X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১
শান্তিতে নোবেলজয়ী নাদিয়া মুরাদের আত্মজীবনী

দ্য লাস্ট গার্ল ।। পর্ব-০৫

অনুবাদ : সালমা বাণী
০৪ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:৫৯আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০১৮, ২১:৫৮

দ্য লাস্ট গার্ল ।। পর্ব-০৫ সময়টা ১৯৯৩। যে বছর আমি জন্মগ্রহণ করলাম, সে বছরই আমার বাবা মায়ের সম্পর্কের চুড়ান্ত অবনতি ঘটে। সম্পর্কের এই অবনতির নিদারুণ পরিণাম সহ্য করতে হয় আমার মাকে। এসময় আমার বাবার প্রথম পুত্র মৃত্যু বরণ করে। আমার বাবার প্রথম স্ত্রীর গর্ভে ইরাক-ইরান যুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে সে জন্মগ্রহন করেছিল। এবং তার মায়ের মৃত্যু পর,  আপন সন্তানের মতো আমার মা তাকে বড় করে তুলেছিলো। আমার মা সবসময়ই বলতো ওর মৃত্যুর পর দিনগুলো আর কখনোই আগের মতো সুন্দর সুদিন হয়নি।

কিছুদিনের ভেতরেই আমার বাবা সারা নামের আরেক নারী এনে ঘরে তোলে। এবং তাকে বিয়ে করে। দীর্ঘসময় আমার মা যে বাড়িটিকে নিজের বলে জেনে এসেছে সেই বাড়িরই আরেক প্রান্তে ঘর তুলে বাবা আমাদের সেখানে ঠেলে দেয়। আর আমার মায়ের বাড়িটিতে তাকে নিয়ে বসত শুরু করে।

খুব দ্রুত তাদের ঘরে আবার সন্তান আসে। পুরুষের বহুগামীতা ইয়াজিদি সমাজে অপরাধ হিসাবে গণ্য হয় না। সুতরাং আমার বাবাকে বহুগামিতার জন্য জবাবদিহিতা করতে হয়নি। যদিও কোচোর সব পুরুষ বহুগামী নয়। যখন আমার বাবা সারাকে বিয়ে করে তখন সে শুধু সারাকে নয়, সারার  সাথে বিশাল সম্পত্তি এবং ভেড়ার পালের মালিকানা লাভ করে। ইরানের সাথে যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে ইরাকের মানুষের জীবন-যুদ্ধে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়লো। কিন্তু যুদ্ধ অথবা নিষেধাজ্ঞা আমার বাবার অথনৈতিক অবস্থায় কোন পরিবর্তন আনেনি। আসলে আমার বাবার প্রয়োজন ছিল বিশাল এক পরিবার, যে পরিবারের সদস্যদের নিকট থেকে সে তার প্রয়োজন মতো শ্রম আদায় করতে পারবে।  কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য হলো, আমার মায়ের পক্ষে এত বড় পরিবার উপহার দেয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

সারাকে বিয়ে করার কারণে আমি বাবাকে দোষারোপ করতে পারি না। আপনি যদি বুঝতে পারেন একজন মানুষের বেঁচে থাকার শর্ত যখন নির্ভর করে কত পরিমাণ টমেটো সে ঘরে তুলতে পারলো অথবা উন্নত ঘাসের জন্য কতঘন্টা ভেড়ার পালের পিছে হাঁটলো, তাহলে সহজেই অনুমান করতে পারা যাবেকেন আমার বাবা অধিক স্ত্রী গ্রহণ করেছিল; কেন আমার বাবা  অধিক সন্তান কামনা করেছিল। এমন প্রত্যাশায় ব্যক্তিগত কারণ নিহিত নেই।  যদিও বাবার এই চাওয়ায় কোন অপরাধ ছিল না কিন্তু আমি অন্তত এটা উপলদ্ধি করতে শিখেছিলাম বাবার এই বিয়ে করার কোন যুক্তি সঙ্গত কারণ ছিল না।

