ এই প্রশ্ন শুনে বৃদ্ধের খটকা লাগলো। ভাবলো ছোড়াটার মাথায় সমস্যা আছে নাকি!

তারা বৃদ্ধের বাড়িতে গিয়ে উঠলো। বৃদ্ধ বললো, ‘এই আমার বাড়ি।” রাজকুমার বললো, ‘বাড়িটি তো খুবই ভাল। কিন্তু দেখতে সুন্দর লাগছে না, কারণ এর স্বামী নেই।’ এবার বৃদ্ধ সত্যিই রুষ্ট হলো। ভাবলো ছোড়াটা গায়-গতরে সুপুরুষ দেখা গেলেও আস্তো একটা গাধা, নইলে কি আর এই সব বাজে প্রশ্ন করে? বৃদ্ধ কেবল মেয়েকে বললো, ‘ছোড়াটাকে কিছু হালকা নাস্তা-পানি দিয়ে বিদেয় কর।’ রাজকুমার কোন উত্তর না পেয়ে অগত্যা প্রাসাদের দিকে রওনা দিল।

রাজকুমার চলে যাবার পর বৃদ্ধ মেয়েকে বললো, ‘মা রে, আমিতো ভাবছিলাম এই ছোড়ার সাথে তোর বিয়ে দিবে। কিন্তু ওর যে মাথায় সমস্যা, আগাগোড়া পাগল। বলে কিনা আমার জমি ভাল কিন্তু জমির মা নেই, বলে কিনা বাড়িটা ভাল কিন্তু স্বামী নেই! এর মতো বলদার সাথে তোকে কেমন করে বিয়ে দিই, বল?’

কিন্তু মেয়েটি ছিল তীক্ষ্ণ ধীশক্তিসম্পন্ন। সে বৃদ্ধ বাবাকে বললো, ‘বাবা, তার কথাগুলো সঙ্গতই আছে। দেখো, একটি আবাদি জমির মা হলো পানি। সে যখন দেখলো জমির আশেপাশে কোন পুকুর বা অন্যকোন পানির ব্যবস্থা নেই তখন সে ঐ কথা বলেছে। আবার দেখো, বৈঠকখানা হলো একটি বাড়ির স্বামী। যে অতিথিই আসুক আমাদের বাড়ি, সে একবারে শোবার ঘরেই চলে আসে আর আমাদের গোপনীয়তার কিছুই থাকে না। সে-ই ঠিক। আমাদের ঘরের কোন স্বামী নেই।’

বৃদ্ধ বললো, ‘তাই নাকি! তাহলে তো আমারই ভুল! যাই তাহলে। ছোড়াটাকে ডেকে আনি।’ মেয়েটি বললো, ‘না বাবা, তার আর দরকার পড়বে না। সে যদি সত্যিই বুদ্ধিমান হয়ে থাকে, আমি যে মুড়ি-মড়কির পুঁটলি বেঁধে দিয়েছি ওটা খুললে আপনা আপনিই ফিরে আসবে।’

কিছুদূর যাবার পর রাজকুমার মুড়ি-মুড়কির পুঁটলিটা খুলেই দেখলো তাতে আছে একটি তরতাজা গোলাপ আর নিচে কিছু গোবর! এর কী অর্থ থাকতে পারে তাই ভাবতে লাগলো সে। শেষমেষ সে উত্তর পেয়ে গেলো। স্বয়ং মেয়েটিই হলো ঐ তাজা গোলাপ। সে এই গোলাপটি তার দেবতাকে নৈবেদ্য হিসেবে দিয়েছে। আর গোবর তো পবিত্রতার প্রতীক। অর্থাৎ মেয়েটি তাকে তার স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেতে চায়।

রাজকুমার বৃদ্ধের বাড়িতে ফিরে আসলো। সবাই তাকে স্বাগত জানালো। সে তার পরিচয় দিলো এবং মাছের হাসির কারণ জানতে চাইলো। মেয়েটি বললো, ‘মাছের হাসির রহস্যটি প্রাসাদেই লুকিয়ে আছে। প্রাসাদে গেলেই কেবল সেই রহস্য উদ্ধার করতে পারবো।’

রাজার অনুমতি নিয়ে রাজকুমার বৃদ্ধের মেয়েটিকে বিয়ে করলো। কৃষকের কন্যা হলো রাজার পুত্রবধূ। প্রাসাদে ফিরে পরদিন সকালেই মেয়েটি রাজকুমারকে বললো, পাঁচ হাত লম্বা আর দুই হাত চওড়া এক খন্দ কাটার জন্য। বলা হলো ছোটরাণীর যত পরিচারিকা আছে সবাইকে এর উপর দিয়ে লাফ দিতে হবে। একজন নারীর পক্ষে এটা পার হওয়া সহজ নয়। কোন পরিচারিকাই এটা এক লাফে পার হতে পারলো না। পারলো শুধু ছোটরাণীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত পরিচারিকাটি! এরপর রাজদরবারে তাকে আবার যখন পুরোপুরি নিঁখুতভাবে পরীক্ষা করা হলো; দেখা গেলো এই পরিচারিকাটি আসলে একটা পুরুষ, সে নারীর বেশ ধরে ছিল।

এই দেখে রাজসভাসদদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। পুত্রবধূ মেয়েটি এবার বললো, ‘মহারাজ! মাছটি এই লোকটিকে দেখেই হেসে ছিল। লোকটির পরিকল্পনা ছিল ছোটরাণীর সহায়তায় আপনাকে আর রাজপুত্রকে হত্যা করে আপনার রাজ্য দখল করা। মাছটি হেসে জানান দিয়ে ছিল যে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হবে।’

রাজা তদন্ত করলেন এবং এর সত্যতা পেলেন। রাজা ছোটরাণী আর ছদ্মবেশী পুরুষকে কঠিন সাজা উপহার দিলেন আর রাজপুত্রের হাতে রাজ্য পরিচালনার ভার অর্পণ করার কথা ঘোষণা দিলেন।

.........................................................................................................

আরো পড়তে ক্লিক করুন–

উড়িষ্যার লোককথা

রাজকুমারীর হস্তিস্বামী

বনকন্যা


 

অনুবাদ : দিদার মুহাম্মদ। আইসিসিআর স্কলার, মাস্টার অফ পারফর্মিং আর্টস (এমপিএ), ব্যাঙ্গালুর ইউনিভার্সিটি, কর্ণাটক, ভারত।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা