অপু মেহেদী। কবি ও নাট্যকার। জন্ম ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। শিক্ষা শেষ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কাজ করেন থিয়েটার গ্রুপ আরণ্যক নাট্যদলে। সম্পাদনা করেন সাহিত্যের ছোটকাগজ 'গারদ'। প্রকাশিত গ্রন্থ ২ টি- রবীন্দ্রনাথ এন্ড কোম্পানী (নাটক), ঘুমের প্রেসক্রিপশন (কবিতা)।
দ্বিতীয় দশকের কয়েক জন কবির কাব্য-ভাবনা ও লেখালেখি নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন সাহিত্যের এই আয়োজন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একই সময়ের কবি রাসেল রায়হান।
প্রশ্ন : আপনি তো থিয়েটারের সাথে যুক্ত?
উত্তর : হুম।
প্রশ্ন : পেশা নাকি শখ?
উত্তর : পেশাই বলতে পারেন।
প্রশ্ন : কবিদের জন্য পেশা হিসেবে এটা কতটা উপকারী?
উত্তর : থিয়েটারটা আমাদের দেশে এখনো পেশাদার হয়ে ওঠেনি। শুধু কবি কেন, কারও জন্যই খুব বেশি উপকারী নয়। পেশা হিসেবে পথটা এখনো অনিশ্চিত। তবে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।
প্রশ্ন : অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের সাথে কবিতার পার্থক্যটা কোথায়?
উত্তর : কবিতা এমন একটা শিল্পমাধ্যম- যার মধ্যে শিল্পের অন্য সকল বিষয় উপস্থিত। এখানেই পার্থক্য।
প্রশ্ন : আপনার যা কবিতা আমি পড়েছি, তাতে মনে হয়েছে আপনার পেশার কোনো প্রভাব কবিতাতে পড়েনি। সত্যিই কি যাপনের এই প্রক্রিয়া থেকে কবিতাকে আলাদা রাখা সহজ?
উত্তর : না ভুল। প্রভাব পড়েছে। এ নিয়ে আমি একটি প্রবন্ধ লিখছি, ‘কবিতায় থিয়েটার, থিয়েটারে কবিতা’ শিরোনামে। সেটা যখন প্রকাশ করব, তখন পড়লে হয়ত বুঝতে পারবেন।
প্রশ্ন : কবিতার সঙ্গে জীবনাচরণ, রাজনীতির দ্বন্দ্ব আছে কি না?
উত্তর : জীবনাচরণের দ্বন্দ্ব আছে। একজন কবি যা ভাবে নানা পারিপার্শ্বিক কারণে হয়ত তার পুরোটা তার জীবনাচরণে আনতে পারে না। তবে চাইলে কবিতায় তার পুরোটা আনতে পারে।
প্রশ্ন : আর সমাজে যে একটা ধারণা চালু আছে, কবিকে হতে হবে মহামানব- এই ধারণার ভিত্তি কী? আপনি কি একমত?
উত্তর : না একমত নই। মহামানব হতে হলে যে সকল গুণাবলী থাকা প্রয়োজন, পৃথিবীর কোনো বিখ্যাত কবির মধ্যেই আমি তা দেখি না।
প্রশ্ন : আচ্ছা। কবিতার বই তো এই একটাই আপনার? ‘ঘুমের প্রেসক্রিপশন’। একদিকে 'রবীন্দ্রনাথ অ্যান্ড কোম্পানী' নাটকের বই। ঘুমের পরে কী প্রেসক্রাইব করবেন? মানে নেক্সট বই কী আসবে?
উত্তর : হু, একটাই কবিতার বই। এ বছর আর কবিতার বই আসছে না এটা নিশ্চিত। তবে নাটক বা প্রবন্ধের বই হতে পারে।
প্রশ্ন : আপনার বইগুলো কতটা ব্যক্তি আপনাকে রিপ্রেজেন্ট করছে?
উত্তর : কতটা ব্যক্তি আমাকে রিপ্রেজেন্ট করে এটা আসলে বলা মুশকিল।
প্রশ্ন : ঠিক কিসের তাগিদে লিখছেন? যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনার কবিতা কী স্বাতন্ত্র্য নিয়ে এসেছে?
উত্তর : তাগিদ বলতে সাহিত্যের ক্ষুধাটাই প্রধান। আর আমার কবিতা কী স্বাতন্ত্র্য নিয়ে এসেছে তা এখনই মোটা দাগে বোঝানো সম্ভব নয়।
প্রশ্ন : কবিতা লেখার ক্ষেত্রে নিজের জগত নির্মাণের পদ্ধতিটা আপনার বেলায় ঠিক কেমন?
উত্তর : প্রত্যেক মানুষেরই একটি স্বতন্ত্র ভাবনার জগত থাকে। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কবিকে আলাদা করে নিজের জগত নির্মাণ করতে হয় বলে আমার মনে হয় না। কবির কবিতাই তার জগতকে প্রতিনিধিত্ব করে।
প্রশ্ন : সেক্ষেত্রে পাঠক কোনো কবিকে কাছে টানছে, কোনো কবিকে নিচ্ছে না। এখানে ঐ স্বতন্ত্র জগতের ভূমিকা কতটুকু?
উত্তর : ঐ জগতের ভাবনা যখন পাঠকের ভাবনার সাথে কিছুটা হলেও মিলে যায় এবং পাঠককে নতুন করে ভাবায় তখনই পাঠক কবিকে, মানে ঐ কবির কবিতাকে কাছে টানে।
প্রশ্ন : আচ্ছা, কবিতায় আপনি কিসের কথা বলতে চান? আদৌ কিছুর কথা বলতে চান কি না?
উত্তর : কবিতায় আমি আমার নিজের কথাই বলতে চাই। যে কথাগুলো Indivisual থেকে Universal-এ পরিণত হয়।
প্রশ্ন : কথাগুলো কীভাবে ব্যক্তিক থেকে বৈশ্বিক হয়ে উঠতে পারে? কোনো সূত্র আছে? ঠিক কিসের ভিত্তিতে বুঝতে পারেন?
উত্তর : অবশ্যই এর কোনো সূত্র নেই। কবির নিজের কথাগুলো যখন পাঠকের চিন্তার সাথে মিলে যায় তখনই সেটি বৈশ্বিক হয়ে ওঠে। সব কথাই যে বৈশ্বিক হয়ে ওঠে- তা নয়, তবে চেষ্টা থাকে। পাঠকের ফিডব্যাক থেকে তা আঁচ করা যায়।
প্রশ্ন : পাঠকের সাথে কবির সম্পর্ক ঠিক কিসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে?
উত্তর : চিন্তা ও তার প্রকাশের ভিত্তিতে।
প্রশ্ন : কবিতার পাঠক কমের একটা অভিযোগ কিন্তু পাওয়া যায়। এই অভিযোগের ভিত্তি কী? উত্তরণ সম্ভব কি না? কীভাবে?
উত্তর : কবিতা একটি Supreme Art. যে কোনো Supreme কিছুরই ধারক, বাহক বা পাঠক তুলনামুলক একটু কমই থাকে। কবিতার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়।
প্রশ্ন : কবিতায় শ্লীলতা-অশ্লীলতার একটা তর্ক শোনা যায়। এই শ্লীলতা-অশ্লীলতার সীমা ঠিক কতটুকু? কতটা শ্লীলতা অতিক্রম করে গেলে সেটাকে অশ্লীল বলা যেতে পারে? আদৌ বলা যেতে পারে কি না?
