মোহাম্মদ সাদিক
জলটলমল
জলের ভেতরে মাছ, মাছের ভেতরে নদী
জল কি ইলিশ?
ঘড়ার ভেতরে জল, পৃথিবীর তিন ভাগ
শরীরে সমস্ত আয়ু জলে ঢাকা
আমি সেই জলে ভাসমান নদী, নদীতে আকণ্ঠ জল
নৌকার ছইয়ের ভেতর জলচোখ
পাটাতনে জলের আওয়াজ
এইসব জল নিয়ে জলটলমল আমি যদি
মাছ হই, যদি সে ইলিশ
লোনা জল ছেড়ে আমি তোমাদের দেশে
অথবা ইলিশ নই, মেঘ হয়ে বিকেলের বৃষ্টির বেশে।
জহর সেনমজুমদার
খাঁচা
তোমার আলোয় তোমার অন্ধকারে খাঁচা ও ক্যালেন্ডার ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর
হয়; আমি মেঘাবৃত পাখিওয়ালা; আমি ফোস্কাপরা পাখিওয়ালা; হরিণীর পিছু পিছু
ছুটতে ছুটতে আজ অতিশয় ক্লান্ত, ভাঙা হাড়ে সাপলুডো তৈরি করলাম; তুমি এই
সাপলুডোয় একবার পা রাখবে? আমাদের খোকাখুকি চারিদিকের নির্জনতায় শিখা
জ্বালিয়েছে; শিখ শিখা; ক্ষুধা ও লেহনের শিখা; ক্ষুধা ও ঢেকুরের শিখা; ভেজা
আঁতুড়ঘরে এখনো সাপের মণি পড়ে আছে; ভেজা আঁতুরঘরে এখনো ব্রহ্মাণ্ডের
রক্তমাখা অগ্নিশিল্প পড়ে আছে; তোমার আলোয় তোমার অন্ধকারে আমি সেই
মেঘাবৃত পাখিওয়ালা, ডোরাকাটা মেয়েদের চর্বি ও চুম্বক নিয়ে আস্তে আস্তে দরজা
খুলি, আস্তে আস্তে জানালা খুলি, আর চোখ মেলে দেখি—অন্ধ এক শিক্ষিকাকে
চারিপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে অজস্র ভাঙা ভাঙা হারমোনিয়াম...
মাসুদ খান
মৌসুম
গাছগাছালিরা আবার প্রকাশ করবে পত্রপত্রিকা।
কীটাক্ষরে ছাপা হবে তাতে কথা ও কথিকা, কবিতাও...
মহোৎসব লেগে যাবে বানানভুলের, কাটাকুটি,
নিরক্ষর পাতায় পাতায়।
‘আমার লাইন হয়ে যায় আঁকাবাঁকা, ভালো না হাতের লেখা...’
গাইতে গাইতে এই তো এখনই ছুটে যাচ্ছে কাঠবিড়ালির শিশুকন্যা।
তার ফোকলা দাঁতের খিলখিল হাসির হিল্লোলে
আগাম চেয়ার উল্টে পড়ে যাচ্ছে ওই
দ্যাখো সাপ্তাহিক কলাকাণ্ডের ঘোড়েল সম্পাদক।
রসিক পাঁকের মধ্যে খাবি খাচ্ছে সম্পাদনা, মৌসুমি আহ্লাদে।
অপরের ভাব ভাষা চুরি করে পাইকারি চালান দিতে গিয়ে
ধরা খেয়ে জব্দ বসে আছে বর্ণচোরা দুই চতুর চড়ুই।
শরমে স্থগিত করে দিচ্ছে পত্রপ্রকাশনা আপাতত
শতশত ধোঁকা-খাওয়া মাটি-ঝোঁকা রাংচিতা-ঝোপ,
আলাভোলা আশশেওড়ার ঝাড়।
আর ক-টা দিন পর
উড়াল কটাক্ষ ছুড়তে ছুড়তে গাছ থেকে গাছে
উড়ে যাবে উড়ুক্কু শিয়াল, গিরগিটি বহুরূপী...
