X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাঠক কবির জগত খোঁজে না, কবিতা খোঁজে : শামশাম তাজিল

.
০১ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:০৮আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:১৭

পাঠক কবির জগত খোঁজে না, কবিতা খোঁজে : শামশাম তাজিল

শামশাম তাজিল । জন্ম ১ এপ্রিল, ১৯৮৪; বি-বাড়িয়া, চট্টগ্রাম। শিক্ষা : ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা : একটি বেসরকারি কলেজে প্রভাষক। প্রকাশিত বই : আদম পাহাড়।

দ্বিতীয় দশকের কয়েকজন কবির কাব্য-ভাবনা ও লেখালেখি নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন সাহিত্যের এই আয়োজন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একই সময়ের কবি রাসেল রায়হান।

 

প্রশ্ন : কবিতায় নিজের জগত নির্মাণ কতটা জরুরি? জরুরি হলে আপনার ক্ষেত্রে সেই পদ্ধতি কেমন?

উত্তর : কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কবিতা লেখাটাই জরুরি। কবিতা লেখা হলে আলাদা করে জগত নির্মাণের প্রয়াস করতে হয় না। প্রত্যেক ব্যক্তিমানুষই আলাদা, আবার আলাদা নয়ও। জগত নির্মাণ কবিতা লেখার সাথে সাথেই নির্মিত হয়। কবিতা নিজেই কবির জগত। পাঠক কবির জগত খোঁজে না, কবিতা খোঁজে। সময় বদলে গেলে ভাষা বদলে যায়, কবিও ক্রমাগত পাল্টান নিজেকে। কোনো কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান, কোন কোন পরিবর্তন হয়তো দৃশ্যমান নয়, কিন্তু অনুভবযোগ্য। আমি আসলে জগত নির্মাণের চিন্তাই করি না, শুধু চাওয়া থাকে সবকিছুকেই যেন কবিতার উপকরণ করে নিতে পারি, কবিতা হয় যেন। তার জন্য সচেতন প্রচেষ্টা জরুরি।  আবার মাঝে মাঝে সবকিছু থেকে নির্মোহ থেকেও গোপন একটা বাসনা কাজ করে যদি কবিতার দেখা মিলত! পদ্ধতি নিয়ে যদিও ভাবনা নাই, শুধু চাই, কবিতার ভাবনা এলে যেন তাকে কবিতা করতে পারি।

 

প্রশ্ন : তার মানে দুই কবির দুই জগত। এর মধ্যে পাঠক ঠিক কিসের ভিত্তিতে একটি জগত অপেক্ষাকৃত কম বা বেশি গ্রহণ করে?

উত্তর : দুই জগত কিনা ঠিক বলতে পারব না, তবে জগতকে দেখার ভিন্নতা তো থাকেই।

আর পাঠক গ্রহণ করে তার পরিচিত জগতকেই। কবি সেই জগতের কথাই বলেন। এটা অনেকটা জানা জগতেরই পুনরাবিষ্কার!

 

প্রশ্ন : এই জগতে তার পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব কতটা?

উত্তর : পারিপার্শ্বিকতা বাদ দিয়ে তো কবিতা লেখা যায় না। কবি যা-ই কিছু লিখুন না কেন, তার সময়, বেঁচে থাকা, শ্রেণি, পঠনপাঠন- সবকিছুই তার জগত নির্মাণে ভূমিকা রাখে। কিন্তু কবিতা কবিকেই লিখতে হয়। একধরণের দ্বৈতনীতি কার্যকর, যার প্রধান নিয়ন্তা কবি নিজেই।

 

প্রশ্ন :এবার অন্য প্রসঙ্গে যাই। মহৎ কবিতার বৈশিষ্ট্য  ঠিক কী? আপনি কোন লেখাকে মহৎ কবিতা বলবেন?

উত্তর : এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন। একটু হেয়ালি করি। মহৎ কবিতাই মহৎ কবিতা। সুন্দর যেমন সুন্দর, তেমনি মহৎ কবিতাও মহৎ। মহৎ কবিতার একটা বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে পারি। তেমন কবিতা পড়লে ভোলা যায় না! বরং এক কাজ করি। কিছু মহৎ কবিতার উদাহরণ দেই। কিন্তু কেন সেগুলো মহৎ, তার উত্তর দিতে পারব না। আসলে দিতে চাই না! বনলতা সেন, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, উটপাখি। এইগুলা কাদের লেখা তা না বললেও চলে, তাই উল্লেখ করলাম না। এমন অজস্র কবিতা আছে।

 

প্রশ্ন :  এবার আপনার ইতিহাস শনতে চাই। কবিতায় ঠিক কীভাবে আসা?

উত্তর : শৈশবে আব্বাকে দেখতাম আম্মাকে তার লেখা পড়ে শুনাতেন। তখন থেকেই আমারও ইচ্ছা হতো কিছু লিখি। আমি হাই স্কুলে পড়ার সময় ইকরা পাঠাগারের একজন লাইব্রেরিয়ান ছিলাম। সপ্তাহের রবিবারে আমি লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব পালন করতাম। সেই লাইব্রেরি থেকে প্রতি বছর ‘প্রসূণ’ নামে একটা ম্যাগাজিন বের হত। খুব চাইতাম সেখানে আমার কবিতাও থাকুক। ওই ইচ্ছা পুরণ হয়নি। তারা আমার লেখা ছাপেনি। 

ক্লাস এইটে থাকতে একদিন সন্ধ্যায় পড়তে বসে হঠাৎ কিছু একটা কবিতার মতো লিখে ফেলি। সাথে সাথেই আম্মাকে পড়ে শোনাই। সেই থেকে শুরু। আর আম্মাই আমার কবিতার প্রথম শ্রোতা।

বলতে পারেন,  ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার একটা গোপন অভিলাষ থেকেই লেখার উন্মেষ!

 

প্রশ্ন : আপনার অনেক কবিতা আপনার বাবাকে নিয়ে। বাবার প্রতি দূর্বলতা কেন?

উত্তর : বাবার প্রতি আমার আলাদা দূর্বলতা নাই। বরং সেটা মায়ের প্রতি আছে। তবে বাবাকে আমি খুব করে পাইনি। যদিও ক্লাস সেভেন পর্যন্ত তার গলা ধরে ঘুমিয়েছি। কিন্তু এরপর তার সঙ্গে নানা কারণে দূরত্ব বেড়ে যায়। যদিও আমরা এক ঘরেই থাকি। তিনি যেমন চেয়েছেন, আমি তেমন হইনি। আমার প্রতি তার প্রত্যাশা বেশি ছিল। তার কিছুই আমি পূরণ করতে পারিনি। আসলে পাওয়া না-পাওয়া দিয়ে পিতাপুত্রের সম্পর্ক নির্ধারিত হয় না। বড় হয়েও আমার ভেতর একটা শিশু রয়ে গেছে, সে বাবাকে আজও জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে চায়। তা সম্ভব নয়, শোভনও নয়। তাই কবিতার ভেতর দিয়েই বাবাকে আরও বেশি করে পেতে চাই।

 

প্রশ্ন : আপনি মূলত কিসের দিকে বেশি জোর দেন? নির্মাণে, না বোধে?

উত্তর : কবিতার জন্য দুটোই জরুরি। বোধই নির্ধারণ করে দেয় কবিতার নির্মিতি কেমন হবে।

 

প্রশ্ন : অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের সাথে কবিতার পার্থক্যটা কোথায়?

উত্তর : পার্থক্য অনুভূতি আর অনুভবের তারতম্যে। তা ব্যাখ্যা করা দুরূহই। যেমন সিনেমায় আমাদের দেখার মানে চোখের ভূমিকা বেশি। গানে কানের। কবিতায় প্রায় সকল ইদ্রিয়কেই সজাগ থাকতে হয়, তার ক্ষেত্রে চোখও নিতে পারে নাসিকার ভূমিকা, শ্রবণেন্দ্রিয় গ্রহণ করতে পারে চোখের ভূমিকা। কবিতাশরীর দৃশ্যমান কিন্তু কবিতা অদৃশ্য। টলটলে জলের ডোবা দেখা যায়, শীতলতা দর্শনযোগ্য নয়।

 

প্রশ্ন :কবিতার পাঠক কমের একটা অভিযোগ পাওয়া যায়? এই অভিযোগের ভিত্তি কী? উত্তরণ সম্ভব কি না? কীভাবে?

উত্তর : কবিতা সকলের জন্য নয়। যেমন জগতের অনেক কিছুই অনেকের জন্য নয়। কবিতার পাঠক কমের অভিযোগ আছেই। কারা এই অভিযোগ করে? কবির এই অভিযোগ করার দরকারই নাই। এই অভিযোগ প্রকাশকের থাকতে পারে। তিনি বিনিয়োগকারী, তার লাভ লোকসানের বিষয় আছে। তবে হ্যাঁ, কবি তো পাঠকের জন্যই লেখেন। যারা বলেন নিজের জন্য লেখেন, তাদের কথা জানি না, তবে লেখকমাত্রেরই একটা আকাঙ্ক্ষা থাকে পাঠকের কাছে পৌঁছাবার। এই অভিযোগের ভিত্তি হয়তো বিক্রয় ও বিপনণের সাথে জড়িত। উত্তরণ, যদি পাঠক কমই থাকে, সম্ভব। তার জন্য দরকার কবিতার। তার জন্য প্রচারণাও প্রয়োজন।

সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কবিতাকে অকবিতার হাত থেকে রক্ষা করা। কবির ব্যক্তিত্ববান হয়ে ওঠাও জরুরি। যদিও শামসুর রাহমান আর সিকদার আমিনুল হকের স্মার্টনেসের পর আর ব্যক্তিত্বহীন কবি থাকার কথা না। যাকে তাকে কবি সম্মোধন করাটা বাদ দেয়া উচিত। সুসম্পর্কের কবি আছে না? এইসব বাদ দিতে হবে। পাঠকেরও ভূমিকা পাল্টাবার সময় এসেছে। সবচেয়ে বেশি দরকার পাঠ্য বইয়ে কবিতা পড়ানো। কবিতার নামে যা পড়ানো হয় তার বেশিরভাগই অকবিতা। কবিতা থেকে অকবিতাকে আলাদা করলেই উত্তরণ মিলতে পারে!

 

প্রশ্ন :  আপনার কবিতায় ফিরি। বাংলা কবিতায় নানা বৈশিষ্ট্য-বৈচিত্র্য আছে। এর মধ্যে আপনার কবিতা কী স্বাতন্ত্র্য নিয়ে এসেছে। ঠিক কিসের তাগিদে লিখছেন?

উত্তর : স্বাতন্ত্র্যবোধ থাকা জরুরি এই কথা স্বীকার করেও বলি, এখনো হয়ত আমার কবিতা স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে নাই। আমারও কিছু বলতে ইচ্ছে করে। তাই লিখি। লিখতে পারলে স্বস্তি পাই বলে লিখি। এই স্বস্তিটা ঠিক কী, বোঝাতে পারবো না। বিনয়ের মতো বলি, গৃহের থেকে ভুলে বহির্গত কোনো শিশু হারিয়ে গিয়েছে পথে, জানে না সে নিজের ঠিকানা।

কবিতায় নিজের ঠিকানা খুঁজছি, এই।

 

প্রশ্ন : আদম পাহাড় নিয়ে কতটুকু সন্তুষ্ট?

উত্তর : আদম পাহাড় নিয়ে সন্তুষ্টি নাই, অসন্তুষ্টিও নাই

 

প্রশ্ন : নেক্সট বই?

উত্তর : পরের বই আসবে ২০১৯-এর দিকে! কবিতারই।

 

প্রশ্ন :  কবিতার সঙ্গে জীবনাচরণ, রাজনীতির দ্বন্দ্ব আছে কি না?

উত্তর : দ্বন্দ্ব নাই, বরং সম্পর্ক আছে। জীবনই কবিতা হয়ে প্রকাশ লাভ করে।

 

প্রশ্ন : আপনার কবিতায় প্রেম, বেদনা ছাপিয়ে সূক্ষ্মভাবে, কখনো কখনো শাদাচোখেই সমাজ-রাষ্ট্রের ব্যাপার সামনে এসে যায়। এটা নিয়ে বলেন...

উত্তর : মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী। কবিতাও তার থেকে আলাদা নয়। কবি তো নয়ই। ছাত্রজীবনে সমাজতন্ত্রী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার ফল এইটা। তা কবিতার জন্য ভাল না মন্দ, জানি না। এখন প্রত্যক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত না হলেও রাজনীতি প্রবলভাবেই কার্যকর আমার ভেতর। রাষ্ট্রকে বিনা প্রশ্নে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের যেমন জবাবদিহিতা থাকে, রাষ্ট্রকেও জনগণের চাহিদার দিকে তাকাতে হবে।

 

প্রশ্ন :  আপনার বই কতটা আপনাকে রিপ্রেজেন্ট করছে?

উত্ত : বই তো মোটে একটাই। আদম পাহাড়। ব্যক্তি আমাকে রিপ্রেজেন্ট করছে কি না, ভেবে দেখি নাই। তার দরকার করে না। আমার চিন্তা আর লেখা সব সময় এক হয় না, আবার চিন্তার ফসলও লেখাগুলো! অনেকগুলো আমি সেখানে স্থান করে নিয়েছে। তার কোনো কোনোটা ব্যক্তি আমি। কোনো কোনোটা পাঠকও। বইটা আমাকে রিপ্রেজেন্ট করে, আবার করেও না।

 

ধন্যবাদ শামশাম।

আপনাকেও ধন্যবাদ।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
নির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
শনিবার জাতীয় পার্টির বর্ধিত সভানির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত