X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষমা করবেন ‘মহাভারতের পাখি’

সরোজ মোস্তফা
০২ আগস্ট ২০১৭, ২২:২৭আপডেট : ০২ আগস্ট ২০১৭, ২২:৪৯

খালেদ মতিন
‘মহাভারতের পাখি’ আপনি চলে গেছেন। আপনার বাড়ির মসজিদ থেকে মিষ্টি কণ্ঠে ঘোষণা আসছে মোহনগঞ্জ কলেজের বাংলার প্রাক্তন অধ্যাপক খালেদ মতিন চলে গেছেন। মুয়াজ্জিনের এই বার্তার সাথে ‘মহাভারতের পাখি’ গন্ধরাজের সাদা রাতের দিকে উড়ে যাচ্ছেন। উড়ে যে যাচ্ছেন দেখা যাচ্ছে। যেতে যেতে আপনি বলছেন, ‘তোমাদের না বলে চলে গেলাম। আমি ঠিক তোমাদের মতো না। তোমরা বলে কয়ে সব কিছু পার। আমি পারি না। আমি শুধু কবিতা লিখতে পারি। আমি সনেট লিখতে পারি। হাজার খানেক সনেট লিখেছি। কিছু সনেট সময় খেয়ে ফেলবে। কিছু সনেট মগরায় ভিজে যাবে। আমার বাড়ির গন্ধরাজ হয়ে কিছু সনেট থাকবে। থাকলে থাকুক, না থাকলে নাই। আমার আক্ষেপ নাই। আমার বই কেউ প্রকাশ করবে না। আমার লেখা কোনো সম্পাদক ছাপায় না। কেউ লেখা চায়ও না। আমার লেখার আমিই প্রকাশক। তোমরা আমার কথায় হাসতে পার। কিন্তু কবিতা-যাপন ছাড়া আমি কিছুই করিনি। আমি একটা ডালিম ফুলের মতো আমার চোখেই পৃথিবী দেখেছি। ছোট্ট চোখের নীরব দৃষ্টিতে পৃথিবীকে লিখেছি। আমি যাচ্ছি। তোমাদের প্রশংসা কিংবা হাততালির জন্য আমি লিখিনি। আমি খুব ছোট্ট একটা মানুষ। আমার বলার একটা ভাষা ছিলো। কিছু আবেগ ছাড়া আমার কোনো ভুল নাই। আমি যাচ্ছি। তবে, চকবাজারের চায়ের দোকানে মাঝে মাঝে এসো। কথা বলা যাবে। আমিও আসবো। এখন যাচ্ছি। আমি মহাভারতের পাখি। আমি দূরেই যাবো।’

দুই

একটা অটোর ধাক্কায় এই অর্ধমৃত শহর ছেড়ে চলে গেলেন ‘চাঁদ ও ফাহিয়েনে’র দীর্ঘ পরিব্রাজক। দশ-বারোদিন আগেও কবিকে দেখেছি। রাত ১২টায়ও আপনাকে চকবাজারের টি-স্টলে বসে থাকতে দেখতাম। সবাই জানতো আপনি কবি। আপনার বাড়ির পাশে নদী ও গন্ধরাজ। এই গলিত শহরে আপনার চেয়ে স্পষ্ট ও সুন্দর আমরা দেখিনি।  একটা সময়ে যাপিত জীবনের গান খুব কম গায়কই গাইতে পারেন। আপনি খুব নীরবে আপনার গানগুলো গেয়েছেন। কে শুনবে আপনার গান কিংবা কে শুনবে না আপনার গান- এই নিয়ে কোন দ্বিধা আপনার ছিলো না। একটা ছোট্ট ঝোলা কাঁধে আপনি শহরের কৃষ্ণচূড়ার ছায়াগুলোকে তুলে এনেছেন। মানুষের চোখের তৃষ্ণাকে আপনি লিখেছেন। নেত্রকোণার ছোট্ট শহরটায় প্রত্যাশাহীন হৃদয়ে দেখে আপনি হেঁটেছেন। এই শহরে আপনার চেয়ে সুন্দর করে আর কে হাঁটতে পেরেছেন। আপনার সময়ে পাঠক কিংবা প্রকাশকের দিকে না তাকিয়ে আপনি আপনার পাঁজরের কথা নিজের রঙ ও ভাষায় লিখেছেন। নিজের জীবনকথা নিজের রঙে ও ভাষায় বলাটাই কবিতা। আপনি ‘চাঁদ ও ফাহিয়েনে’র সাথি। আপনাকে কে আটকাবে। কিন্তু আমাদের দুঃখ আমরা আপনাকে চিনতে পারি নি। একটা উচ্ছ্বাস আর স্বীকৃত বাঁশির দিকে ঝুঁকে গিয়েছিলো আমাদের মন। আমরা আপনার বাঁশির স্বরকে চিনতে পারিনি। আমরা আপনাকে যত্ন করতে পারিনি। আপনার সনেটগুলোর ছবি ও ভাষাকে, বিষাদ ও আশাকে বাংলা কবিতার পাঠক স্পর্শ করতে পারেনি। এটা হয়তো অপরাধ। কিংবা স্পষ্ট উদাসীনতা। এই অপরাধ কেউ ধুঁয়ে দিতে পারবে না। আমরা শুধু উনার কাব্যগ্রন্থগুলোতে শান্তি খুঁজতে পারবো। উনার গ্রন্থগুলো পড়লেই কবি খালেদ মতিনকে বারবার খুঁজে পাওয়া যাবে। ‘মহাভারতের পাখি’ বারবার চকবাজার টি-স্টলগুলোতে চা খেতে আসবেন। আমাদের আশীর্বাদ করবেন।

তিন 

অবসরপ্রাপ্ত বাংলার অধ্যাপক খালেদ মতিন একই সঙ্গে কবি, কথাশিল্পী  অনুবাদক ও প্রবন্ধিক। মঙ্গলবার রাত পোনে ৯ টায় তিনি রাজধানীর মনোয়ারা হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। গত চারদিন আগে নেত্রকোনায় তাঁর বাসার অদূরে একটি অটোরিকশা কবিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।  স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে দ্রুত ঢাকায় এনে মনোয়ারা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে দুইদিন লাইফ সাপোর্টে রাখার পর চিকিৎসকেরা বেডে পাঠিয়ে দেন। সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।

কবি খালেদ মতিনের জন্ম ১৯৪৯ এর ১২ জানুয়ারি, নেত্রকোণায়। নেত্রকোণার দত্ত হাই স্কুল থেকে ১৯৬৫-তে এসএসসি মানবিক বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭-তে নেত্রকোণা কলেজ থেকে এইচএসসি মানবিক বিভাগ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ১৯৭০ ও ১৯৭১ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে অর্নাস ও এমএ পাস করেন। নেত্রকোণার লোকায়ত সমাজ, সংস্কৃতি ও ভূপ্রকৃতির সহজাত টানে শৈশবেই লেখালেখির শুরু। কথাশিল্পী খালেকদাদ চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত পাক্ষিক ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায় ৬০ দশকের প্রথম থেকে খালেদ-বিন-আস্কার ছদ্মনামে আত্মপ্রকাশ। এই পত্রিকায় কবি নির্মলেন্দু গুণ ও কবি রফিক আজাদের সাথে নিয়মত কবিতা লিখেন তিনি। ষাটের দশকে দৈনিক সংবাদ ও আজাদসহ তখনকার প্রধান পত্রিকাগুলোতে কিঞ্চিৎ পরিচিতি গড়ে উঠলেও ৬০ দশকের শেষ পর্যায়ে অনার্সের ছাত্র থাকাকালে একবার বাড়ি ফিরে দেখেন কবিতার খাতাগুলো সবই সের দরে বিক্রি হয়ে গেছে। এ ঘটনা কবিকে মর্মাহত করে। সাময়িকভাবে কিছুদিন বন্ধ থাকে কবির লেখালেখি। স্বাধীনতার পর নতুনভাবে আবার মনোনিবেশ করেন। কিন্তু মফস্বলে বসবাস আর মুখচোরা স্বভাবের জন্য কবি হয়ে যান পাঠক ও প্রকাশক বিচ্ছিন্ন। এসময় তিনি তাঁর নামও পরিবর্তন করেন। খালেদ-বিন-অস্কার ছদ্মনামে নব্বই দশকব্যাপী ‘দৈনিক খবর’ পত্রিকায় কবিতা ছাড়াও বিচিত্রবিষয়ক কলামিষ্টরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। ২০০০ সালে এসে আবারো কবি সমুদ্র গুপ্তের পরামর্শে খালেদ মতিন রূপে আত্মপ্রকাশ করেন।
এ পর্যন্ত তার প্রায় ৭০০’র অধিক সনেট প্রকাশিত হয়েছে। অপ্রকাশিত আছে ১০০০/১৫০০ কবিতা। ৭০/৮০ ছোট গল্প, কয়েকটি উপন্যাস ও শতাধিক প্রবন্ধ নিবন্ধসহ অনেক লেখাই আজো অপ্রকাশিত।
কবির প্রকাশিত গ্রন্থ মাত্র ৭টি । শবাধারে মমি (৫২ কবিতা), মহাভারতের পাখি ( ১০০ সনেট ৪৩ কবিতা) চাঁদ ও ফাহিয়েন (৩০০ সনেট ১১ কবিতা) অর্মত হরিণ (২০০ সনেট ২১ কবিতা) । গল্প সংকলন সম্রাজ্ঞীর পাশে এক রাত (১৪ গল্প) রাজভোগ (২৭ গল্প) ও মহাজল (কাব্যগ্রন্থ)

চার

বইয়ের প্রচ্ছদ কবি রিফাত চৌধুরী ‘শবাধারে মমি’  এবং ‘মহাভারতের পাখি’ পড়ে বলেছিলেন, ‘আপনার কবিতা একটু পুরনো ধাঁচের। কিন্তু এর বিষয় ও ঐশ্বর্য সাংঘাতিক।’ আসলে কবি খালেদ মতিন কখনই কবিতার ভাষা ও নান্দনিকতায় মনোযোগ দেননি। তিনি একটা জীবনকে লিখেছেন। ছলেবলে-কৌশলে কবিখ্যাতি বাগানো তার কর্ম ছিলো না। একটা নিখুঁত কবির জীবন তিনি যাপন করেছেন। কবিতার ভেতরেই আছে কবিতর আত্মজীবন। দুর্বোধ্যহীন সহজ তাঁর কাব্যভাষা। এইযে তাঁ কাব্যভাষাকে পুরাতন বলা এর জবাবে কবি বলছেন, ‘আধুনিক কবিতা হাল্কা শব্দ ও তুলনামূলক লঘু ভাষায় রচিত হতে হবে এমন কোন যুক্তিতে আমি বিশ্বাসী নই। কবিতার ভাষা শব্দের ব্যবহার হবে বিষয়ানুগ। কোথায়  তৎসমতেবং কোথায় তদ্ভব বা দেশিবিদেশি শব্দের ব্যবহার হবে, তা নির্ভর করে কবিতার বিষয় ও কবির নির্মাণকৌশলের ওপর। এমনকি কবিতাটি কোন সুরে, কোন ছন্দে গাইতে হবে, তা-ও কবিতার বিষয়গত অন্তর্নিহিত তাতপর্য থেকেই কবির উপলব্ধি হবে। ফলত কবি সে ছন্দেই কবিতাটি রচনা করবেন। আমার সনেট-অসনেট নির্বিশেষে, সমস্ত কবিতার ভাষাই ক্লাসিক্যাল।’
আপন বোধ-লালিত এই ক্লাসিক্যাল ভাষায় তিনি কাব্য রচনা করেছেন। ‘শবাধারে মমি’তে যে ভাষার সূচনা সে ভাষার পরিচর্যায় তিনি একটা কাব্যধ্যান তৈরি করেছেন। এই কাব্যভাষায় নিজের কল্পনা ও পাঁজরকেই তিনি নিংড়ে দিয়েছেন। সনেট কবিতাতেই তার আস্থা। বাংলা ভাষায় কিংবা পরভাষায় কে লিখেছেন এতো সনেট।

ভালো থাকবেন মহাভারতের পাখি। ভালো থাকবেন সনেটের রাজন।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
৪ বছর বয়সে শুরু, জিতেছেন ১৬টি গ্র্যামি
শুভ জন্মদিন৪ বছর বয়সে শুরু, জিতেছেন ১৬টি গ্র্যামি
বজ্রাঘাতে ঘরে আগুন, পুড়ে মারা গেলেন ঘুমন্ত মা-ছেলে
বজ্রাঘাতে ঘরে আগুন, পুড়ে মারা গেলেন ঘুমন্ত মা-ছেলে
আসামি ধরতে গিয়ে ৩ পুলিশ আহত
আসামি ধরতে গিয়ে ৩ পুলিশ আহত
কৃষকের মুখে হাসি কপালে চিন্তার ভাঁজ
কৃষকের মুখে হাসি কপালে চিন্তার ভাঁজ
সর্বাধিক পঠিত
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