আর প্রকাশিত পত্রপত্রিকা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে বলে
দুড়দাড় গাছে উঠে পড়বে
আরোহসক্ষম বেশ কিছু বন্য বেল্লিক ছাগল।
তারা খুদে পত্রগুলি খাবে আগে।
তারেক রেজা
নববর্ষ ১৪২৩
আমার খুবই একা লাগে, তোমার?
ভ্যাপসা গরম, তপ্ত হাওয়া
লাজ-শরমের মাথা খাওয়া
ইচ্ছেগুলো পেরেক ঠুকে
আটকে রাখি একলা বুকে
ভয়ে থাকি জীবন্ত হাত-বোমার।
দূরে কোথাও যেতেই পারি, যাবো
কাছের শহর ঠেলছে গাড়ি
এই প্রতিদিন অফিস-বাড়ি
চাল নুন তেল সব্জি বাজার
একই জীবন ঘষা-মাজার
ক্লান্তি ঝেড়ে মুক্তি কোথায় পাবো?
চোখ দেখে কি পাঠ করা যায় মন?
কতো রকম চশমা আঁটা
কে বন্ধু কে পথের কাঁটা
কবে যে কার মুখ দেখেছি
কখন কোথায় ভুলে গেছি
কে করে কার মুখোশ উন্মোচন?
বদলে যাওয়ার গান আমিও জানি
পুড়তে থাকি কেবল রোষে
তাই কি আমার কপাল-দোষে
কণ্ঠ ফাঁটে কান্না ও চিৎকারে?
এ দুর্দিনে কেউ কারো ধার ধারে?
এভাবে কি ব্যর্থ হবে বিশ্বকবির বাণী?
চৈত্র শেষে বৈশাখ আসে, আসুক
ভাবছি এবার নববর্ষে
জ্যোতিষবাবুর পরামর্শে
ছেড়ে দিয়ে শীর্ণ শহর
খুঁজে নেব জলের নহর
পুরনো প্রেম নতুন হ্রদে ভাসুক।
মোস্তফা তারিকুল আহসান
আমি যদি কবিতায় আক্রান্ত হই
আমি যদি খুব ভোরে উঠে সিলভিয়া ফুলের সাথে আড্ডা দেবার ফাকে গুটি কয়েক লাইন
পেয়ে যাই ফাকতালে তাহলে কারোর কী কোন ক্ষতি হয়? পৃথিবীর কী কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হয়?
কোন বুনো মোষ কী ঢুকে পড়ে গৃহস্থের উঠোনে? তবু আমাকে নিয়ে মানুষের অহেতুক
চঞ্চলতা দেখে আমার শরীর উষ্ণ হয়ে ওঠে; কত বড় পৃথিবীর কত বড় সব ব্যাপার স্যাপার
সেখানে আমার মতো চুনোপুটি নিজেকে নিয়ে আদিখ্যেতা করলে তো কারো কিছু আসে যায়
না। কারো কোন ক্ষতি না করেও তো আমার শান্তি নেই: যারা সারাদিন ব্যস্ত মানুষের
ভালোমানুষি নিয়ে থাকে তাদের নিয়ে আমার তো মাথা ব্যথা নেই; তবে তারা কেন আমাকে
বিরক্ত করে প্রচণ্ড সকালে? যখন সূর্য হামাগুড়ি দিয়ে কাঠবেড়ালির লেজ ধরতে
ব্যস্ত, বোগেনভিলিয়ার ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসছে শ্যামা রাতের নিদ্রা ছেড়ে ;আমিও ব্যস্ত
আমার কথাবস্তুর সুত্র নিয়ে,জীবনের খোলা জানালায় চোখ রেখে দেখে নিচ্ছি আলো সেখানে
তোমাদের কাছে বিনতি আমাকে নিয়ে তোমাদের ব্যস্ততা থামাও। আমি থাকতে চাই আমার
পঙক্তি নিয়ে আমার স্বর আর ব্যঞ্জনা নিয়ে আমার কবিতার শরীর আর কমনীয়তা নিয়ে।
অলঙ্করণ, সঞ্জয় দে রিপন