X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্নের ভেতর স্বপ্নগুলো

শাখাওয়াৎ নয়ন
০৪ জুন ২০১৮, ১৪:১৩আপডেট : ০৪ জুন ২০১৮, ২১:৪৩

স্বপ্নের ভেতর স্বপ্নগুলো

হলিউডের একটা সিনেমা দেখলাম নাম : ইনসেপশন। মনস্তাত্ত্বিক কল্পবিজ্ঞান নির্ভর কাহিনি। আইডিয়া,এক্সট্রাকশন এবং ইনসেপশন—এমন সব বিষয় নিয়ে সিনেমার কাহিনি আবর্তিত। ড্রিম,সাবকনশাস মাইন্ড, ড্রিমস উইদিন এ ড্রিম, স্বপ্নের ভিতরে তিনস্তর গভীরের স্বপ্ন। এমনকি একজনের ব্রেইনের মধ্যে ঢুকে, আরেকজন তার স্বপ্ন চুরি করে নেয়ার বুদ্ধি; কিংবা একজনের স্বপ্ন আরেকজনের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়ার কৌশল। অন্য কথায়, স্বপ্নের ভিতরে স্বপ্ন কিংবা বাস্তবের ভিতরে বাস্তব। কি, খুব জটিল মনে হচ্ছে? আমার কাছে কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। আসলে আমাদের জীবন কিংবা চারপাশটা কিন্তু এমনই। আচ্ছা উদাহরণ দিয়ে বলছি—চিন্তা করুন।

চিন্তা (এক)

আপনি একজন মেয়ের/ছেলের প্রেমে পড়েছেন; তার সঙ্গে কোথাও বসে কফি খাচ্ছেন। আপনি কিন্তু বাসা থেকে বের হবার আগেই ভেবেছেন, কি পোশাক পড়বেন? কোন রাস্তা দিয়ে যাবেন? দেখা হবার পর কী কথা বলবেন? তাকে আপনি বিয়ে করতে চান, বিয়ের সময় কী করবেন না করবেন; আপনার বাসা থেকে কী কী করা হবে; তার বাসার লোকজন কী কী করবে? হানিমুনে কোথায় যাবেন? এমন কী আপনাদের প্রথম বেবির নাম কী রাখবেন?

চিন্তা (দুই)

আপনি সেই মেয়েটি/ছেলেটির সঙ্গে দেখা করতে যাবার সময় সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা ছিনতাইকারীর কবলে পড়লেন। এক পর্যায়ে চোখ খুলে দেখলেন, আপনি হাসপাতালে । আপনার মনের মানুষ ততক্ষণে অপেক্ষা করতে করতে রাগ করে বাসায় চলে গেছে। এদিকে আপনি যমদূতের সঙ্গে লড়াই করছেন। আপনি বেঁচে থাকবেন না কি মরে যাবেন, তা জানেন না। কিংবা বেঁচে থাকলেও জীবনে সুস্থভাবে চলাফেরা করতে পারবেন না। এমতাবস্থায়ও মনের মানুষটাকে মনে পড়ছে। ভাবছেন, এমন জীবনের সঙ্গে তাকে আর জড়াবেন না। তার সুখের কথা ভেবে, অন্য কাউকে বিয়ে করতে বলবেন।   

চিন্তা (তিন)

আপনি খুবই রোমান্টিক মুডে বাসা থেকে বের হলেন। শাহবাগে গাড়ি থামিয়ে প্রিয়জনের জন্য কিছু ফুল কিনলেন। হঠাৎ “ (অমুক)... নেতার মুক্তি চাই” লেখা ব্যানার নিয়ে একটি জঙ্গি মিছিল আসতে দেখে, ভয় পেয়ে  গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে দ্রুত যেতে বললেন। ততক্ষণে ট্রাফিক জ্যাম লেগে গেছে। গাড়ি নড়তেই পারলো না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভাংচুর শুরু হয়ে গেল। কয়েক মিনিটের তাণ্ডবে কয়েক শত গাড়ি চুড়মার। আপনার ড্রাইভারসহ আপনি ভাঙ্গা গাড়ির ভিতরে মারাত্মক আহত। আপনি ভাবছেন, বিনা দোষে এমন শাস্তি! আরে ভাই দোষ-গুনের কোনো ব্যাপার নাই এখানে। আপনি এখানে অন্যদের স্বপ্নের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিলেন। তাই না? মিছিলের লোকদের প্রতি আগেই নির্দেশ ছিল, শাহবাগে গাড়ি ভাংচুর করতে হবে। তাদের নেতার মুক্তির দাবি তাহলে জোরালো হবে। মিডিয়া কাভারেজ পাওয়া যাবে। আপনি মারা গেলে, তাদের নেতার মৃত্যুর দাবি আরো শক্তিশালী হবে। এটা তাদের স্বপ্ন।

কিন্তু যে মানুষটি আপনার জন্য অপেক্ষা করছিল, তার খবর কি? সেও তো আপনাকে নিয়ে কোনো না কোনো স্বপ্ন দেখেছে। এই যে এত এত ভাবনা, এসবের কোনো শেষ নেই। কারো কারো স্বপ্ন একের পর এক থরে থরে সাজানো আবার কারো কারোটা এলোমেলো। তবে সবকিছুই কিন্তু একটা স্বপ্নের ভিতরে অনেক অনেকগুলো স্বপ্ন। তাই না? অথবা একটি প্রধান স্বপ্নের ভিতরে অনেকগুলো ছোট ছোট স্বপ্ন। একটা বাড়ির মধ্যে অনেকগুলো রুমের মতো। যাদের স্বপ্নগুলো ঠিকমতো সাজানো নয় কিংবা লজিক্যাল অর্ডারে সাজাতে পারে না, তাদের স্বপ্ন পূরণে অসুবিধা হয়। অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা তৈরি হয়। 

দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আজকের দুনিয়ায় ভার্জিন স্বপ্নের খুব অভাব। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্যের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে করতে, আমরা আমাদের স্বপ্ন তৈরি করি কিংবা পূরণ করি। বিল গেটস তাঁর মাইক্রো সফটের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য বিশ্বব্যাপী কয়েক হাজার মানুষকে চাকরি দিয়েছে। ঐসব চাকরিজীবীরা আবার মাইক্রো সফটে চাকরি করে একটা সুন্দর বাড়ি, সুন্দর গাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখে। তাই না? 

এখন কথা হচ্ছে, এই যে আমি এসব লিখছি; আমি কি স্বপ্নের মধ্যে লিখছি? নাকি বাস্তবে লিখছি? এই ফেইসবুক কি স্বপ্ন না বাস্তব? আমার জন্ম তো আমার বাবা-মায়ের স্বপ্ন। ফেইসবুকটা তো জুকারবার্গের স্বপ্ন। আমি যে বাড়িটাতে থাকি, এটা একজন আর্কেটেক্টের স্বপ্ন। গাড়িটাও একজন ইঞ্জিনিয়ারের স্বপ্ন। সব কিছুই তো স্বপ্নের কারবার। গাড়ি কেনা কিংবা গাড়ি ব্যবহার করাটা আমার স্বপ্ন ছিল কিন্তু গাড়ি বানানোটা ইঞ্জিনিয়ারের স্বপ্ন। স্বপ্ন আবার বেচা-কেনা হয়,স্বপ্ন ধারও দেয়া যায়। স্বপ্নের হায়াত-মউতও আছে। 

কী বিপদ! একজন রবী ঠাকুর কবিতা লিখেছেন,‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল সে’। তাঁর স্বপ্ন কেমন ছিল? এই গানটি শতবর্ষ পরেও কেউ গাইবে? এই যে এত কিছু অভূতপূর্ব সৃষ্টি, সবই স্বপ্ন। একজন অর্থনীতিবিদ বলবেন, স্বপ্নই প্রবৃদ্ধি তৈরি করে। স্বপ্নই সম্পদ। আবার একজন বিজ্ঞানী বলবেন, স্বপ্নই আবিষ্কারের জননী। স্বপ্ন না থাকলে এসব কিছুই হতো না। যার স্বপ্ন যত বেশি মানুষকে আকৃষ্ট করে, সে তত বেশি জনপ্রিয়, মহান। তাই না? সেটা দর্শন, বিজ্ঞান কিংবা রাজনীতি হোক, আর অর্থনীতিই হোক, একই কথা।      

তাহলে কোনো কিছুই কি বাস্তব নয়? এই প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ আবার ‘না’। কারণ যা কিছুর পর্যবেক্ষণ কিংবা স্বাক্ষী আছে, তাই বাস্তব। এটা বস্তুজাগতিক হয়ে গেল। বিমূর্ত ব্যাখায় এটা চলে না। স্বপ্ন তো বস্তু না, চিন্তা কিংবা অবচেতন মনের স্মৃতি। তবে যা কিছু চিন্তা করা যায়, তা কোনো না কোনো ভাবে বাস্তব। বাস্তবতার বিভিন্ন ফর্ম থাকতে পারে; তারপরেও তো বাস্তব। আজকের পৃথিবীতে যা কিছু দেখছি, তা কারো না কারো স্বপ্ন ছিল। আগামী দিনের পৃথিবী কেমন হবে? তা নিয়েও অনেকে স্বপ্ন দেখছেন।

স্বপ্নের সুবিধা হচ্ছে, কোনো একটা কিছু কেউ ভাবলো, তারপর তার ধারণাটা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করলো, এমনভাবে শেয়ার করলো যে, যারা শুনলো কিংবা জানলো, তাদের অধিকাংশই তা বিশ্বাস করলো; তারপরেই আসল খেলা শুরু হয়ে যায়। কারণ স্বপ্ন বাচ্চা দিতে শুরু করে। প্রশ্ন হচ্ছে—স্বপ্নের পিউবার্টি পেতে কতদিন কিংবা বছর লাগে? মানে এডাল্ট না হলে তো কোনো প্রাণী বাচ্চা দিতে পারে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্বপ্ন যিনি তৈরি করেন কিংবা প্রচার করেন, এটা তার ওপর নির্ভর করে, কত সময় পরে এটা বাচ্চা দেয়া শুরু করবে। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী একটি স্বপ্ন, ভাইরাসের চেয়েও দ্রুতগতিতে বংশ বিস্তার করতে পারে। যিশু খ্রিস্টের বাইবেল যত সংখ্যক মানুষের কাছে পৌছাতে দুই হাজার বছর লেগেছে, মি. জুকারবার্গ ফেইসবুক ধারণা নিয়ে পাঁচ বছরের মধ্যেই তার চেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌছে গেছে। আপনি বলতে পারেন, সময়ের পার্থক্য আছে। তা ঠিক, কিন্তু ‘সময়’ কি? সময়ও তো একটি ধারণা মাত্র। তাই না? যাই হোক, ফেইসবুক ছাড়াও এমন আরো অনেক উদাহরণ আছে। বাইবেল কিন্তু অনেকগুলো ধারণার সমন্বিত একটি গ্রন্থ, ফেইসবুকও অনেকগুলো ধারণা দিয়েই তৈরি একটি ডিজিটাল প্লে গ্রাউন্ড, যেখানে সব বয়সীরা খেলা করতে পারে। বড়দের খেলাঘর, তাই না? 

লেখার শিরোনাম, স্বপ্নের ভিতরের স্বপ্নগুলোতে ফিরে যাই। এই স্বপ্ন দেখার শেষ কোথায়? একজন মানুষের জন্ম থেকে তার স্বপ্নের শুরু হয় মাত্র কিন্তু কোনো শেষ নেই। স্বপ্ন শক্তির সমার্থক, এর রূপান্তর আছে কিন্তু বিনাশ নেই। স্বপ্ন সময়েরও সমার্থক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেমন বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড বড় হচ্ছে, তেমনই স্বপ্নও বড় কিংবা স্ফীত হচ্ছে। অন্য কথায় যদি বলি—স্বপ্ন অনিঃশেষ কাঠিদৌড়ের (রিলে রেইস) মতো, একজন দৌড়ে এসে কাঠিটি আরেকজনের কাছে দিয়ে দেয় এবং চলতে থাকে। একজন  ব্রাডম্যান মারা যান, তার ব্যাটখানা আরেকজন শচিন টেন্ডুল্কারের হাতে দিয়ে। খেলোয়াড় মরে যায় কিন্তু খেলাটা মরে না। সেরকমই স্বপ্ন প্রবাহিত হচ্ছে—প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, সহস্রাব্দ থেকে সহস্রাব্দে।     

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
রংপুর হাসপাতালে বাড়ছে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী, ৫ দিনে ২২ জনের মৃত্যু
রংপুর হাসপাতালে বাড়ছে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী, ৫ দিনে ২২ জনের মৃত্যু
তুর্কি মিডফিল্ডারের গোলে শিরোপার আরও কাছে রিয়াল মাদ্রিদ
তুর্কি মিডফিল্ডারের গোলে শিরোপার আরও কাছে রিয়াল মাদ্রিদ
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!