X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

জুতা 

এমরান কবির
২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১৬:১০আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১৬:১০

জুতা পরতে গিয়ে দেখি একটা আছে একটা নেই। কিন্তু গেলো কোথায়? জুতা রাখার শেলফে আতিপাতি করে খুঁজি। আশেপাশে দেখি। সিঁড়ির ওপরে নিচে দেখি। পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়ার শেলফের দিকে তাকাই। নাহ্। নেই তো। তবে কি বুয়া ঝাড়ু দেয়ার সময় ভুল করে ওই প্রতিবেশীর শেলফে রেখেছে! দ্বিধা ও শঙ্কা নিয়ে প্রতিবেশীর শেলফের হাতলে হাত রাখি। না। এখানেও নেই। অগত্যা গত ঈদে শাশুড়ির দেয়া নতুন জুতা জোড়া বের করতে হয়। নতুন জুতা পরে অফিসে যাই।
কিন্তু বিষয়টি কোনোভাবেই মাথা থেকে নামাতে পারি না। কী হলো জুতার? আর একটা জুতা নিয়ে চোরই বা কী করবে। এই বাসার সিকিউরিটি সিস্টেম এত সুন্দর যে কোনোভাবেই চুরি হওয়া সম্ভব নয়। তবে অবাক হলাম বউ এটা নিয়ে কটুবাক্য করল না। আমি তো ভেবেছিলাম বলবে, তুমি অফিসে রেখে এসেছো। একটা জুতা পরেই চলে এসেছো। যা ভুলো মন! আমাকেও ঠিকমতো চিনতে পারো না!
বউ একথা মুখে বলেনি ঠিক। কিন্তু সন্দেহ যে করেনি তা নিশ্চিত হব কী করে! অবশ্য চেঁচামেচির বদলে নিজেই নতুন জুতা-জোড়া বের করে দিলো। বলল, ‘আম্মু দিয়েছে। আম্মু দিয়েছে গত ঈদে। ভুলে গেছ? এটা পরে অফিসে যাও।’আম্মু দিয়েছে, আম্মু দিয়েছে- এভাবে দুইবার বলার মানে কী, তাও বুঝলাম না।
এসবই ভাবছি অফিসে বসে। আমার চেম্বারে এক ফেলো কলিগ এলো।
‘স্যার, আজ তো ফাইন খেয়ে গেলাম।’
আমি বললাম, ‘দেরি হলে তো ফাইন হবেই। তো, কেন দেরি হলো?’
‘আর বলবেন না স্যার, জুতা খুঁজে পাচ্ছিলাম না একটা। সে জন্য দেরি হলো।’
‘খুঁজে পেলেন অবশেষে?’ আমি একটু নির্লিপ্ত থাকার ভান করি।
‘না। শেষ পর্যন্ত পেলামই না। খুঁজতে খুঁজতে দেরি হয়ে গেল। অগত্যা পুরোনো জুতাটাই পরতে হলো। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে তলা গেল খসে। মান সম্মানের ব্যাপার।’
দুজনের একই রকম ঘটনা প্রায়। কাকতালীয় বলে একটা কথা আছে। এটা দেখি জুতাতালীয়। গাম্ভীর্যের ভান করে ভাবতে লাগলাম। ঘটনা কী?
সারাদিন কাজের চাপে ভুলে গেলাম জুতা হারানোর ঘটনা।

দুই
পরদিন।
একজন ম্যাসেঞ্জারকে স্যান্ডেল পায়ে দেখে ডাকলাম। আমাদের অফিসে স্যান্ডেল পরা নিষেধ। ম্যাসেঞ্জার কাঁচুমাচু হয়ে আমার সামনে দাঁড়ালো।
পায়ের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, ‘ফরহাদ, তোমার পায়ে স্যান্ডেল কেন? অফিসের নিয়ম কানুন ভুলে গেছ?’
ফরহাদ বলল, ‘সরি স্যার। কাল একটা জুতা হারাইছি। পুরানো এক জোড়া পরে এসেছিলাম গতকাল। আজকে সেটাও হারাইছি। একটু পর জুতা কিনতে যাব।’
আমি বললাম, ‘দুই দিনে দুই জোড়া জুতা হারিয়ে ফেললে?’
‘না স্যার। এক পিস করে। দুই দিনে দুই পিস। আলাদা দুই জোড়া জুতোই এখন কাজে আসছে না।’
আমি খুবই বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকালাম। আমার এক পিস জুতা হারালো গতকাল। একই দিনে হাবিব সাহেবেরও এক পিস জুতা হারালো। আজ শুনি ম্যাসেঞ্জারের দুই দিনে দুই পিস জুতা নেই। হচ্ছেটা কী?
ফরহাদ বলল, ‘স্যার, অনুমতি দিলে একটা কথা বলতে পারি?’
‘বলো’
‘স্যার, আমাদের অফিসের আরো অনেকেই জুতা হারাইছে। মারুফা ম্যাডাম, জুলফিকার স্যার, সোহেল রানা স্যার, হাবিব স্যার। সবাই একটা করে। ম্যাসেঞ্জারের মধ্যেও। হায়দার, রহমানেরও।’
আমি কিছু বলি না। চুপ করে আছি। এরই মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে এই এলাকার সাবেক কমিশনার ঢুকে পড়লো আমার চেম্বারে। ম্যাসেঞ্জার বের হয়ে গেল চা আনতে।
‘বস, একটা খবর জানেন?’
আমি বলি, ‘কী?’
‘জুতা হারানোর খবর জানেন? সবাই এক পিস করে জুতা হারাচ্ছে। পুরো শহর জুড়ে।’
আমি উৎসুক হয়ে নওশাদ ভাইয়ের দিকে তাকাই। আমিও যে হারিয়েছি তা আর বলি না।
‘কীভাবে যে কী হচ্ছে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। যত নিচ্ছিদ্রই হোক না কেন চুরি হচ্ছেই। কেউ আটকাতে পারছে না।’
আমি বললাম, ‘আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছে? আর নওশাদ ভাই, জগতে নিচ্ছিদ্র বলেও কিছু নেই। বেহুলা লখিন্দরের কাহিনি জানেন না?’
‘তা ঠিক। এদিকে মিডিয়াও তো নীরব। এরকম একটা ভুতুড়ে কাণ্ড ঘটছে। সবাই নির্বিকার। আপনার তো অনেক জানাশুনা। কোনো কুল কিনারা করতে পারেন?’
আমি একটু জোরেই হেসে দিলাম, ‘নওশাদ ভাই, আপনি নেতা মানুষ। আপনার কাছ থেকে খবরাখবর নেব। আর আপনি কি-না..।’
‘ভাই আমি এতো কিছু জানি না। আপনি কিছু জানলে আমাকে বলেন। আমার এলাকাটার অন্তত বিহিত করতে হবে।’
আমি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললাম, ‘নওশাদ ভাই, আমিও জুতা হারাইছি।’
নওশাদ ভাই হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন। পিয়ন চা দিয়ে গেছে। সেদিকে তাকালেনও না। আমি মনে মনে বললাম, সব সত্য বলা যায় না। যেমন আমি একটা সত্য চেপে গেলাম। আমার এক প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক বন্ধুর সাথে বিষয়টা শেয়ার করেছিলাম। বন্ধু বলেছিল, দোস্ত, এটা তো অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। তোর জুতা হারাইছে বলে তুই খোঁজ নেওয়া শুরু করেছিস। না-হারালে তো খোঁজই নিতিশ না। নিতি কি?’
আমি বলি, ‘আমরা বাঙালিরা তো এরকমই। নিজের লেজে পা পাড়া না পড়লে প্রতিক্রিয়া দেখাই না।’
সাংবাদিক বন্ধু বলল, ‘শোন, এটা পুরোনো ঘটনা। এখন তুই বলবি তাহলে এতদিন প্রকাশ পায়নি কেন। আমরাই বা কী দায়িত্ব পালন করলাম। শোন, ওপর থেকে একদিন ফোন করা হলো আমাকে। বলল, মারুত সাহেব, জুতা হারানোর খবর জানেন? আমি বললাম, জানি। কর্তাব্যক্তি খুব করে হাসলেন, বললেন, আপনি জানেন না। কারো জুতা হারাচ্ছে না। সব জুতাই আছে। সবার পায়ের দিকে তাকান। আপনার পায়ের দিকে তাকান। দেখেন জুতা আছে। আছে না? আমি বললাম, আপনি ঠিক বলেছেন। কোনো জুতা হারাচ্ছে না। আমার পায়েও জুতা আছে।’

তিন
পরের দিন আমি আরো একটা জুতা হারিয়ে ফেললাম। হারালাম মানে পাওয়া গেল না। এবার রক্ষা হলো না। স্যান্ডেল পায়ে দিয়েই অফিসে গেলোম। এখন মানুষ মানুষের মুখের দিকে তাকায় না। মানুষ তাকায় মানুষের পায়ের দিকে। দেখে জুতা না কি স্যান্ডেল।
অফিসের দ্বিতীয় প্রধান হিসেবে আমি এখানে কর্মরত। অ্যাটেনডেন্স দিয়ে চলে গেলাম জুতা কিনতে। কারণ স্যান্ডেল পরে অফিস করা যাবে না। আমাদের নিয়ম। প্রথমে গেলাম বাটার শো রুমে। ওমা! এক পিস জুতাও নেই। ইনচার্জ বলল, ‘স্যার সব জুতা বিক্রি হয়ে গেছে। স্পেশাল অর্ডার দেয়া হয়েছে। শিগগির জুতা চলে আসবে।’ 
আমি বললাম, ‘অ্যাপেক্সে পাওয়া যাবে? ইনচার্জ বলল, না স্যার সারা শহরের একই অবস্থা। কোথাও পাবেন না। দুই একদিন অপেক্ষা করতে হবে।’অগত্যা ফিরে এলাম স্যান্ডেল পায়ে দিয়েই।

চার
সাবেক কমিশনার নওশাদ ভাই ফোন করলেন, ‘ভাই, খবর তো বের করে ফেলেছি।’
আমি বললাম, ‘কী?’
‘জুতা চোরের কাহিনি।’
আমি খুব একটা আগ্রহ দেখালাম না। নির্লিপ্ত থেকে বললাম, ‘যেমন?’
‘জুতা চুরি করছে কুত্তা। মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে। শালা কুত্তাগুলোর অত্যাচার আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আমি একটা কাজ করেছি। সাঁওতালদেরকে বলে দিয়েছি, প্রতিদিন একটা দুইটা করে কুত্তা গভীর রাতে তোরা মেরে নিয়ে যাবি। তোদের ভালো মন্দ খাওয়া হবে। এভাবেই কুত্তা কমাতে হবে। তা ছাড়া তো উপায় নেই।’ 
আমি বললাম, ‘কিন্তু নওশাদ ভাই, বন্যপ্রাণী হত্যা করা তো বেআইনি। আপনার এই পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হয়নি।’
আমিই ফোনটা কেটে দিলাম।
একদিন পর এই কথোপকথন ভাইরাল হয়ে গেল। এর প্রতিক্রিয়া হলো বহুমুখী। নওশাদ ভাই আক্রান্ত হলেন কুত্তা রক্ষা কমিটির কর্মীদের দ্বারা। মামলা হলো নওশাদ ভাইয়ের নামে। তাঁকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে আক্রমণ করে ভাঙচুর করা হলো। জুতা হারানো উত্তেজিত জনগণের মধ্যে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে, সবগুলো জুতা রয়েছে সাঁওতাল পল্লিতে। তারা সাঁওতাল পল্লিতে আক্রমণ করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিলো। কথোপকথনে অংশগ্রহণ করার কারণে আমার নামে ডিজিটাল অ্যাক্টে মামলা হলো। আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো।

পাঁচ
আমার দোষ কোথায় সারাদিন চিন্তা করেও বের করতে পারলাম না। সারা দেশে বড় বড় বুদ্ধিজীবীদের সাথে আমার ওঠাবসা। কত ইস্যুতে আমি বিবৃতি দিয়েছি। সেগুলো খুব গুরুত্বের সাথে প্রচার হয়েছে। প্রভাবও বিস্তার করেছে। কিন্তু আমার গ্রেফতারে কারো কোনো প্রতিক্রিয়া পেলাম না। 
এক সপ্তাহ পর ছাড়া পেলাম। মিডিয়া আমার ওপর রীতিমতো হামলে পড়লো। আমি শুধু একটা কথাই বললাম। নো কমেন্টস। সরকার থেকে বলা হলো, এমরান কবিরকে গ্রেফতার করা হয়নি। তিনি আমাদের অতিথি ছিলেন। আমার আতিথেয়তার কিছু ছবি প্রচার করা হলো।

ছয়
রাস্তা দিয়ে যখন হাঁটি তখন দেখি সত্যি সত্যি জুতা মুখে কুকুর হেঁটে যাচ্ছে। গা সওয়া হয়ে গেছে সবার যেন। এখন স্যান্ডেলেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। অফিসের নিয়ম পাল্টানো হয়েছে। এখন থেকে জুতা বা স্যান্ডেল দুটোতেই অ্যালাউ। আমার দৃষ্টিভ্রম শুরু হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ শহরে কুকুরের সংখ্যা হঠাৎ করে বহুগুণে বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। সবার মুখে একটা করে জুতো।
হাঁটতে হাঁটতে লিলির মোড়ে এসে দেখি নতুন একটা জুতোর দোকান। সেখানে এক পিস করে জুতা বিক্রি হচ্ছে। আগ্রহ নিয়ে সেখানে গেলাম। দোকানি বুঝিয়ে দিলো, এখন কেউ এক জোড়া জুতা কেনে না। এক পিস কেনে। এবং তা বাসায় থাকা জুতার সাথে মিলে যায়। দাম একটু বেশি। আমি একটুও আগ্রহ দেখালাম না।

সাত
পরদিন শুনি যারাই এরকম জুতা কিনেছে প্রত্যেকের পায়ের তলা ফুটা হয়ে রক্তারক্তি অবস্থা। এখন জোড়া মেলানো জুতাও কেউ পরতে পারছে না।
আমি কাউকে বললাম না যে এরপর স্যান্ডেলেরও এক পিস করে হারানো শুরু হবে। জুতার জায়গায় স্যান্ডেলের ঘটনাগুলো ঘটবে। স্যান্ডেল শেষ হলে শুরু হবে এক পা হারানো। তারপর দুই পা। সবাই বলবে- সব ঠিক আছে, কোনো জুতা হারায়নি। পা-ও হারাচ্ছে না। আমাদের গতিও হারাবে না।
কিন্তু কাউকে এ কথা বললাম না। আগে লেখালেখি করে অনেক কথা বলতাম। এখন কিছুই বলি না। আমার হেলুসিনেশনের সমস্যা আছে। তার মধ্যে বয়স হয়েছে। ষাটের ওপর।
আমি আবারও বলি- আমার হেলুসিনেশনের সমস্যা শুরু হয়েছে। এ ধরনের সমস্যার কথা কাউকে বলতে নেই।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার, নদীতে ঝাঁপিয়ে পালালো পাচারকারীরা
ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার, নদীতে ঝাঁপিয়ে পালালো পাচারকারীরা
তীব্র গরমে কাজ করার সময় মাথা ঘুরে পড়ে দিনমজুরের মৃত্যু
তীব্র গরমে কাজ করার সময় মাথা ঘুরে পড়ে দিনমজুরের মৃত্যু
বাংলাদেশে সামাজিক বিমা প্রবর্তনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে: মন্ত্রিপরিষদ সচিব
বাংলাদেশে সামাজিক বিমা প্রবর্তনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে: মন্ত্রিপরিষদ সচিব
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড