X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

মার্কেসের 'আনটিল আগস্ট'

সারোয়ার রাফি
১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৪৫আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১০:২৫

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের শেষ উপন্যাস ‘আনটিল আগস্ট’-কে নভেলাই বলা যায়। ১০০ পৃষ্ঠারও কম, ৬টি চ্যাপ্টারে ভাগ করা নভেলাটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ৪৬ বছর বয়সী আনা ম্যাগদালিনা বাখ। তার নাম রাখা হয়েছে মিউজিশিয়ান জোহান সেবাস্টিয়ান বাখের দ্বিতীয় স্ত্রীর নামানুসারে। আনা বিয়েও করেছে ডোমিনিকো আমারিস নামে একজন মিউজিশিয়ানকে।

পুরো নভেলাটি আনার জবানিতেই বর্ণিত। এতে অন্যান্য চরিত্রের স্বর উঠে না-আসায় আনা যা বলে তাই আমাদের বিশ্বাস করতে হয়। আনার মা আট বছর আগে মারা যান। মায়ের শেষ ইচ্ছানুসারে ক্যারিবিয়ান দ্বীপে তাকে সমাহিত করা হয়। প্রতি বছরের আগস্টের ১৬ তারিখ মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে আনা একদিনের জন্য মায়ের কবরে ফুল দিতে ও কিছুক্ষণ সময় কাটাতে যায়।

মার্কেসীয় ঢঙে নভেলাটিতে নতুন বাঁক নেয় ঐ দ্বীপে আনার আট নাম্বার ভ্রমণে। ফিরে আসার আগে আনা একটি হোটেলে ওঠে। একজনের সাথে পরিচিত হয় ও তার সাথে সঙ্গম করে। পুরো নভেলাটিতে আনার একটি প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো, সে সাহিত্যের একজন নিবিড় পাঠক। তার রিডিংয়ের ঝুলিতে ছিল ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি, লাজারিল্লো ডি টরমেস, আলবেয়ার কাম্যুর দ্যা স্ট্রেঞ্জার, বোর্হেস, বিজয় ও ওকাম্পোর এন্থোলজি দ্যা বুক অব ফ্যান্টাসি, জন উইন্ডহামের দ্যা ডে অব দ্যা ট্রিফিডস, রে ব্র্যাডবেরির দ্যা মার্টিন ক্রনিকলস, গ্রাহাম গ্রিনের দ্যা মিনিস্ট্রি অব ফিয়ার এবং ড্যানিয়েল ডিফোর এ জার্নাল অব দ্যা প্লেগ ইয়ার। প্রতিটা সিচুয়েশনের সাথে এই বইগুলোর যোগাযোগ রয়েছে।

সঙ্গমের পর ঐ লোকটি আনার ড্রাকুলা বইটির মধ্যে ২০ ডলার রেখে যায়। লোকটি ভেবেছিল আনা একজন পতিতা, কিন্তু সে তা নয় এবং এজন্য আনা খুবই অপমানিত বোধ করে। এই অপমানবোধে তার জীবন আর স্বাভাবিক থাকে না এবং এক গোলকধাঁধায় আটকে যায়।

ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলার একটা থিম হলো, থ্রেট অব ফিমেইল সেক্সুয়াল এক্সপ্রেশন। ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে, নারীদের সেক্সুয়াল বিহেভিয়ার সমাজের অত্যন্ত কঠোর প্রত্যাশার মাধ্যমে নির্ধারিত হতো। একজন ভিক্টোরিয়ান নারীর দুটো অপশন ছিল : হয়তো সে ভার্জিন—বিশুদ্ধতা ও সরলতার মডেল হয়ে থাকবে, নয়তো সে হবে স্ত্রী এবং মা। যদি সে দুয়ের কিছুই না হয়, তাকে বিবেচনা করা হতো পতিতা হিসেবে। ড্রাকুলা যখন ইংল্যান্ডে আসে তখন তাকেও আমরা লুসি ও মিনার উপরে কালো জাদুতে ফিমেইল সেক্সুয়ালিটি নিয়ে এ দুটো ধারার ভালো ও খারাপের দ্বন্দ্ব দেখি। আনা ভার্জিন নয়। সে দুটি সন্তানের মা এবং স্বামী ডমিনিকোর সাথে যে খারাপ সম্পর্ক তাও নয়, বরং তারা দুজনেই সুখী। তবুও একটা সাময়িক সুখের খোঁজে আনা এমন এক অবস্থায় জড়িয়ে যায় এবং তার একরাতের শয্যাসঙ্গীর কাছে এমন এক সম্বোধন পায় যা হয়ত সে কল্পনাও করতে পারেনি। ফলে, একটি সুখী পরিবার পেয়েও সে পতিতা হয়ে যায় একজন নামহীন লোকের কাছে। ড্রাকুলা ব্যাকসাইডে এভাবেই কাজ করে।

পরেরবার ভ্রমণে সে যার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয় তাকে তিনবছর পর টেলিভিশনে চিনতে পারে। নামহীন লোকটি একজন সম্ভাব্য খুনী এবং পুলিশ তাকে খুঁজছে৷ এইবারও আনা সাথে নিয়ে যায় জন উইন্ডামের দ্যা ডে অব দ্যা ট্রিফিডস উপন্যাসটি। সায়েন্স ফিকশন এ উপন্যাসটি ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটিতে দেখানো হয়েছে একটি উদ্ভট মহাজাগতিক ঘটনার কারণে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ অন্ধ হয়ে যায়৷ এ অন্ধ হয়ে যাওয়া মানুষদের মাংসাশী ট্রিফিড গাছেরা হত্যা করতে শুরু করে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিল ম্যাসন, পেশায় একজন বায়োলজিস্ট যে কিনা এই ট্রিফিডসের নিয়ে কাজ করে। এই উপন্যাসের মধ্যেও নেসেসিটি ও মোরাল নর্মসের মধ্যকার দ্বন্দ্ব দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে বিল তার মোরাল কোড অনুসারে অন্ধ মানুষদের বাঁচাতে কাজে লেগে পড়ে। অন্যদিকে, বিডলি নামের আরেকটি চরিত্র নিজের সারভাইভাল বা বেঁচে থাকাকেই গুরুত্ব দেয়। এই উপন্যাসটি আরেকটি থিম হচ্ছে আশা। প্রোটাগনিস্ট আশাবাদী যে একদিন এই অবস্থার উন্নতি হবে। একদিন ট্রিফিডস গাছগুলোকে একেবারে উপড়ে ফেলতে পারবে। আনারও কি এরকম আশা ও মোরাল নর্মস থাকে? সে এই নামহীন লোকদের সাথে সঙ্গমের মাধ্যমে কি কোনো আশার আলো দেখছে যে এমন একটা সত্য সে খুঁজে পাবে যা সে চাইছে এবং এই সত্য আশা তাকে গোলকধাঁধা থেকে বের করে আনবে? একটি সুখী পরিবার পাওয়ার পরেও কি সে এইভাবে দূরের একটি দ্বীপে এসে এইরকম সারভাইভ করতে চাচ্ছে? আমরা উপন্যাসের ক্লাইমেক্সে এমনই আভাস পাই।

পরবর্তী ১৬ আগস্টে গিয়ে আনা এমন এক সত্যের মুখোমুখি হয় যার জন্যে সে প্রস্তুত ছিল না। এতোবছর ধরে সে ভেবে এসেছিল তার মা এই ক্যারিবিয়ান দ্বীপে এজন্য সমাহিত হতে চেয়েছিল যে এটি এমন এক নির্জন জায়গা যেখানে কেউ একা অনুভব করতে পারে না। কিন্তু সে আবিষ্কার করলো মায়ের আরো একজন অতিথি আছে যে কিনা তার মতোই কবরে ফুল দিতে আসে। আনা বুঝতে পারে এই দ্বীপে তার মায়েরও একজন প্রেমিক ছিল কিন্তু সেটা ছিল রোম্যান্স, তার মতো একের পর এক নামহীন ব্যক্তিদের সাথে সঙ্গমে জড়ানো নয়। সে বুঝতে পারে এটাই তার নিয়তি, বুঝতে পারে এতোদিন ধরে মিথ্যার পিছনে ছুটছে, বুঝতে পারে যে জীবনটাকে সে সুখী ভাবছিলো সেখানেও প্রতারিত হচ্ছে। বিবাহবহির্ভূত সঙ্গমে জড়িয়ে সে নিজেও প্রতারণা করছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার শারীরিক সৌন্দর্য হারানোর সাথে সাথে আরো একা হয়ে যাচ্ছে এবং এজন্যেই তাকে বলতে বলতে শুনি এই বয়সে নারীরা একা হয়ে পড়ে। বিবাহিত জীবনের মোরাল কোড ভেঙে সাময়িক সুখের খোঁজে এটাই হয়তো আনার সারভাইভাল, বেঁচে থাকা।

পরবর্তী দিন সে তার মায়ের হাড়গুলোকে দেখতে চায়। এই হাড়গুলোর মধ্যে আনা বাক্সের মধ্যে নিজেকেই দেখতে পায়। আনা ও তার মা একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। একজন জীবিত ও আরেকজন মৃত। আনা অনুভব করে তার মা তাকে মৃত্যুর ওপার থেকে দেখছেন, হয়তো ভালোবাসতেন ও কাঁদতেনও। ফলে এই দ্বীপ থেকে আনা এক নতুন বোঝাপড়া নিয়ে চলে যায়। জীবনের প্রতি তার এক এপিফেনি ঘটে। এক নতুন বোঝাপড়ার সাথে মায়ের হাড়গুলো নিয়ে বহুস্মৃতি পেছনে ফেলে দ্বীপ ছেড়ে চলে যায়। এই ভ্রমণে তার সাথে রাখে ড্যানিয়েল ডিফোর এ্যা জার্নাল অব দ্যা প্লেগ ইয়ার। এই বইটি ১৬৬৫ সালে প্লেগ মহামারির উপরে ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা। বইটি কেন্দ্রীয় চরিত্র এইচ.এফ. এর জবানিতে বর্ণিত। আনা বইটির রিডিংয়ে মনোযোগ দিতে পারেনি। হতে পারে আরেকটু পরে সে এমন এক সত্যের মুখোমুখি হবে যা খারাপ ও ভালো লাগার দর্শনে তার জীবনে মিশে যাবে এবং জীবনকে ফের নতুন করে বুঝতে শেখাবে৷ এজন্যেই হয়তোবা প্লেগের ঐ তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে দিয়ে যেতে চায়নি আনা।

নভেলাটি শুধু কেন্দ্রীয় চরিত্রের দৃষ্টিতে বর্ণনা করার ফলে আমরা অন্যান্য চরিত্রগুলোর ব্যাপারে তাদের জবানিতে তেমন কিছুই জানতে পারিনা। আমরা বেশিকিছু জানতে পারিনা নামহীন ঐসব মানুষদের ব্যাপারে যাদের সাথে আনা সঙ্গম করেছিল। জানতে পারিনা তার মায়ের প্রেমিকটির ব্যাপারে। ফলে এক স্বরেই বর্ণনার জন্যে একটা ন্যাচারাল ফ্লো নষ্ট হয় যা আমরা মার্কেসের অন্যান্য উপন্যাসগুলিতে দেখি না। ন্যারেটরই পুরো গল্পটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে আমাদের এ কথা মনে রাখতে হবে, ডিমেনশিয়ার কারণে মার্কেস এটিকে যথাযথ রিভিশন দিতে পারেননি, এজন্যেই তিনি বলেছিলেন এই বইটিকে নষ্ট করে ফেলার কথা।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চীনের দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক ধসে নিহত ৩৬
চীনের দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক ধসে নিহত ৩৬
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
রাশিয়ার বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের
রাশিয়ার বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের
কেনিয়ায় বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৮১
কেনিয়ায় বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৮১
সর্বাধিক পঠিত
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
মিল্টন সমাদ্দার আটক
মিল্টন সমাদ্দার আটক
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!