X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একসঙ্গে সব গল্প

.
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৭:৪২আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৮:০৪

একসঙ্গে সব গল্প বর্ণানুক্রমে সজ্জিত


পুরুষ
।। অশোক দেব

মশারি কাচতে কার ভালো লাগে? লাগে না। কেবল ফেনা ওঠে। ভোর। রাতে মশারির থেকে একটা পুরুষ মানুষের গন্ধ পেয়েছিল সুলতা। সেটাকে সকালেই নিকেষ করতে হবে। এই ভেবে ঘুম হল না। ভোর হল। অনেক ডিটারজেন্টে চুবিয়ে দিয়েছে সেই মশারি সে। তর সইছিল না। ভালো করে ভিজে ওঠার আগেই কলতলা। সিমেন্টের একটা ছোট চাতাল। সেখানে ধপাস করে ফেলে সে। যেমন তাকে বিছানায় ফেলে দাদাবাবু। দাদাবাবুর লালাই সম্বল। ঘর মুছতে গেলেই লালা ঝরতে শুরু করে তার। সুলতা গন্ধ পায়। লালার গন্ধ। শরীর কী করলে সমুদ্র হয় সুলতা জানে। সুলতা জানে কখন বাতাস দিলে ঢেউ ওঠে শরীরে। দাদাবাবুর লালা ঝরে। পাঁচশো টাকার নোটগুলি এখন একশো টাকার থেকে ছোট। মোদী এসে ছোট করেছে। সুলতা জানে। দাদাবাবু একটা দেয়। সুলতা বসে থাকে মেঝেতে। সেখান থেকে তুলে তাকে বিছানায় ফেলে দাদাবাবু। তারপর সারা মুখ চাটে তার। লালায় লালায় ভরে যায় তার মুখ। সুলতা মিছে শীৎকার করে। দাদাবাবু নিভে যায় নিজে নিজে। সুলতা নিজেকে তোলে। বাড়ি চলে আসে। সুলতা বিধবা নয়। স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা পায়। পরিত্যাগের কারণ সুলতা ‘সেক্সি’। সে এমনকি কলাগাছের সঙ্গে শোয়। সেটা দেখেছে তার মাসি শাশুড়ি। ও পাড়ায় একটাই অর্জুন গাছ। তারও চরিত্রনাশ হল সুলতার কারণে। বালের চরিত্র। ও একদিন এমনি ভোরে চলে এলো। এখানে ভাড়া থাকে। টাকা দেয় না। এটা চাপরাশি বুড়ার বাড়ি। বুড়ার রান্না দেখভাল। বিনিময়ে থাকা। কিন্তু কাল রাতে জানালাটার মাসিক হল। রক্তাক্ত জোছনা গলগল করে ঘরে আসছিল। আর সুলতা পাচ্ছিল একটা পুরুষের গন্ধ। সেটা মশারির অযুত ছিদ্র দিয়ে আসছিল। সুলতা সত্য শীৎকার করছিল আর তরুণ বকুল গাছ বাড়িয়ে দিয়েছিল তার হাত জানালা দিয়ে। কিন্তু সে তো নিজেই নারী। বকুল। সুলতা সরে এসেছে। একটা হলুদ আলোর নিচে রাত কাটানো একটা নারী হয়ে গেল সুলতা। ভোরে সে মশারির ছিদ্রপথে চারিয়ে দিল দাদাবাবুর বাড়ির থেকে আনা দামি ডিটারজেন্ট। ফেনা। ফেনা। ফেনা। ফেনার তোড়ে গর্ত হতে উঠে এলো একটা কেঁচো। বিরাট। লতপতিয়ে সে সুলতার দিকে উঠে আসতে চায়। দাদাবাবুর ফেনার তোড়ে ফিরে যায়। সুলতা কল চাপে। জল পড়ে ফেনা কমে। জল পড়ে ফেনা কমে। এগিয়ে আসে দশাসই কেঁচো। লতপত করে সে। এমন গোঁয়ার, সে আসবেই। সুলতা কাপড় তুলে জায়গা করে দেয়। একটা জানালা খুলে দেয় সে। প্রতিটি কেঁচোর জীবন আসলে এরকম জানালায় শেষ হয়। সুলতা জানে। কেঁচো জানালা দিয়ে ঢোকে। সুলতা মিছে শীৎকার করে। ফেনা কমে। মশারির থেকে পুরুষের গন্ধ সুলতার শরীরে চলে আসছে। 


 

পাজুতো ।। আবু হেনা মোস্তফা এনাম

আমার একজোড়া জুতো ছিল।
মা বলে, জন্মের সময় পেট চিরে প্রথমেই বেরিয়ে এসেছিল আমার লালচেগোলাপি পা দুটো। আর আমার পা দেখে আনন্দে জ্ঞান হারাতে হারাতে মার চোখে অশ্রু।
সবাই বলেছিল, সম্পূর্ণ ‘আমি’র চাইতে আমার পা দুটোই নাকি সবচেয়ে সুন্দর, চঞ্চল। পায়ে পা ঘষছি, শূন্যে ছুড়ে দিচ্ছি, বাতাসে লাফিয়ে তখনই নাকি দৌড়ুচ্ছি।
পা শক্ত আর মজবুত করে হাঁটতে শেখার বয়সে মা আমার পায়ে ছাই রঙের জুতো পরিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে আমি আমার যৌবনের এই মধ্যবয়সে অনেক-অনেককাল যাপনের পরও জুতোজোড়া পা থেকে খুলিনি। আমার অনেকগুলো ভাইবোন আঁতুড়েই লাশ হয়ে গেলে আমিই ছিলাম বেঁচে। তাই মা আমাকে চোখের আড়াল করতে চায়নি কখনো। পথে পাথরের চোখা টুকরো, কাঁটা অথবা মরিচা ধরা পেরেক যেন আমার পায়ে ফুটে না যায়—এসব নিয়ে মায়ের ছিল রাজ্যের দুশ্চিন্তা। এভাবেই, সেই হাঁটতে শেখার কাল থেকে পা আর জুতোর মধ্যে পার্থক্যের বোধ আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। জুতোজোড়া পায়ের সঙ্গে এমনভাবে এঁটো থাকত, তারা যেন আমার পায়েরই জীবন্ত অংশ।
যেদিন প্রথম আমি ঘর ছেড়ে উঠোনে নামি, মাটির গন্ধ আর ধূলিরেণু আমার জুতোয় জড়িয়ে যায়। মাটির গন্ধ জুতোর ভেতর পা বেয়ে আমার শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। মাটির গন্ধের ভেতর লেগে ছিল মায়ের শরীরের ঘাম, জন্মের পর এই গন্ধেই আমি বেঁচে উঠেছিলাম কিনা! ঘামের ভেতর ধানের গন্ধ, আর উঠোনে ধূলির মিছিল যেন সূর্যের জ্যোৎস্না।
বাবা ক্ষেত থেকে ফিরে আমার ধুলোমাখা পায়ে চুমু খেত। বাবার শরীরে ঘামের গন্ধের সঙ্গে ধান আর ধুলোর গন্ধ।
আমি যৌবনে পা রাখতে রাখতে আমার জুতো হাজারটা জোড়াতালি দিতে হয়, যেন একখণ্ড মানচিত্র। ঘাম, ধান আর ধুলোর গন্ধ হাজারটা তালিমারা জুতোর ভেতর আমার পা বেয়ে শরীরে ছড়িয়ে পড়লে আমি পথে নামি। দেখি পথের ধূলিমিছিলে বাবার ঘাম আর ধানের গন্ধ। একদিন আমার পা মিছিলের সঙ্গে চলে গেছে দূরে দূরে। পা দুটো তারপর থেকে কোনোদিন আর খুঁজে পায়নি আমার মা।
উঠোনে মায়ের ধুলো-ধুলো চোখের ভেতর পড়ে ছিল কেবল আমার জুতোর ছায়াগন্ধ।


 

আবার গুলির শব্দ ।। চঞ্চল আশরাফ

১ ঃ ৩ পদক্ষেপে আমি সিঁড়িগুলো অতিক্রম করে চারতলায় উঠে দেখি দরজা বন্ধ। লাথি কষলে খুলে যায়, ১ ঃ ১ পদক্ষেপে সাবধানে আর উত্তেজনায় একেকটি কক্ষ পেরিয়ে দেখি সে আর গোঁফঅলা ফর্মা ছেলেটি হাত ধরে দাঁড়িয়েছে—তারা বুঝতে পেরেছে যে আমি এসে গেছি তাদের সামনে, আমি কোটের পকেট থেকে (তখন শীত পড়ছিল) পিস্তল বের করছি; কিন্তু কাকে আগে মারবো (আমার সিদ্ধান্ত ছিলো : প্রথমে ওকে, তারপর গোঁফঅলাকে, তারপর নিজেকে) সেটা না-ভেবে পরপর দু’রাউন্ড ছুঁড়লাম : গোঁফঅলা ছিঁটকে পড়লো, কিন্তু তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্যে আরো দু’রাউন্ড... বাকি দু’রাউন্ড ওর জন্যে খরচ করে (৬ রাউন্ড গুলি ছিল) দেখি, নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্যে একটা গুলিও নাই।

‘তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব যেদিন শেষ হয়ে যাবে, সেদিন পৃথিবীর সব পাতা ঝরে যাবে। এই নাও, নিচ্ছ না কেন? হান্ড্র্রেড পাইপার্স, বুঝেছ? হা হা হা। এইটার নাম নিলে হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুড বইটার কথা মনে পড়ে। পড়েছ তো। ওই যে, হত্যাকাণ্ড দিয়ে শুরু হলো।’...

‘আচ্ছা, পৃথিবীর সব পাতা ঝরে যাবে; সবই কি হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুডের পাতা, না গাছের, অ্যাঁ? আরেক পেগ। উম্ম।’ 

পুলিশ, লোহার গরাদ এবং প্রায়ান্ধকার কক্ষের ভেতর সমলিঙ্গের সঙ্গে আমার দিন ও রাতগুলো একে একে দ্রবীভূত হতে থাকে। হঠাৎ একদিন, আলো, এত আলো আমার চোখ, ত্বক ও অন্যান্য ইন্দ্রিয় সহ্য করতে চায় না; তবু মনে হয়, মানুষেরা বন্দিত্ব ও মুক্তির ঠিক মাঝখানটায় থাকে। ফলে যেখানে তার নিয়তি, অপ্রতিবাদে ও নিঃশর্তে সেখানেই  অভিযোজিত হয়ে যায়।

‘আরেক পেগ চলবে না কি? একটা ব্যাপারে তোমার সাহসের তুলনা হয় না। যে মহিলাকে তুমি ভাগিয়েছ, স্যরি, যে মেয়ের সঙ্গে তোমার প্রেম, শুনলাম, এর আগে ওর আরও দুটো ছিল। প্রেম। বিয়েও না কি করেছিল একটা? তোমার প্রেম কিন্তু পিওর। করো, করো। আচ্ছা, কোথায় করো? আমার এখানে করলেই তো পারো। নিয়ে এসো তো। দেখবো। আমি সেই রূপসীরে দেখে লই। আহা। ভাবো, কত আগে। শীত এসে নিয়ে গেছে তারে। কত আগে। অ্যাই, চিকেন উইংস তো খাওয়া হলো না। ঠাণ্ডা হয়ে গেল!’

আদালতে রায় ঘোষিত হয় মৃত্যুদণ্ডের, তবু আমার মনে হয় আমি জিতে গেছি; কারণ দু’জনকে হত্যার শাস্তি একজন, মানে, আমার মৃত্যুবরণ (বরণ বলা কি ঠিক? হ্যাঁ, ঠিক), অর্থাৎ আমি : সে ও গোঁফঅলা লোকটি, ১ ঃ ২; আমি বুকের ভেতর অদ্ভুত উল্লাস অনুভব করি। হুররে! আহ্!... ফাঁসির দড়ি পরানোর মুহূর্তে, সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে একটা স্বপ্ন দেখে ফেলি : আমি জীবিত হয়ে উঠছি, আমার প্রেমিকা, যাকে আমি খুন করেছি—তার হাত ধরে আমি এক নীরবনির্জন বিলের পাশে দাঁড়িয়েছি সূর্যাস্তের সামনে।

আ—আ—আ...


 

জলজ ।। পাপড়ি রহমান

সুদীর্ঘ খালের জলে ঢেউ হয়ে ভেসে যেতে যেতে বেরাফুল আসমান দেখছিল। আসমানের এধারে-ওধারে বহুবর্ণা মেঘের বিস্তার। ফলে কোন রঙ কীভাবে ছিটকে এসে খালের জলরঙ বদলে দিয়েছিল বলা মুশকিল। সে ছিল ধ্যানমগ্ন বলাকার মতো। রুস্তম আর কিংশুক নাও ভাসানে যাবে শুনেই উড়ে এসে পাখনা বিছিয়ে জুত হয়ে বসেছিল। খানিক বাদে জলহাওয়াতে সামান্য ঝিমুনি ভাব ধরলো। তখুনি কিনা কীসব ঘটতে লাগল। বিস্তর কচুরিপানা পলকে ভেসে এল। আর কিংশুক বৈঠা দিয়ে পথ করতে করতে ঘেমে উঠল। রুস্তম তখন চোরা স্পর্শে বেরাফুলের পায়ের পাতায় হাত রেখেছে। কী হিম স্পর্শ রে বাপ! তার কিছুক্ষণ বাদেই ওই হাত উঠে গেল বেরাফুলের ঊরুতে। শাড়ির আড়াল রেখে কৌশলে হাত চালাচ্ছিল রুস্তম। যেন সে তুলারাশির জাতক। হাত চালান করে করে পটুতা অর্জন করেছে।

বেরাফুল দুই-একবার ঝটকা মেরেছে। কিন্তু রুস্তম পাত্তা দিল না তাকে।

এদিকে খালে স্রোতের ঘূর্ণন। কিংশুকের বৈঠার কারসাজি কচুরিপানা সরাতে সরাতে বেহাল হয়ে উঠছিল।

রুস্তম ঊরুস্তম্ভ থেকে হাত সরিয়ে দাম তুলছিল দুইহাতে। বেরাফুল হঠাৎ দেখে তার পায়ের আঙুরলতা সবুজাভ হয়ে উঠেছে। ভয়ে সে চিৎকার দিতে দিতেও কণ্ঠ আটকে ফেললো। সবুজ কোনো সাপ তার আঙুলে পেঁচিয়ে থাকলে চুপ করে থাকাই নিরাপদ।

কিন্তু সবুজ রঙ অনড় রইলো । বেরাফুল বিস্মিত হয়ে দেখল ওই রঙ ক্রমে তার পায়ের ডিম পেরিয়ে অদৃশ্য হয়েছে।

বেরাফুল আর কোনো শব্দ করে নাই।

বাড়ি ফিরে শাড়ি উঠিয়ে দেখেছিল তার ডান পা সবুজবর্ণ ধারণ করেছে। যেন কোনো বৃক্ষের নরম কাণ্ড! বেরাফুল ভীত হয়ে উঠল নিজের এইরূপ পরিবর্তন দেখে।

বছর খানেক হবে সে শাড়ি ধরেছে। ইশকুল ডিঙিয়ে কলেজে উঠেছে এবার সে। তার সহপাঠী রুস্তম আর কিংসুক যেন জলের পোকা। ভরা বাদলে নাও ভাসিয়ে কিছু দাম-কলমি, কিছু শাপলা-ঢেপ তুলে আনা চাই। কিংবা নিরুদ্দেশে ভেসে বেড়ানো চাই। দিন দুয়েক পরে মুষলধারা বৃষ্টিতে ফের ডিঙা ভাসল। মাঝি দুজন বেজায় উল্লাসিত। নাও বেরাফুলকে নিয়ে মাঝ খালে পড়তেই লগি-বৈঠা ফেলে তারা ঝাড়া হাত-পা। এক জোড়া হাত বেরাফুলের দুই ঊরু চেপে ধরে রইলো। অন্য জোড়া হাত তার ব্লাউজ ছিঁড়েখুঁড়ে তছনছ করলো। বেরাফুল জোরে চিৎকার দিল। কিন্তু ঝমঝম বৃষ্টির নিচে তা চাপা পড়ে রইলো। কারো কানে পৌঁছালো না তার আর্তনাদ।

কিংশুক আর রুস্তম হঠাৎ দেখতে পেল, একতাল সবুজরঙ ডিঙি থেকে ধপাস শব্দে জলে পড়লো। আর পরক্ষণেই তা কচুরিপানা হয়ে ঘিরে ধরল ডিঙার চারপাশ। সবুজ ঘেরের ভিতর আটকা পড়ে রইলো দুই নয়া মাঝি। দাম নয় যেন যুদ্ধের সৈন্য তাদের ঘিরে রেখেছে!

বেরাফুলের কোনো চিহ্ন কেউ দেখতে পেল না। শুধু দামের অজস্র বেগুনী ফুলেরা হলুদ চোখে তাকিয়ে রইলো...!


 

পিছনের আয়নায় সামনের আয়না ।। প্রশান্ত মৃধা

চুলকাটা প্রায় শেষ করে এনেছে নরেশ। আর মাত্র কয়েকটা ব্লেডক্ষুরের টান, তারপরই পিছনে একটা আয়না নিয়ে দাঁড়াবে সে।
তরুণ কবি সুনীল আকাশের এসব জানা। বুদ্ধদেব বসুর সবচেয়ে দুঃখের দু’ঘণ্টাও তার পড়া আছে। যদিও দু’ঘণ্টা লাগল না, ঘণ্টাখানেকে কাজ প্রায় শেষ। পরিচিত নরসুন্দর নরেশ যদি এত দ্রুত না কাটত তাহলে হয়তো আরও অন্তত পনেরো মিনিট কি আধঘণ্টা লাগত। আজ নরেশ গল্প করেছে কম। বরং, সুনীলের প্রশংসাই করছে। গত সপ্তাহে ওর সেলুনে রাখা দৈনিকে তার কবিতা পড়েছিল। সে কথা বলতে বলতে, নরেশের উচ্ছ্বাসে সামনের আয়নায় সুনীলের চোখও আত্মশ্লাঘার ঝিলিক! কবিতাটা নরেশের ভালো লাগতেই পারে। অন্ত্যমিলে লেখা। এর আগে ওই কাগজে অন্য-একটা কবিতা পড়ে নরেশ বলেছিল, ‘আজকাল তোমরা যা লেহো, সেইয়ে আমার মতো মানষির বোঝার সাধ্যির বাইর!’ সেদিন হেসেছিল সুনীল। একবারও বলেনি, কবিতা এমনই, সব সময় সবটা বোঝা যায় না।
আজ কবিতাটার প্রশংসা করেই নরেশ সুনীলের চুল নিয়ে দু’চারটে কথা বলে। তারপর চুল মুঠ করে ধরে পোঁচাতে থাকে। পরে সাইজে আনবে। খুবই লম্বা হয়েছিল তার চুল। নরেশ বলছিল সে-কথা। কী সুন্দর শরীর স্বাস্থ্য, একেবারে হিরো, হিরোদেরও নাকি এমন ফিগার থাকে না, সেই মানুষের এমন এক মাথা জংলা চুল, দেখায় কেমন! ইত্যাদি। যেভাবে নরেশ সাধারণত বলে থাকে সুনীলের চুল বড়ো হলে! চুল এত লম্বা হলেও সুনীল অনেকদিন এখানে আসেনি। ওইসব বলতে বলতে নরেশ ফস্ করে বলে বসে, ‘আচ্ছা, এইরাম বড়ো চুল রাখলি কি তোমাগো কবিতা লেখা ভালো হয়?’ এ প্রশ্নের উত্তর কিন্তু সুনীলের জানা নেই। বরং, নরেশের সিদ্ধান্তটা চমৎকার!
‘চুল বড়ো রাকলি কবিতাও জট পাকাইয়ে যায়, তখন যা বের হয় তা মানুষ বুঝদি পারে না।’


এমন কথার কোনও উত্তর অথবা এই সিদ্ধান্তের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনও মন্তব্য তার পক্ষে করা হয়ে ওঠে না। মাথা নিচু করে আজকের দৈনিকটা দেখতে দেখতে চোখ তুলে আয়নায় সে নরেশের মুখ দেখে। কী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলছে নরেশ। তা ও বলতেই পারে। কত দিনের পরিচিত। মাথাটাকে সত্যি ছোটো আর একেবারে হালকা বানিয়ে ফেলেছে। বাহ্, নরেশের হাত বটে!
কানের দুপাশে ও মাথার পেছনে নরেশের ব্লেডক্ষুর চালানোও শেষ। এখন প্রায় কদম ফুলের পাপড়ি হয়ে থাকা চুলগুলো আচ্ছাসে হাত বোলাবে সে, দুমড়ে কচলাবে। তারপর একবার আঁচড়ে দেয়ার আগে পিছনে আয়নাটা ধরবে। সামনে একখানা আয়না। পিছনের দেয়ালে কোনও আয়না নেই। তাই মাথার পিছনটা ঠিকঠাক মিশেছে কি না তা বোঝানোর জন্যে নরেশ ডান পাশের তাকে রাখা আয়নাটা নিয়ে সুনীলের পিছনে ধরবে। সে হাতের কাগজটা ভাঁজ করে রাখে।
নরেশ যত্ন করে সুনীলের চুল আঁচড়ায়। তারপর অতি দ্রুত ডানের তাক থেকে আয়নাটা টেনে মাথার পিছনে নিলে, সুনীল পরপর একটার পর একটা নিজের মুখ ও মাথার পিছন, নিজের মুখ ও অসংখ্য সুনীলের মাথার পিছনের দিক, একেবারে কদম ছাঁট, ঘাড়ের সঙ্গে মেশানো সুচারু, কিন্তু সামনে অসংখ্য সুনীলের মুখ, অসংখ্য সুনীল আকাশ, তরুণ কবি সুনীল আকাশের মুখ অর্থাৎ অসংখ্য সুনীল আকাশকে দেখতে পায় যখন নরেশ বলে, ‘দেহো কাট্টা একেবারে তোমার এবারের কবিতার মতো হইচে নাকি!’ তখন সুনীল দেখছে অসংখ্য রোহিঙ্গার মুখ, জ্বলন্ত তমব্রু, পোড়া গ্রাম থেকে ধোঁয়া উড়ছে, শিশু ও নারীর ঢল, চালের দাম বৃদ্ধি, রিলিফের লাইন, শরৎকাল, ভাঙা দুর্গা মূর্তি, এবড়োখেবড়ো রাস্তা, নাফ নদীতে শিশুর লাশ, জঙ্গলে ধর্ষিত নারী, শিশির পড়ছে... আর সুনীল বলে, ‘হইচে, ভালো কাটিচো—’ যদিও নরেশ বলে চলেছে, ‘এইভাবে আয়না ধরলি তোমার মুখের পরে মুখ মুখের পরে মুখ...!’ যদিও এই দুঃখের এক কি সোয়া ঘণ্টা পরে সুনীলের চোখে নিজের মুখের বদলে এমন অসংখ্য ছবির পরে ছবি... কোনোভাবেই চোখ থেকে সরছে না।...


 

ক্ষুধা ।। ভাস্কর চৌধুরী

তিনটে লোক কোদাল আর শাবল হাতে রাতে বাড়ি ফিরছে। তারা কৃষক। সহজ সরল মানুষ। বাড়িতে মাঝরাতে ভাত পাবে এমন আশা নেই; অথচ পেটে ক্ষিধে। তারা একে অন্যকে বললো, কি করি রে? খিদা যে। আরেকজন জানায়, ঘরে ভাত নাই তার। বলতে বলতে এক মহাজনের বাড়িতে এলো। শীতের রাত। কেউ জেগে নেই। সীমানার দেয়ালটা নরম ইটের। একজন বললো, চল সিঁদ কাটি। তারা সিঁদ কাটতে বসলো। ধীরে গুঁতো দিতেই দুচারটে ইট সরে গেলো। তখন তাদের একজন ইট ধরে রাখে আরেকজন কাটে। প্রায় অল্পতেই হা হয়ে যায়। রান্না ঘরটা উঠোনের মাঝখানে। খড়ের ছাউনি। ভেজানো কপাট। বিড়ি খাওয়া ম্যাচ জ্বালিয়ে তারা ভাতের হাঁড়ি পেলো। ডালিতে পেঁয়াজ-মরিচ। মুচিতে লবণ। একটা করে থালা নিয়ে নিঃশব্দে পান্তাভাত পেঁয়াজ দিয়ে খেলো। পেট টুবটুব করছে। তারা যেমন এসেছিলো, রান্না ঘরে শেকল তুলে দেয়ালের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে গেলো। একজন বললো, আহা, বড় খিদা ছিলো রে! আরেকজন বললো, চুরি করিনি। চাইলেই দিতো। এতো রাইতে কে ডাকে? তৃতীয়জন বমি করতে করতে বললো, কামটা ঠিক হইছে কি?


 

ফাটল ।। মুর্শিদা জামান

পারফিউমের গন্ধ বলে দিচ্ছে শিউলি অন্য ব্র্যান্ডে ঝুকেছে। আমি বসার ঘর থেকেই টের পেলাম। খাসা জিনিস বটে! শরীরের ভেতর কেমন যেন ঝিমঝিম আবেশ অনুভূত হলো। উঠে গিয়ে একটু ওকে বাই বাই হাগ করবো এই সুবাদে সেটাও করতে পারবো না। ম্যানহোলে পড়ে গিয়ে পায়ের বেহাল দশা।

বসার ঘরের ডিভানেই শুচ্ছি, খাচ্ছি আর টিভিতে খেলা দেখছি। 

শিউলি পর্দাটা একটু ফাক করে বললো, শোনো যাচ্ছি। বুয়া এলে বলবে বাসার পর্দাগুলো যেন বদলে যায়। নতুন পর্দা কুরিয়ারে এসে যাবে। ওটাই লাগাবে। আর তুমি কিন্তু আজ সোজা বেডরুমে। সন্ধে বেলা পলাশ’রা আসবে।

আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই গিন্নির প্রস্থান।

ফোন তুলে একটা এসএমএস দিলাম, তোমার নিউ পারফিউমটা অতুলনীয়। সঙ্গে সঙ্গে চুমুর ইমো এসে ঝাকিয়ে দিল ফোনটাকে। ইশ্ লাল লিপস্টিকের ঠোটের চুমু দেখলে গা গুলিয়ে যায় একেবারে। তিন্নির ঠোটের মতো একটা ইমো কেনো হয় না!

পর্দা বদলাবে কেনো কিছুতেই মাথায় ঢুকলো না। অনেক কষ্টেসৃষ্টে পা নিয়ে বেডরুমে চলে আসলাম। সত্যিরে বাবা এই পারফিউম কে বানিয়েছে! তাকে কষে চুমো দিতে হচ্ছে। ঘরময় প্রেমের আহ্বান ছড়িয়ে গেছে শিউলি। আজকাল আমার আর শিউলির ভেতর সেই আঠালো প্রেম নেই। ওর রোজগার বেড়ে যেতেই চটের বস্তার মতো চিকন ফালি ফালি ফাক আস্তে আস্তে মাছের জালের মতো বড় ফাক হতে লাগলো তাও না। একবার ভাবি আমাদের বুঝি ডিভোর্স নেয়াই ভালো কিন্তু আবার এও মাথায় আসে আমার মতো ফ্রিল্যান্সার ক্যামেরাম্যানকে শিউলির মতো আর কেই বা পাত্তা দেবে। পলাশ ভাইদের সাথে বেশিদিনের আলাপ নয়। তবু আমরা যাচ্ছি তাদের ওখানে ওরাও আসছে। 

আর এই যাতায়াত এর ভেতর শিউলির পারফিউম, পর্দা, রেসিপি সব বদলে যাচ্ছে। এদিকে মনের ভেতর তিন্নির জন্য তোলপাড়! বদল তো আমারও ঘটছে। আজ ও শুধু কি বসার ঘরেই বসে থাকবে! এ ঘরে এসে একবারও কি পায়ের নীলচে দাগে হাত রাখবে না!

তিন্নিদের অটিস্টিক বেবি আছে। তবু ওরা কি হাসিখুশি। নাকি আমাদের মতো ওরাও অভিনয় করে। তিন্নির ঠোঁট আমাদের পাড়ার সেই বিদ্যাদেবীর মতো। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। প্রশান্ত আর আমি চুপিচুপি রাতের অন্ধকারে বিদ্যাদেবীকে চুমু খেয়েছিলাম। প্রশান্ত এখন বিরাট ব্যাবসায়ি। বহুকাল দেখা হয় না, কিন্তু ওর সব খবর কানে আসে।

এতগুলো বছর পর তিন্নিকে দেখে চমকেই উঠেছিলাম। ছবির পর ছবি তুলেছি ওদের। কিন্তু জুম করে দেখি শুধু তার লিপস্টিকহীন শ্যামল ঠোঁট, একটু নিচে সরিষা দানার মতো তিল!

কলিংবেল বাদ সাধল ভাবনার। পর্দা এল বুঝি।


 

নিজের শরীর চেয়ে বিজ্ঞাপন ।। মোজাফফর হোসেন

স্টেশনে বসে আছি ঠায়। কেউ আসবার কথা নয়। ফিরে যাবো কারো কাছে, এই শহরে এমন কেউ নেই আর। কাউকে পাঠানো হবে না ভেবে যে চিঠিখানা লিখেছিলাম, দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলেছি পরিত্যক্ত এক ডোবাতে। হোটেলের চেয়ে সস্তায় এখানে মিলে যায় বালিকা বারবণিতার ঘর। ভাড়াটে সেই নারীর মধ্যগগণে চুমু খেয়ে উঠে এসেছি এই ভরদুপুরে, চুপিসারে। এর বেশি কিছুই রেখে যাচ্ছি না এই শহরে।

ট্রেন শেষ হুইসেলটা ছেড়ে গুটি গুটি পায়ে হাঁটা ধরে। আরও একবার খুঁজে পেতে চেষ্টা করি শরীরের ভাপে ভিজে জবুথবু টিকিটটা। হাত গলিয়ে পড়ে শূন্যে। এদিক ওদিক ভালো করে দেখি—আমি কারো ছায়া, একাকী অপেক্ষমান। আমার অস্পষ্ট অস্তিত্ব চোখে পড়ছে না কারো। স্টেশনের প্রতিটা দেহের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি নিজেকে। সম্ভবত আমাকে রেখেই ফিরে গেছে সে, অন্য কোনো ছায়ার সন্ধানে। অথবা আত্মগোপন করেছে অন্য কোনো শরীরে।

বিমূর্ত আমি মূর্ত হওয়ার সন্ধানে খুঁজে ফিরি শরীর। সাড়ে পাঁচ ফিট, ছিপছিপে গড়ন—একটু এদিক-ওদিক হলেও ক্ষতি নেই, কে কার ছায়া মেপে দেখে! দেবেন নাকি আপনার শরীরটা? শরীর ছাড়া সব সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাবে ঘরে ফেরার। 


 

শনিবার ।। রবিশংকর বল

খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। লোকটা আমার দিকে তাকিয়েই আছে। হাতে ধরা গ্লাস থেকে চা খেতেও ভুলে গেছে। এমন তার তাকানোর ভঙ্গিমা- যেন অদূরেই একটা দূরবীন বসানো আমার সামনে- সে আমাকে একটা খোলা বইয়ের মতো পড়ে নিতে চাইছে। এমন কিছু কিছু দৃষ্টি আছে, যা মানুষের চোখকে বদলে দেয়, সে তখন শুধু তাকিয়ে থেকেই কাউকে নগ্ন করে দিতে পারে।
লোকটার বয়স সত্তরের কাছাকাছি তো হবেই, পাকানো চেহারা, মাথার সামনে টাক, পেছন দিকে সাদা বাবরি চুল, পরনে ময়লা ধুতি-পাঞ্জাবি, চোখে মলিন চশমা। সে আমার দিকে তাকিয়ে কী যেন বিড়বিড় করে বলছে নিজের মনেই। মাঝে মাঝে ঠোঁটের কোণে কি বাঁকা হাসি ফুটে উঠছে? তাড়াতাড়ি চা শেষ করে নিকুঞ্জদাকে পয়সা দিয়ে আমি দোকান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। এ অনেকটা পালিয়ে আসা, সেই তাকানো থেকে, এমনকি নিজের থেকেও।

কিছুদূর এগোতেই পিছন থেকে ডাক শুনতে পেলাম, ‘শুনছেন ভাই-।’ ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, লোকটা। এখন আর পালানোর উপায় নেই, লোকটা পেছন-পেছন চলে এসেছে।

-   আমাকে বলছেন? বিরক্ত গলায় বলি

-   আপনার বাবা কি সুরেন্দ্রনাথ নাগ? লোকটা আমার মুখে কী যেন  খুঁজতে-খুঁজতে বলে।

-   না।

-   ও। সুরেন্দ্রনাথ আমার বন্ধু ছিল। আপনাকে একেবারে ওর মতো দেখতে। দেশভাগের সময় এ-পারে আসতে গিয়ে কোথায় যে চলে গেল। পরে কার কাছে যেন শুনেছিলাম, এই কালীঘাট অঞ্চলেই থাকে। তাই খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। ছোটবেলার বন্ধু তো-। আমার নাম অনাদি আচার্য।

-   ঠিকানা জানেন?

-   না। তাহলে তো কাথাই ছিল না। ঠিক খুঁজে বের করতাম। কতজনকে জিজ্ঞেস করলাম-

-   এত বড় অঞ্চলে কোথায় তাকে খুঁজে পাবেন? আমি হেসে বলি, ‘যান, বাড়ি চলে যান। আপনারও তো বয়স হয়েছে।

-   হু। লোকটা কিছু সময় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে পিছন ফিরে হাঁটা দেয়। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি। হ্যাঁ, আমি সুরেন্দ্রনাথ নাগের বড় ছেলে, লোকটাকে বললে কী ক্ষতি ছিল? কিন্তু লোকটা সুরেন্দ্রনাথের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে-। বাবা তো এখন আর কাউকে চিনতে পারে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

আজ শনিবার। কালী মন্দিরের দিকে যাওয়ার রাস্তায় ভিড়। আমি ভিড়ের ভিতরে মিশে গিয়ে ভাবি, তবু অনাদি আচার্য তো চিনতে পারত। আমরা তার কাছ থেকে বাবার শৈশব-কৈশোরের অনেক গল্প হয়তো জানতে পারতাম। …কিন্তু অনাদি আচার্যও যদি সব ভুলে গিয়ে থাকে? হয়তো সে জানেই না, আসলে কাকে খুঁজতে বেরিয়েছে।

এসব ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না।    


 

খেলা ।। সাদাত হোসাইন

মজিদ মিয়া থক করে একদলা থুথু ফেললো ভেজা মাটিতে। গত কিছুদিনের টানা বৃষ্টিতে কাদা-জল হয়ে আছে বাড়ির উঠান। সে একদৃষ্টিতে সেই উঠোনের দিকে তাকিয়ে আছে।

‘আব্বা, বিষ্টিতো মনে হয় আরও দুই চাইরদিনেও কমতো না। গাঙ্গের পানিও হুমহুম কইরা বাড়তেছে। ধান খ্যাততো মনে হয় তলাইয়াই যাইব!’

মজিদ মিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, রবিউল দাঁড়িয়ে আছে। রবিউল তার বড় ছেলে। বয়স বার। তবে এই বয়সেই বুক চওড়া হতে শুরু করেছে। বাহুর মাংসপেশি পরিশ্রমী শরীরের আভাস দিচ্ছে। সে বলল, ‘দুইদিন হয় নাই ধানের চারা লাগাইলাম, এহনই যদি গাঙ্গের পানি ছুইট্যা আইয়া জমিন তলাই দেয়, সব চারা পানিতে ভাইস্যা যাইবো আব্বা’।

মজিদ মিয়া বিড়বিড় করে বললো, ‘এতো সহজে বাঁধের রাস্তা তলাইবো না। চিন্তা করিস না’।

‘রাস্তা যদি ভাইঙ্গা যায়?’

মজিদ মিয়া শক্ত গলায় বলল, ‘এই রাস্তা আইজকার না। এর উপর দিয়া কত বন্যা আইলো গেলো, রাস্তা কোনদিন ভাঙ্গে নাই’।

‘এইবার পানির অবস্থা ভালো না আব্বা’।

মজিদ মিয়া কথা বললো না। সে বড় বড় পা ফেলে রাস্তায় উঠে এসে দাঁড়াল। রাস্তার একপাশে নদী, আরেকপাশ সবুজ ধানক্ষেত। মাত্র দুদিন হয়েছে ধানের চারা লাগানো হয়েছে। এখন এমন টানা বৃষ্টিতেই বিপদ। তারওপর বাঁধ ছুটে গেলে আর উপায় থাকবে না। একপেট-আধপেট দূরে থাক, বছর শেষে না খেয়ে উপোষ করেই মরতে হবে। বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে নদীর স্রোত। হুহু করে জল উঠে আসছে। মজিদ মিয়ার মনে হলো, বাঁধের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা রেইন্ট্রি গাছখানা থরথর করে কাঁপছে। সে দু কদম হেঁটে রেইন্ট্রি গাছটার কাছে গিয়ে আলতো হাতে গাছটার ভেজা শরীর ছুঁয়ে দিল। শুধু রেইন্ট্রি গাছটাই না, রাস্তাটাও কাঁপছে। সে ডান হাতের তালুতে গাছের শরীরটা শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকালো। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে যাওয়া আকাশ। মজিদ মিয়ার হঠাৎ মনে হল, ওখান থেকে কেউ একজন খুব আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছেন!

এই ধানের চারা, নদীর হুহু করে বেড়ে ওঠা জল, ঘন মেঘ আর এই বৃষ্টি, এর সকলই তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছেন। যেন রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার কোন খেলা আর তিনি তার দর্শক। এই খেলার পরের অংশ দেখার জন্য তিনি প্রবল উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছেন।

শেষ অবধি বাঁধ ভাংলো না। বৃষ্টি থেমে গেলো। ঝলমলে আলো আর ফুরফুরে হাওয়ায় ভরে উঠলো ধানক্ষেত। সোনালী ধানে ন্যুব্জ হয়ে ফসলের আগমনী জানান দিল ধানের শীষ। মজিদ মিয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিকেলের সোনারোদে স্বপ্নালু চোখ মেলে তাকিয়ে রইল ধানক্ষেত, বাঁ পাশের শান্ত নদী আর স্নিগ্ধ আকাশের দিকে। তার আবারও মনে হল, কেউ একজন তাকে দেখছে। কিন্তু সে তাঁকে দেখতে পাচ্ছেনা। অদ্ভুত রহস্যময় এক খেলা। এই খেলায় কে হারে, কে জেতে, তাতে দর্শকের কিছু যায় আসেনা। দর্শক কেবল উত্তেজনা খোঁজে, আনন্দ খোঁজে, পরিতৃপ্তি খোঁজে।

মজিদ মিয়ার ঘুম ভাংলো মাঝরাতে। সে ধরফর করে উঠে বসল। বাইরে শোশো হাওয়া বইছে। বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঘরের টিনের চাল মচমচ শব্দ তুলে উড়ে যেতে চাইছে। মজিদ মিয়া দিশেহারার মতন ঘরের দরজা খুলে দৌড়ে বাইরে এলো। উঠোনের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো প্রলয় নৃত্য শুরু করেছে! আচমকা সাঁই করে উড়ে গেলো টিনের চাল। একটা আজদাহা গাছের ডাল ভেঙে পড়ল ঘরের উপর। মজিদ মিয়া বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখল, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ভাঙা ডালের নিচ থেকে কাউকে টানছে রবিউল, ‘মা, মা, বনু, ও বনু, আব্বা...’

মজিদ মিয়া ছুটতে গিয়েও পারল না। তার আবারও মনে হল, এই উন্মত্ত ঝড়ো আকাশের অন্ধকার থেকে কেউ একজন তাকিয়ে আছেন। প্রবল উত্তেজনা নিয়ে তিনি দেখছেন রুদ্ধশ্বাস এক খেলা। সেই খেলায় রবিউল কী তার মাকে, বনু কে বাঁচাতে পারবে? মজিদ মিয়ার সোনালী ধানের শীষ কী শেষ অবধি লাল ফুলের মতন ভাত হয়ে পাতে ফুটে উঠতে পারবে? নাকি ঝরে যাবে!

গভীর রাত। মজিদ মিয়া বসে আছে ঘরের দাওয়ায়। বনুর হাত ভেঙেছে। সেই রাতের পর দিনকয় পেরুলেও বনুর ভাঙা হাতের ব্যথা এতটুকু কমেনি। রবিউল আর তার মা ভাঙা হাতের বনুকে নিয়ে কাকভোরে গিয়েছে গঞ্জে। মজিদ মিয়ার দুশ্চিন্তা হচ্ছে খুব। ক্লান্তও লাগছে। ঝড়ে লণ্ডভণ্ড জমিতে ছড়ানো ছেটানো অপুষ্ট ধানগুলোই পাখির ঠোঁটের মতন একটা একটা করে খুঁটেখুঁটে কুড়িয়েছে সে। এখন ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ছে। খানিক তন্দ্রাও লেগে এসেছে। আচমকা চোখ মেলে তাকালো মজিদ মিয়া।

এখন কত রাত? রবিউলরা এখনো ফেরেনি?

মজিদ মিয়া উঠে দাঁড়াতে যাবে, এই মুহূর্তে তার চোখ আটকে গেলো পাশের দেয়ালে। পাশে কেরোসিনের কুপিটা জ্বলছে। দেয়ালে তেরছাভাবে পড়া আলোর মাঝখানে বসে পাখা নাড়ছে একটা গুবড়ে পোকা। বাদবাকী অংশটা অন্ধকার। মজিদ মিয়া চোখ ফেরাতে গিয়েও পারল না। সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে সতর্ক ভঙ্গীতে বেরিয়ে এলো একটা টিকটিকি। সন্তর্পণে পা বাড়ালো। পোকাটা সামান্য নড়ে উঠল। টের পেয়েছে বোধহয়, তার ঠিক পেছনেই ওঁত পেতে আছে ভয়ঙ্কর বিপদ!

টিকটিকিটা আরও দু’কদম এগুলো। তারপর দাঁড়িয়ে রইল। তার গলা ফুলেফুলে উঠছে। বাজপাখির মতন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। যেকোন মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে সে। সে কী পোকাটাকে ধরতে পারবে?

মজিদ মিয়া উঠতে গিয়েও পারলো না। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা নিয়ে টিকটিকিটার দিকে তাকিয়ে রইল। পোকাটা বুঝি টের পেয়ে গেল! ওই যে নড়ছে, এক্ষুণি উড়ে যাবে? ইশ!

পোকাটা নড়ল না, তার পাখায় কেবল সামান্য কম্পন দেখা গেল। টিকটিকিটা নিঃশব্দে পড়ে রইল। নির্জীব, সতর্ক, প্রস্তুত। এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়বে! মজিদ মিয়ার বণুর কথা মনে রইলনা, রবিউল বা তার মায়ের কথাও না। সে স্নায়ু টানটান উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো, টিকটিকিটা কী পোকাটাকে ধরতে পারবে? নাকি পোকাটা উড়ে যাবে?

কী হবে?

এক অদ্ভুত রহস্যময় রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার খেলায় বুঁদ হয়ে রইল সে। কিন্তু সে কী জানে, এই খেলা কারো জীবন মরণের হিসেব, মৃত্যু ও জীবনের ফয়সালা?

জানে সে?

পোকাটা কি জানে, তার ঠিক ঘাড়ের কাছেই ওঁত পেতে আছে মৃত্যু, কিংবা তার পাখার সামান্য ঝাপটায় লেখা আছে জীবন?

জানে সে?

সে কী জানে, কেউ একজন প্রবল উত্তেজনা নিয়ে দর্শক হয়ে তাদের দেখছে?

দেখছে জগতের আদি ও অকৃত্রিম এক খেলা!


 

এই ঘটনা সত্য ।। সালমা বাণী

ঘুমহীন রাত কাটাতে কাটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ময়মনসিংহের মানুষেরা। প্রথমে ঘুমহীন রাত কাটায় ফুলবাড়িয়া গ্রামের মানুষেরা। তারপর ক্রমেই ঘুমহীন রাত কাটানো শুরু করে পুরো ময়মনসিংহের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরা। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে ময়মনসিংহের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ভীরু হয়ে ওঠে। ভয়ে দরজা জানালা শক্ত করে বন্ধ করে দেয়। তারপরও তারা ঘুমাতে পারে না। মধ্যরাতের আগেই আমাবস্যার মতো ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে যায় গ্রামের পর গ্রাম। অন্ধকারের গভীর থেকে ভেসে আসে করুণ কান্নার সুর। ময়মনসিংহের পুরুষেরা এই কান্নার উৎস খোঁজার জন্য দিনের বেলা অনেক রকম পরিকল্পনা করলেও রাতে কোনো যুবকই আর এগিয়ে আসার সাহস পায় না। এবং ঘুমহীন রাত কাটাতে কাটাতে ক্রমশ পুরুষেরা কর্মহীন হয়ে পড়ছে কারণ তারা ঘুমহীন রাত কাটানোর কারণে দিনের বেলা মৃতের মতো ঘুমায়। 

যেদিন প্রথম এই কান্নার সুর ভেসে আসে সেদিন মেঘের মতো এক টুকরো গাঢ় কালো ছায়া দুলতে থাকে সুমির দেহের ওপর। নিকষ অন্ধকারে ডুবে ছিল পৃথিবী তখন।

তারও আগে সুমি ছিল বাসের শেষ যাত্রী। বাড়ি ফিরছে সুমি। সন্ধ্যা নামছে তার নিজের নিয়মে। গতি পরিবর্তন করে সুমিকে জোড় করে নিয়ে গেল নির্জন রাস্তায়। উল্লাসে মেতে ওঠে কতগুলো কামুক পুরুষ। তারা পালাক্রমে নির্যাতন করে দেহের ক্ষুধা মেটায়। নির্যাতনের এই খবর যেন প্রকাশ না পায় রাস্তার পাশের ঝোপের ভেতরে ছুঁড়ে ফেলে সুমির মৃতদেহ। ফেলে দেয়ার আগে তারা রড দিয়ে পিটিয়ে সুমির মাথা এমনভাবে থ্যাতলায় সুমির সুন্দর চেহারাটা বদলে যায় এক দলা মাংসপিণ্ডে।  

রাত গভীর হলে রক্তের গন্ধে নিশাচর শেয়াল ও কুকুরেরা আসতে থাকে। নিথর সুমির থ্যাতলানো মাথার রক্ত ঘিলু চেটে চেটে খায়। কামড়ে কামড়ে তুলে নিতে  থাকে সুমির গালের ঠোঁটের নরম মাংস।

তখন মেঘের মতো এই ছায়ার আর্বিভাব ঘটে। ছায়ার আর্বিভাব ঘটার সাথে সাথে নিশাচর প্রাণীদের মারামারি থেমে যায়। শেয়াল কুকুরের দল ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালায় আর ছায়াটা সুমির দেহের ওপর দুলতে থাকে। শুধু শেয়াল কুকুরো নয়, আশে পাশের ঝোপঝাড়ের ভেতরে আরও কিছু রাত প্রাণীর ভয়ার্ত ডাক শোনা যায়। বট আম বা কাঁঠাল জাতীয় উঁচু গাছের ডাল থেকে বাদুর ও কাকেরাও ডানা ঝাপটিয়ে পালাতে থাকে।

ছায়া তখন সুমির সাথে কথা বলে—সুমিকে ছায়া জানায় তাকেও সুমির মতোই নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। তার নাম তনিমা। সুমিকে জেগে উঠতে সাহস দিলে ধীরে ধীরে সুমি জেগে ওঠে। সুমির নিথর দেহের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে সুমির ছায়া। তনিমা সুমির ছায়াকে বলে—আমাদের যাদেরকে এভাবে হত্যা করা হয়েছে আমরা সবাই এভাবে মেঘের মতো জমাট বাঁধবো। তখন জমাট বাঁধা ছায়ার ভেতর থেকে ভেসে আসে করুণ কান্না।

সে রাতের পর থেকে প্রতিরাতে ভেসে আসতে থাকে এই কান্না। কান্নার করুণ সুর এমন হৃদয় বিদারক কোনো পুরুষ আর ঘুমাতে পারে না। কিন্তু আশ্চর্য এই কান্না কোনো নারীর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় না। এই কান্না প্রতিরাতে দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে মাঠের পর মাঠ, প্রান্তরের পর প্রান্তর। বিস্তার হতে হতে এখন ক্রমেই এগিয়ে আসছে ঢাকা শহরের দিকে। 


 

মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান ।। সালেহা চৌধুরী

একটি ক্লাসে গরুর রচনায় সব ছেলেপুলে দুই তিন চার পেয়েছে। কেবল একজন পেয়েছে দশে দশ। ছেলেপুলেরা স্যারকে প্রশ্ন করে—আমরা এত কম নম্বর পেয়েছি আর ও পেয়েছে দশে দশ। কী এমন লিখেছে অত্রি যে আপনি ওকে দশে দশ দিয়েছেন। আমরা জানতে চাই স্যার, ওর রচনা কেমন করে এত মার্ক পেল।
জানতে চাও কেনো? স্যার বলেন—কী শিখিয়েছি তোমাদের। রচনা লিখলে তার ভেতরে ‘কোটেশন’ দিতে হয়। তোমরা কেউ কোটেশন দাওনি। কেবল অত্রি দিয়েছে। তাই দশে দশ। ছেলেপুলেরা সমস্বরে বলে—স্যার গরুর রচনায় কি কোটেশন দেব?
কেনো অত্রি তো দিয়েছে।
ছেলেরা শুনতে চায় গরুর রচনায় অত্রি কী কোটেশন দিল।
স্যার এবার ওর রচনা পড়তে শুরু করেন। শেষাংশে অত্রি লিখেছে—গরু দুধ দেয়, গরুর মাংস খাওয়া যায়, গরুর গোবর দিয়ে সার হয়, ঘুঁটেও হয় যা জ্বালানির কাজে লাগে, চামড়া দিয়ে জুতো, ব্যাগ, সুটকেস এইসব হয়, বিদেশে চামড়া পাঠিয়ে টাকা আয় হয়, গরুর শিং-এর চিরুনিও ভালো। আমার মায়ের একটি শিং-এর চিরুনি আছে। কোরবানি ঈদে গরু জবেহ করা যায়। আর গরুর হাল দিয়ে জমি চাষ হয়। গরুর গাড়িতে চেপে এখানে ওখানে যাওয়া যায়। গরু আমাদের বন্ধু। এত যে ভালো গরু তবু তার মৃত্যু আছে। তাইতো কবি বলেছেন—মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান।


 

সহবাস ৩০০০।। হামীম কামরুল হক

একে তো সে আমার চেয়ে বয়সে বেশ বড়, তারওপর আমার চেয়ে মাথাও লম্বা, আমার চেয়ে চাকরিও ভালো করত, ইউরোপ-আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর ছিল, দেখতেও তেমন, সুন্দরী, সপ্রতিভ, নানান গুণে গুণী, সবমিলিয়ে পুরানো বাংলায় যাকে বলে কিনা বিদুষী নারী, তাহলে কী করে আমার মতো বয়সে ছোট, লম্বায় খাটো, প্রায় গুণহীন, অতি সাধারণ চেহারাসুরতের একটা পুরুষের সঙ্গে জীবনের এতটা সময় কাটিয়ে দিল? কারণটা গোপন। কাউকে বলা যাবে না। সে আর আমি ছাড়া কেউ আসল ব্যাপারটা জানে না। এই গোপনীয়তাই আমরা উপভোগ করেছি গত পঞ্চাশ বছর। তবে অন্যদের আমরা বলব, আমরা শিক্ষা নিয়েছি অতীত থেকে, সবসময় চিন্তা করেছি বর্তমান নিয়ে, আর কাজ করেছি ভবিষ্যতের জন্য। আর আমরা জেনেছিলাম, ভালোবাসা শুধু বোতাম খোলার শব্দ নয়। আমার বয়স এখন ৮০ বছর, আর ওর ১০০। এখনও সে নিজের হাতে লিখতে পারে, মানে কম্পোজ করতে পারে। বয়সের ভারে অতটা নুয়েও পড়েনি। এখনও কারো সাহায্য না নিয়ে হাঁটতে পারে। আমাদের কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি। সে চেষ্টাও করিনি কোনোদিন। দুজনের দিক থেকে এটা ছিল একসঙ্গে থাকার বা এক ছাদের নিচে থাকার প্রথম চেষ্টা, আগে হলে বলা হতো দুজনেরই প্রথম বিয়ে। বিয়েশাদি আজকাল আর কেউ করে না। বেশিদিন কেউ কারো সঙ্গে থাকেই না। অবিরাম বদলে বদলে চলে। নিত্যনতুন সঙ্গী বেছে নেয়। এই ৩০০০ সালে আমাদের মতো এমন দীর্ঘস্থায়ী জুটি আর দ্বিতীয়টি নেই।

আজ বিকালে আমাদের সংবর্ধনা। শুনেছি, সেখানে সদ্য জুটি বাঁধা আর মোটামুটি দীর্ঘদিন, মানে বছর তিনেক, একসঙ্গে থাকা অসংখ্য নারীপুরুষ থাকবেন। আমি আজ সকাল থেকেই তাদের হাততালি শুনতে পাচ্ছি।


 

সম্পর্ক ।। হাসান আজিজুল হক

বেঙ্গালোর থেকে কলকাতায় আসছি। আমাদের একই কামরায় আমার মুখোমুখি একজন বাঙালি ভদ্রলোক। ট্রেনটা যখন ছাড়বে তখন একটি ষোল-সতের বছরের মেয়ে আর এই পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছরের এক মহিলা উঠে এলেন। মহিলা বেশ সুন্দরী আর মেয়ে তো অপূর্ব সুন্দরী। ভেতরে ঢুকে মেয়েটি তার বাবার কাছে এসে বললো, ‘বাবা আমি তাহলে যাই।’বাবা বললেন, ‘সাবধানে যেও।’

তারপর স্ত্রী আর মেয়ে দুজনেই সামনে এগিয়ে গেল। মেয়েটি ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে জানালায় টোকা দিয়ে আরেকবার বিদায় নিল। মা বললেন, ‘দ্যাখো, জানালায় তোমার মেয়ে।’ তারপর তিনি সেই যে গেলেন আর তার দেখা নেই। হাওড়া পর্যন্ত প্রায় কুড়ি-বাইশ ঘণ্টার পথ ওই মহিলাকে আর দেখতে পেলাম না। তিনি হয়তো পাশেই কোথাও ছিলেন। আর এই ভদ্রলোক একাই বসে রইলেন। নানা ধরনের গল্প-গুজব হলো তাঁর সাথে। ট্রেন যখন হাওড়ায় এসে থামবে তার কিছু আগে ভদ্রমহিলা তার পাশে এসে বসলেন।

আমি বললাম, ‘আপনি এঁর ঘর করেন, ঘর সামলান, তা উনি এতক্ষণ ধরে এখানে কিভাবে আছেন আপনি দেখবেন না?’

আমার কথায় একটু হাসলেন মহিলা। বললেন, ‘না না—আমি সবই দেখছি।’

হাওড়া স্টেশনে যখন নেমে গেলাম প্লাটফর্মে প্রচণ্ড ভিড়। আমি প্রায় বাইরে চলে এসেছি, তখন দেখি ভদ্রমহিলা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে। আমার দিকে একটু ফিরে বললেন, ‘আমি সত্যিই ওর ঘর করি না।’


 

আরো পড়ুন-

দ্রোহের প্রতিশব্দ দেবী দুর্গা ।। রুমা মোদক

 

 

 

 

জেড.এস.
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভ্যর্থনা
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