উত্তর : অশ্লীলতা আসলে একটা ধারণামাত্র। এটি ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে আলাদা। তবে এটি যেহেতু জীবন থেকে বিছিন্ন নয়, তাই কবিতা থেকেও নয়। তবে কবিতা যেহেতু একটা শিল্প, তাই কবিতায় তার উপস্থাপনটাও শৈল্পিক বা কাব্যিক হওয়া চাই। না হলে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রশ্ন : ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে আলাদা জিনিসের ক্ষেত্রেও সুবিধার্থে একটা মানদণ্ড আমরা ধরি। তো শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে বহু পানি ঘোলা করা হয়েছে, হচ্ছে, এজন্যই আরেকটা প্রশ্ন? এক্ষেত্রে কোনো মানদণ্ড আছে কি না?
উত্তর ; সাধারণত শ্লীলতা-অশ্লীলতার মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয় বিদ্যমান সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে। তবে কবিতা যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট সমাজের নয়, তাই কবিতার ক্ষেত্রে এই মানদণ্ড প্রযোজ্য নয়। কবিতার ক্ষেত্রে শৈল্পিকতা বা কাব্যিকতাই মানদণ্ড।
প্রশ্ন : প্রায়ই অভিযোগ করা হয়, অনেকে গ্রুপিং করে কবি হিসেবে টিকে আছে। এটা কি আসলে সম্ভব? সম্ভব হলে স্রেফ গ্রুপিং করে টিকে আছে, এমন দুয়েকজনের উদাহরণ দিতে পারবেন?
উত্তর : এটা আসলে বাজে কথা। গ্রুপিং করে হয়তো সাময়িকভাবে আলোচনায় আসা যায়। তবে টিকে থাকা যায় না।
প্রশ্ন : এই আলোচনায় থাকার মাহাত্ম্যই কতটুকু?
উত্তর : আমি কোনো মাহাত্ম্য দেখি না।
প্রশ্ন : না না। আপনাকে ঠিক বলছিও না। মানে যদি সাময়িক একটা আলোচনায় থাকাই হয় এইসব গ্রুপিং-এর ফলাফল, তাহলে কেন এই গ্রুপিং? এটা সাহিত্যের কোনো ক্ষতি করে কি না- আপনার কী মনে হয়?
উত্তর : এক্ষেত্রে কবিদেরই বেশি ক্ষতি হয়।
প্রশ্ন : ক্ষতিটা ঠিক কী রকম? একটু ব্যাখ্যা দেন, প্লিজ।
উত্তর : যারা গ্রুপিং করে তারা নিজেদের স্বার্থে একে অপরের পিঠ চাপড়ে দেয়, স্তুতি করে এবং নিজেরাই নিজেদেরকে সেরা বলে জাহির করতে থাকে। তারা কোনো আত্মসমালোচনা করে না। তাই তাদের আত্মউন্নয়নের সুযোগটা হারিয়ে যায়।
প্রশ্ন : বিভিন্ন দৈনিকে, অনলাইন নিউজ পোর্টালেও সাহিত্য বিভাগ থাকে। এই বিভাগটি সাহিত্যের কতটুকু উপকার করছে?
উত্তর : উপকার কখনো কখনো কিছুটা হয়তো করছে। তবে বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই তা শূন্য'র কোঠায়। তবে দৈনিক পত্রিকাগুলোর অনেক কিছু করার সুযোগ ছিলে, এখনো আছে।
প্রশ্ন : আর ছোটকাগজ? একসময় তো তাদের বেশ বড় একটি ভূমিকা ছিল। বর্তমানে ঠিক কী ভূমিকা রাখছে তারা?
উত্তর : ছোটকাগজ তার অবস্থান হারিয়েছে- এটা একবাক্যে বলা যায়। আসলে কোনো কিছুই তো চিরস্থায়ী নয়। তবে কেউ কেউ এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, এটা আশাব্যাঞ্জক।
ধন্যবাদ অপু।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
আরো পড়ুন-
বেঁচে থাকাই ক্ল্যাসিক : চঞ্চল মাহমুদ