আমার বাবা আইনসন্মতভাবে আমার মাকে পরিত্যাগ করে এবং আমাদের সবাইকে বসত বাড়ির মূল দালানের পেছনে দুই কামরার ছোট্ট একটি ঘরে পাঠিয়ে দেয় আর আমাদের জীবন ধারণের জন্য খুব সামান্য অর্থ এবং একটুকরো জমি বরাদ্দ করে।

বাবার নতুন বিয়েকে মেনে নেয়া ছাড়া আর কী বা পছন্দ ছিল আমার? বাবার দ্বিতীয় বিয়ের মতো উপায়হীন যন্ত্রণা নীরবে আমিও মেনে নিয়েছিলাম আর মেনে নিয়েছিলাম মায়ের হৃদয় ভাঙ্গার কষ্টগুলোকে। বাবা আমার মায়ের থেকে অধিক ভালবাসাতো তার নববিবাহিত স্ত্রী সারাকে। মা প্রায়ই আমাকে এবং আমার দুই বোন দিমাল ও আদকীকে বলতো ঈশ্বর না করুন আমার ভাগ্যে যা ঘটেছে, তোমাদের ভাগ্যে যেন তা না ঘটে। আমার মা ছিল আমার আদর্শ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি আমার মায়ের মতো হবার স্বপ্ন দেখতাম। শুধু মাত্র আমার বাবা কতৃর্ক পরিত্যাক্ত হবার ব্যাপারটি ছাড়া।

আমার মতো এরকম চিন্তা ও বোধ আমার ভাইদের ছিলো না।‘ঈশ্বর নিশ্চয় তোমাকে ক্ষমা করবে নাএবং তোমাকে অবশ্যই অন্যায়ের জন্য খেসারত দিতে হবে’বাবার উদ্দেশ্যে এইসব বলে আমার ভাই মাসউদ প্রায়ই চিৎকার দিয়ে গালাগাল করতো। বাবার মনোযোগ আকর্ষনের জন্য, বাবার ভালবাসা পাওয়ার জন্য আমার মা এবং বাবার স্ত্রী সারা সব সময়ই নিজেদের ভেতরে প্রতিযোগীতায় ব্যস্ত থাকতো। আমরা সব ভাইবোন উপলদ্ধি করেছি, আমার মা এবং সারাকে এক বাড়ীতেযদি বসত করতে না হতো তাহলে আমাদের জীবন অনেক সহজ আর সুন্দর হতো যদি।

বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া আমাদের জন্য খুব বেদনাদায়ক ছিল। যে বাড়িতে আমি জন্মগ্রহণ করেছি, জন্ম থেকে যার উঠোনে খেলে বড় হয়েছি, সেই বাড়ি পাশ দিয়ে হেটে পার হয়ে এ্যালিমেন্টরি স্কুলে যেতাম।

কোচো খুব ছোট শহর ছিলো। যে কারণে বাবা সারাকে নিয়ে বেড়াতে বের হলে সহজেই আমরা  চোখে সেটা ধরা পড়তো। এসব দেখা ছিল খুব কষ্টের, তবুও খুব দ্রুত আমরা সব পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শিখেছিলাম। বাবাদের বাড়ির কুকুরটার কাছে আমি এত পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম যে, আমাকে দেখলে সে আর ঘেউ ঘেউ করে চেঁচাতো না। আমরা ভাইবোনেরা ছুটির দিনগুলো বাড়িতে এক সাথে কাটাতাম। বাবা প্রায়ই ড্রাইভ করে আমাদের সিনজার শহরে অথবা পর্বতের পাদদেশে বেড়াতে নিয়ে যেত।

২০০৩ সালে বাবা হৃদরোগে আক্রন্ত হয়। আমরা ভাইবোন সবাই নীরব দর্শকের মতো দেখলাম একজন শক্ত সবল মানুষ কিভাবে অসুস্থ হয়ে দ্রুত বৃদ্ধ হয়ে গেল। আর হাসপাতালের হুইল চেয়ার হলো তার আশ্রয়। কিছুদিনের ভিতরে যখন বাবা মৃত্যূবরণ করলো, তখন আমাদের মনে হলো বাবা যা কিছু লজ্জাজনক কাজ করেছে সেটা তার নৈতিক অবক্ষয়, চরিত্রের দূর্বলতার জন্য নয়। বরং এটা করেছে কারণ তার শারীরিক অবস্থার কারণে। বাবার সাথে দূর্ব্যবহার, চেঁচামেচি করা সেই দিনের কথা স্মরণ করে মাসউদ মানসিক কষ্ট ও অনুতাপে ভুগতো। তখন তার ভেতর এই অনুভূতির জন্ম নেয় আমাদের বাবা সবকিছু সামাল দেওয়ার মতো বীর পুরুষ ছিল।

আমার মা ছিলো অতিরিক্ত ধর্মভীরুও ধর্মপরায়ণ। বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎবাণীর  জন্য ইয়াজিদিরা যেসব ধমীর্য় প্রতিকৃতি ব্যবহার করতো ও স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতো তার সবটুকুর ওপর আমার মায়ের গভীর ভক্তি ও বিশ্বাস ছিলো। যখন সন্ধ্যা হতোতখন তাকে দেখতাম উঠানে প্রদীপ জ্বালাতে। সে বলতো এই প্রহরে সন্তানরা দূর্ঘটনা, অসুস্থতা সহ নানা রকম বালা মসিবতের ঝুঁকিতে থাকে। আমার সন্তানদের মঙ্গলের জন্য আমি ঈশ্বরের কাছে সারাক্ষণ প্রার্থনায় থাকি।

প্রায়ই আমি হজমজনিত কষ্টে ভুগতাম। মা আমাকে তখন হারবাল চিকিৎসার জন্য ইয়াজিদি কবিরাজের কাছে নিয়ে যেত। আমি রীতিমতো ঘৃণা করতাম কবিরাজের দেয়া তরল ঔষধ আর চায়ের স্বাদটাকে। কিন্ত মায়ের আদর সোহাগ ভরা মিনতির কাছে হার মেনে আমাকে সেসব ঠিকই গিলতে হতো। আর যদি কেউ মারা যেত মা তড়িঘড়ি করে ইয়াজিদি তান্ত্রিক যাকে ইয়াজিদি ভাষায় কোচো বলা হয়, তার কাছে রীতিমতো ছুটে যেত। মৃতের আত্মা পরলোকের জীবনে প্রবেশ করেছে এই আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত সে কোচোর কাছে ঠাই বসে থাকতো।

তীর্থযাত্রী ইয়াজিদিরা লালিশ থেকে ছোট্ট মাটির টুকরা নিয়ে আসতো। লালিশ হচ্ছে উত্তর ইরাকের সেই উপত্যকা যেখানে আমাদের পবিত্র মন্দির অবস্থিত। ইয়াজিদিরা এই পবিত্র মাটির টুকরা তিনকোণা কাপড়ে পেঁচিয়ে পকেটে অথবা মানিব্যাগে রেখে দিত। ইয়াজিদিরা বিশ্বাস করতো ঈশ্বর প্রদত্ত এই মাটির টুকরা তাদের সাথে থাকলে ঈশ্বরের কৃপায় তারা সব রকম বিপদ থেকে রক্ষা পাবে এবং তাদের জন্য মঙ্গলময় হবে।

আমার মা সর্বদা এই পবিত্র মাটির টুকরা সাথে রাখতেন। বিশেষ করে আমার ভাই যখন চাকরিতে যোগ দিল এবং সৈনিকদের সাথে প্রতিদিন কাজের উদ্দেশ্যে রওনা হতো, মা আমাকে বলতোযত রকমের রক্ষকবচ আছে তার সবই তোমার ভাইদের জন্য দরকার নাদিয়া। কারণ জীবিকার জন্য ওরা যে পেশা গ্রহণ করেছে তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।  

মা ছিল কঠোর পরিশ্রমী এবং বাস্তববাদী। স্বচ্ছল জীবনের স্বাদ দেয়ার জন্য সে যে কোন   প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্র্রস্তুত ছিল। ইয়াজিদিরা ছিল ইরাকের দরিদ্রতম জাতিগোষ্ঠীর অন্যতম। কোচোর আর্থ-সামাজিক অবস্থানে আমাদের পরিবারের অবস্থান ছিল একেবারে নীচে। পিতার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার কারণে আমরা আরও দরিদ্র হয়ে পড়ি। আমার ভাইয়েরা দিনের পর দিন কোদাল দিয়ে পাথরের মতো শক্ত মাটি কেটে কূপ খননের মতো কঠিন কাজ করেছে। এসব কাজে ভুল হলেই সম্ভাবনা থাকতো হাড়গোড় সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবার। একটুখানি ভুলে ঘটে যেতে পারতো ভয়ংকর দূর্ঘটনা।

ওই সময়টাতেভাইদের সাথে আমার মা ও বোনেরা অন্যের জমিতে চাষাবাদের কাজ করতো।  টমেটো ও পিঁয়াজ চাষ করে যে আয় হতো তাই দিয়ে সংসার চালানো ছিলো কঠিন। জীবনের প্রথম দশ বছর রাতের খাবারের সাথে কখনো মাংস খেতে পাইনি। শুধু সবজি-সেদ্ধ দিয়ে রাতের খাবার খেতে হতো। আর আমার ভাইদের পুরাতন প্যান্ট ছিড়ে শরীর দেখা যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আরেকটি নতুন প্যান্ট কেনা হতো না।

দারিদ্র বিমোচনে মায়ের কঠিন পরিশ্রমের কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ। ২০০৩’র পর নর্দান ইরাকের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটলে সমগ্র ইয়াজিদিদের সাথে আমাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটতে থাকে। সেন্ট্রাল এবং কুর্দিস সরকার ইয়াজিদিদের জন্য চাকুরি পদ উন্মুক্ত করলে আমার ভাইয়েরা বর্ডার গার্ড এবং পুলিশে চাকরি গ্রহণ করে। অবশ্যই এসব ছিল ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। আমার ভাই জালো পুলিশের যে বিভাগের চাকুরিতে নিয়োগ পেয়েছিল সেখানে তাদের দায়িত্ব ছিল তাল আফার এয়ারপোট পাহারা দেয়া। তাদের বেতন ছিল লোভনীয়। কিন্তু চাকুরীর প্রথম বছরেই সম্মুখ যুদ্ধে তাদের অনেকেই প্রাণ হারায়। আমার ভাইদের ভাল আয়ের কারণে প্রথম বছরেই আমরা বাবার দয়ার এক টুকরো ভিটে ছেড়ে আমরা আমাদের নিজ গৃহে চলে যেতে সক্ষম হই।

গভীর ধর্মভক্তি এবং সততার জন্য আমার মায়ের সুখ্যাতি ছিল। এছাড়া মানুষের মাঝে আনন্দ বিলানোতে মায়ের অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। এমনকি, কঠিন পরিশ্রমের কাজ করার সময়গুলো পর্যন্ত সে হাসি-ঠাট্টায় ভরিয়ে তুলতো। ঠাট্টার ছলে সব সময়ই বলতোআর যাই করি, দুবার বিয়ে বসবো না। কেউ বিয়ে করতে চাইলে তাকে ঝেটিয়ে বিদায় করবো।

ঘটনাটা ঘটেছিল তাই। মায়ের রূপের গল্প কোচোর বাইরেও বহুদূর ঘুরে বেড়াতো। আগেও বলেছি আর সেই রূপে মুগ্ধ হয়ে আমার বাবা তাকে বিয়ে করার জন্য পাগল প্রায় হয়ে গিয়েছিল। যা হোক, বাবার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর কোচোর এক ধনী মায়ের পানি প্রার্থনার জন্য আমাদের দরজায় এসে উপস্থিত। যে কথা সে কাজ, মা এতই ক্ষিপ্ত হয়েছিলো যে, একখানা লাঠি নিয়ে মা ছুটে এসেছিল সেই লোকটিকে পেটানোর জন্য। ভীত সন্ত্রস্ত ভেড়ার মতো লোকটা ইজ্জত নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছিল সে যাত্রায়। বহুদূর খেদিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে মা যখন বাড়ি ফিরে আসে, হাসতে হাসতে তার দম আটকে যাচ্ছিল! হাসিতে গড়াগড়ি দিয়ে অভিনয় করে মা যখন দেখাচ্ছিল বেটা কী করে ল্যাজ গুটিয়ে, প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে—বেটা এমন ভয় পেয়েছে তোদের দেখা দরকার ছিল। মায়ের এই বলার ধরনে আমরা ভাইবোনেরা সবাই হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে লুটিয়ে ছিলাম। মা তখন আমাদের আরও হাসানোর জন্য বলতো—আমি যদি এখন ঐ ব্যাটাকে বিয়ে করি তাহলে লোকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাবে—এই সেই ব্যাটা, বুড়ির লাঠির খ্যাদানিতে যে পালিয়েছিল। হাসতে হাসতে আমাদের দম আটকে যাবার দশা হতো।

যে কোন বিষয় নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল আমার মায়ের—যেভাবে আমার বাবা তাকে পরিত্যাগ করেছিলো, সাজগোজ মেক আপের ব্যাপারে আমার দূর্বলতা, এমন কী তার নিজের দাম্পত্য জীবনের ব্যর্থতা, সব কিছু নিয়েই সে মজা করতো। আমার জন্মের পূর্ব পর্যন্ত সে বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রে যেত।কিন্তু আমার জন্মের পর সেটা আর পেরে ওঠেনি। যখন আমি একটু  বড় হয়ে উঠলাম তখন সে আমার কাছ থেকে পুনরায় পাঠ নেয়া শুরু করলো। আমিও তাকে পড়িয়ে খুব মজা পেতাম। তার আশ্চর্যরকমের, খুব দ্রুত পাঠ রপ্ত করার ক্ষমতা আর আশ্চর্য স্মরণ শক্তি ছিলো।তার প্রাঞ্জল হাসি দিয়ে কোন ভুল হলে সে সেটা সহজে গ্রহন করতে পারতো, আর তার শুধরে নেয়ার ইচ্ছা শক্তি ছিল প্রবল।

শীতের সকালে আগুন পোহানোর জন্য যখন রুটি সেকার সময় আমরা মাটির চুলার পাশে বসে থাকতাম, তখন মায়ের সাথে অনেক মজার মজার গল্প হতো। আমার জন্মের পূর্বে জন্ম-নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতার গল্পগুলো সে যখন আমাকে এত মজা করে শুনাতো, আমার তখন মনে হতো বহুবছর আগে পড়া কোন গল্পের বইয়ের গল্প সে আমাকে শুনাচ্ছে। গর্ভধারনের ব্যাপারে তার অনীহা, অনিচ্ছার গল্পগুলো দারুন হাস্যকর হলেও এখন সে গভীর মমতায় বলে—তুমি জন্মের সাথে সাথে তোমার মুখখানি দেখামাত্র আমি তোমাকে এত গভীর ভালবাসলাম এবং ভুলে গেলাম জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা। এখন তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকাটা কল্পনাও করতে পারি না। 

যখন মা আমার ছোট বোন অথবা আমার ভাতিজিকে আদর করতো আমি তখন অভিমান করে মায়ের সাথে কথা বলতাম না। এটাতে মা খুব মজা পেত। সব সময়ই মায়ের কোলে মাথা রেখে বলতাম—তোমাকে ছেড়ে আমি পৃথিবীর কোথাও কখনো যাবো না। এবং সত্যিই জন্মের পর থেকে  আইসিসরা কোচোতে এসে আমাদের পরিবার ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করার পূর্ব পর্যন্ত আমি আমার মায়ের সাথে এক বিছানায় ঘুমিয়েছি। যুগপৎভাবে সে ছিল আমাদের মা ও বাবা দুটোই। মাকে আমরা আরও গভীর ভালবাসি যখন আমরা অনুভব করতে শিখলাম কী ভয়ানক বিচ্ছেদ যন্ত্রণায় সে জর্জরিত হয়েছে! পরিবারের সাথে আমি এত বেশি জড়িয়ে ছিলাম যে, এই পরিবারের বাইরে অন্যত্র  বসত দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।

বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বসতের সম্পূর্ণ অযোগ্য একটি স্থান কোচো। বহিরাগতদের কাছে কোচো সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন দরিদ্রের কশাঘাতে জর্জরিত উৎপাদনের অযোগ্য ভুখন্ড। অন্তত আমেরিকার সৈন্যবাহিনী সেই ধারণা পেয়েছে। কারণ ওরা যখন আমাদেরকে পরিদর্শনে এসেছে ওদের গাড়ি বহরের পেছনে শত শত শিশু কিশোর ক্যান্ডি আর পেন এর জন্য ছুটেছে। ভিক্ষার চাওয়া সেই শিশু কিশোরদের মাঝে আমিও ছিলাম।

নির্বাচনের আগে কুর্দিস নেতাদের দু-একবার কোচোতে দেখা যেত বৈকি। তার ছাড়া কুর্দিস রাজনৈতিক নেতারা কখনোই কোচোতে আসতো না। ২০০৩ সালের পর কেচোতে বারযানি এর কুর্দিস্থান ডেমোক্রেটিক পার্টি ‘কউচ’ নামে দুই কক্ষের ছোট অফিস রুম উদ্বোধন করে। এটা ব্যবহৃত হতো গ্রামের পুরুষদের ক্লাব ঘরের মতো। যারা পার্টির সদস্য তারাই মূলত এই পার্টি অফিসে আড্ডা দিত। কোচোর সাধারণ মানুষেরা অভিযোগ করতো এই ক্লাবে গেলে তাদেরকে বারযানির কুর্দিস্থান ডোমোক্রেটিক পার্টির সদস্য পদ গ্রহনে চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাদেরকে জোরপূর্বক বলানোর চেষ্টা করা হয়, ইয়াজিদিরা পূর্বে কুর্দ ছিল এবং সিনজার ছিল কুর্দিস্তানের অংশ বিশেষ। ইরাকের রাজনীতিবিদরা ছিল আমাদের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। আর সাদ্দাম সব সময়ই প্রচেষ্টা চালিয়েছে আমাদেরকে দিয়ে স্বীকার করাতে যে, আমরা আরবীয়। আমাদের জাতিগোষ্ঠী ও জাতিসত্তাকে সব সময়ই হুমকির সম্মুখে রাখা হয়েছে যাতে করে আমরা কখনোই বিদ্রোহী হয়ে উঠতে না পারি।

কোচোতে আমাদের বসতের ব্যাপারটা সাদ্দামের নিকট ছিলো অনেকটা বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের মতো। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সাদ্দাম জোরপূর্বক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের তাদের গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর করা শুরু করে। তারমধ্যে কুর্দ এবং ইয়াজিদিরাও ছিল। সিনডার-ব্লক হাউজিং নামে পরিকল্পিত হাউজিং কমিউনিটিতে এই সব ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বসতের জন্য নির্ধারন করা হয়। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ। এটাকে উত্তরের জনগোষ্ঠীর ‘আরবীয়করণ’ বলেপ্রচার চালাতে থাকে। (চলবে)

আরো পড়তে ক্লিক করুন: দ্য লাস্ট গার্ল ।। পর্ব-০৪ 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
লোকসভা নির্বাচন: প্রথম ধাপে পশ্চিমবঙ্গের ৩ আসনে ভোট আজ
লোকসভা নির্বাচন: প্রথম ধাপে পশ্চিমবঙ্গের ৩ আসনে ভোট আজ
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
সর্বাধিক পঠিত
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন