X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১
ঈদ আনন্দ ২০২৩

গাছের সাথে কথা

অদ্বৈত মারুত
২২ জুন ২০২৩, ০২:০০আপডেট : ২২ জুন ২০২৩, ১৩:০৪

আয়নায় মুখ রেখে জয়ী পূর্ণতা দেখল, চুলগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। প্রতিদিন গোসলের পরই মা চুল আঁচড়িয়ে দেন। এটা মায়ের অভ্যাস। আজও দিয়েছিলেন বলে মনে পড়ল তার। কিন্তু এখন এলোমেলো। সে তো চুলে হাত দেয়নি। তা হলে কেমন করে এমন হলো? জয়ী পূর্ণতা কিছুই বুঝতে পারছিল না। তাই সে নিজেই চুল আঁচড়িয়ে নিতে চাইল। আয়নার সামনে গিয়ে চিরুনিটা খুঁজতে লাগল। কিন্তু পেল না। যেখানে সবসময় প্লাস্টিকের চিরুনিটা থাকে, সেখানে এখন নেই। খাটের নিচে খুঁজল। পেল না। পড়ার টেবিলের ওপর খুঁজল। পেল না। খেলনার ভেতরে খুঁজল। পেল না। রান্নাঘরে গিয়েও খুঁজল। পেল না। খুঁজতে খুঁজতে একসময় জয়ী পূর্ণতা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। কোথাও চিরুনিটা পেল না। কোথাও সে রেখেছিল কিনা, খানিকক্ষণ ভাবল। কিন্তু মনে করতে পারল না। আসলে সে চিরুনিটা ধরেইনি। মা তার চুল আঁচড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপরই রেখেছিলেন। তার মনে পড়ল। তবে কি চিরুনির পাখা গজালো? উড়ে দূরের কোনো বনে গিয়ে পাখিদের চুল আঁচড়িয়ে দিচ্ছে এখন? —এমন ভাবনাও ভাবল জয়ী পূর্ণতা। মনে জিদ চেপে বসল। যে করেই হোক, চিরুনিটা খুঁজে তাকে পেতেই হবে। প্লাস্টিকের ওই চিরুনিটা তার চাই-ই চাই।
মাকে ডাকবে কিনা, জয়ী পূর্ণতা একবার ভাবল। কিন্তু রাগ করতে পারেন ভেবে ডাকল না। তবে জয়ী পূর্ণতার মনের কথা ঠিকই বুঝল একটা রঙিন প্রজাপতি। সে তখন ডানা মেলে উড়ছিল। উড়তে উড়তে এসে বসল আয়নার গায়ে। ডাকল জয়ী পূর্ণতাকে—

‘জয়ী পূর্ণতা, এই জয়ী পূর্ণতা, এই যে আমি, এখানে।’

জয়ী পূর্ণতা মায়ের দিকে তাকাল। ভালো করে দেখল মায়ের চোখ ও মুখ। না, মা তো ঘুমিয়েই আছেন। তা হলে কে ডাকল? জয়ী পূর্ণতা যখন ভাবতে লাগল, তখন আবার ডাকটি শুনতে পেল—

‘জয়ী পূর্ণতা, এই জয়ী পূর্ণতা, এই যে আমি, আমার দিকে তাকাও। আমি একটা প্রজাপতি। তোমার চিরুনিটা কোথায়, তা আমি জানি।’

জয়ী পূর্ণতা প্রজাপতির দিকে তাকাল। কী যে সুন্দর রঙিন প্রজাপতি। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকল। ভালো করে দেখতে লাগল। কথা বলে কিনা, খেয়ালও করল। কিন্তু না, আয়নার গায়ে প্রজাপতিটি চুপচাপ বসেই আছে। নড়ছেও না, চড়ছেও না। দেখে তার মনে হলো, প্রজাপতিটা আসলে উড়তেই পারে না। কোনোদিন ওড়েওনি। বহুবছর ধরে আয়নার গায়ে এভাবেই লেগে আছে। একবার ধরতে চাইল। পরে কী মনে করে আর ধরল না। চুপচাপ তাকিয়ে থেকে প্রজাপতির রঙিন পাখা দেখতে লাগল।

‘এই জয়ী পূর্ণতা, অমন করে কী দেখছ? আমার পাখা খুব রঙিন, দেখতে সুন্দর, তাই না?’

‘হুম, খুব রঙিন, খুবই সুন্দর। এমন সুন্দর প্রজাপতি আমি আগে কখনো দেখিনি’—জয়ী পূর্ণতা প্রজাপতির সাথে কথা বলতে শুরু করল।

প্রজাপতি বলল—‘তুমি মনে হয় আমাদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানো না। শোনো, পৃথিবীতে আমার মতো বিশ হাজার ধরনের প্রজাপতি আছে। একেকটা দেখতে একেক রকম। একেকটার একেক রকম সৌন্দর্য। সুন্দর প্রজাপতির প্রতিযোগিতা হলে তুমি সবগুলো দেখে বলবে সুন্দর। যেমন কিছু প্রজাপতির পাখার নিচটা বেশ লম্বা আর ঝোলানো। রং হয় বেগুনি। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। আবার কিছু প্রজাপতির ডানা লাল বা কমলা। ডানার চারদিক ফিতার মতো। কিছু প্রজাপতির ফিতা ডোরাকাটা চিতাবাঘের মতো। কিছু প্রজাপতি ময়ূরের মতো। আরও কত কত রঙের যে প্রজাপতি বাস করে এ দুনিয়ায়! ওহ হো, আমাকে নিয়ে বলতে গিয়ে আসল কথাটাই তো বলতে ভুলে বসে আছি! আচ্ছা, তুমি কি চিরুনিটা আর খুঁজবে না? ওটা কি তোমার আর দরকার নেই?’

‘হুম খুঁজব তো’—বলল জয়ী পূর্ণতা। কিন্তু প্রজাপতিটা দেখতে এত সুন্দর যে, চিরুনির কথা আর মনে করতে চাইল না সে। প্রজাপতির ডানার দিকে তাকিয়ে রইল আপনমনে।

প্রজাপতি জয়ী পূর্ণতাকে ডাকল। উকুন আর চিরুনির গল্প শোনাতে চাইল। বলল, জয়ী পূর্ণতা, তুমি কি জানো, তোমার চুলের জন্য কোন চিরুনি ভালো? আর তোমাদের প্লাস্টিক চিরুনি কোথায় চলে গেছে?’

জয়ী পূর্ণতা বলল—‘না, না, কিচ্ছু জানি না তো’।

‘তবে শোনো, তোমাকে একটা গল্প শোনাই’ বলে প্রজাপতি একটু নড়ে উঠল। তার নড়াচড়া ভালো করে খেয়াল করল সে। দেখল, একটা টিকটিকি চুপিচুপি প্রজাপতির দিকে এগিয়ে আসছে। আর ঠিক তখনই প্রজাপতিটা উড়ে এসে বসল জয়ী পূর্ণতার কাঁধে। আয়নায় তা দেখল জয়ী পূর্ণতা।

প্রজাপতি বলল, আজ থেকে তিন হাজার সাতশ বছর আগের কথা। ইসরায়েল নামে এক দেশ আছে। সেই দেশের লাগেজ থেকে পাওয়া যায় একটা চিরুনি। সেটা আবার পাথরের। সেই চিরুনিতে লেখা ছিল মাত্র সাতটি শব্দ। তাও আবার ক্যানানাইট ভাষায়। লেখা ছিল—এই চিরুনি চুল ও দাড়ি থেকে উকুন সরাতে পারে।

প্রজাপতি জয়ী পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বলল—কিছু বুঝলে?

জয়ী পূর্ণতা বলল, না, কিছুই বুঝিনি।

প্রজাপতি বলল, উকুন সরাতে চিরুনির জন্ম হয় বহুকাল আগেই। তবে চুল সুন্দর রাখতেও চিরুনি ব্যবহার করত তারা। কিন্তু এখন বাজারে কত রকমের চিরুনি যে পাওয়া যায়, তার ঠিক নেই। তোমার মা গোসল করিয়ে দিয়ে ভেজা চুল যেভাবে প্লাস্টিকের চিরুনি দিয়ে আঁচড়িয়ে দেয়, তা মোটেও ঠিক নয়। তাতে চুল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আর প্লাস্টিকের চিরুনিও চুলের ক্ষতি করে।

জয়ী পূর্ণতা বলল, তা হলে কি দিয়ে চুল আঁচড়াতে হবে?

প্রজাপতি বলল, গোসলের পর চুল শুকিয়ে নিতে হবে প্রথমে। তার পর কাঠের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে নিতে হবে। দেখবে চুল কী ঝরঝরে থাকে, দেখতে কত সুন্দর লাগে।

জয়ী পূর্ণতা বলল—আচ্ছা, তা না হয় বুঝলাম কিন্তু প্লাস্টিকের চিরুনি কোথায় হাওয়া খেতে গেল!

প্রজাপতি এবার বলল, হ্যাঁ, সেই কথাই তো বলার জন্য তোমার কাছে এসেছি। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে। তোমার চুলগুলোও পছন্দ করে। চুলগুলো যাতে নষ্ট না হয়, কী করলে ভালো থাকবে, আমার কাছে জানতে চাইল। আমি ওকে পাখায় তুলে দূরে ফেলে দিয়ে এসেছি। আর তোমার জন্য নিয়ে এসেছি কাঠের চিরুনি।

জয়ী পূর্ণতা আয়নার সামনে দেখল একটা চিরুনি।

প্রজাপতি বলল—আরে, চিরুনিটা ধরেই দেখো না!

তখনই কাঠের চিরুনিটা কথা বলে উঠল। বলল—জানো জয়ী পূর্ণতা, আমি ছিলাম বিশেষ এক ধরনের কাঠ। আমাকে কেটে, ছেঁটে মসৃণ করে এভাবে চিরুনি বানানো হয়েছে। আমি তোমার চুলের যত্ন নেব। তবে কী জানো, আমাদেরও অনেক দুঃখ আছে। গাছপালা কেটে সব শেষ করে ফেলা হচ্ছে। মানুষ যে কেমন!

কাঠচিরুনির কথা শুনে জয়ী পূর্ণতা অবাক হলো কিন্তু ভয় পেল না। কাঠচিরুনি খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথাগুলো বলায় মুগ্ধ হয়ে শুনল সে। বলল—আরও কিছু বলতে চাও তুমি?

কাঠচিরুনি বলল, হ্যাঁ, আমাদের নিয়ে কেউ ভাবে না। আমরা না থাকলে যে পরিবেশও ভালো থাকবে না, থাকে না, এ কথা মানুষ বুঝতে চায় না। এই দেখো না, গাছপালা উজার হওয়ায় তুমি কত কষ্ট পাচ্ছ গরমে। তোমার মাকে ফ্যান চালিয়ে ঘুমোতে হচ্ছে। আবহাওয়া মোটেও ঠিক নেই। গরম আর গরম।

জয়ী পূর্ণতা জানতে চাইল, এখন আমাকে কী করতে হবে বলো?

কাঠচিরুনি বলল, একটা গাছ কাটলে দশটা গাছ লাগাতে হবে। মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে।

জয়ী পূর্ণতা বলল, আমি তো ছোট মানুষ। আমি কীভাবে বলব? আমাকে তো কেউ চেনে না।

কাঠচিরুনি বলল, সে আমি জানি। কিন্তু তোমার অনেক কিছু করার আছে। যেমন ধরো, তোমাদের বারান্দার টবে, বাসার ছাদে গাছ লাগাতে অনুরোধ করতে পারো মা-বাবাকে। তোমার চারপাশ সবুজে ভরে দিতে মানুষকে অনুরোধ করে একটা ভিডিও বানাতে পারো।

জয়ী পূর্ণতা বলল, তারপর কী করব?

কাঠচিরুনি বলল, খুব সোজা। তোমার মায়ের রান্নার ইউটিউব চ্যানেলে সেটা প্রকাশ করবে। দেখবে কত্ত মানুষ দেখে, মন্তব্য করে, লাইক দেয়। তোমার মিষ্টি গলা শুনে মানুষ আনন্দ পাবে। পরিবেশ সম্পর্কেও সচেতন হবে। মনে রেখো, তুমি বয়সে ছোট হলেও মনের দিক থেকে অনেক বড়। জানি, তুমি পারবে। তাই তো তোমার কাছে এসেছি আমি। আমাদের একসাথে লড়তে হবে, পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। পরিবেশ ভালো থাকা মানে সবার ভালো থাকা।

জয়ী পূর্ণতা মনে মনে অনেক বড় হয়ে যায়। সে পরিবেশ নিয়ে ভাবতে থাকে। সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ কীভাবে সুস্থ রাখা যায়, তা নিয়ে ভাবতে থাকে। নতুন নতুন পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনায় মা-বাবাকেও রাখে। তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে। আরও কী কী করা যায়, তা তিনজন মিলে ঠিক করে নেয়। বাবাকে দিয়ে প্রথমে গাছ ও টব কিনে নিয়ে আসে। মাটি আনায়। টবগুলো মাটি দিয়ে ভরাট করে। গাছ লাগায়। প্রতিদিন সকাল-বিকাল গাছে পানি দেয়। সার দেয়। গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দেয়। এভাবে যত্ন নেয় তিনজন মিলে।

গাছগুলো দিনে দিনে বড় হয়ে উঠছে। নতুন নতুন ডালপালা গজিয়ে উঠছে। সবুজ পাতায় ভরে উঠছে গাছগুলো। সবুজে সবুজে ভরে উঠছে বারান্দা ও ছাদ। গাছের ডালগুলো যে যেদিক পারছে, ছড়িয়ে পড়ছে। এখন প্রজাপতি এসে ডালে বসে, ফড়িংরা দল বেঁধে আসে। চড়ুই, টুনটুনিও এসে খেলা করে আপনমনে। ময়নাও কথা বলে তাদের সাথে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে জয়ী পূর্ণতা সবুজ পাতাগুলোর সাথে কথা বলে। সময় পেলেই কথা বলতে থাকে। গাছ এখন তার বন্ধু। গাছের সাথে কথা বলতে তার খুব ভালো লাগে। কথা বলে মনে মনে। তাতে পাতারাও সাড়া দেয়। তার সাথে মন খুলে কথা বলে। চুপে চুপে। আলতো বাতাস দোলা দিলে পাতারা জয়ী পূর্ণতাকে ছুঁয়ে দেয়। কী যে আনন্দ পায় সে।

তোমরাও বাড়ির চারপাশ নানা ধরনের গাছ লাগাতে পারো। ওদের যত্ন নিতে পারো। চুপে চুপে কথা বলতে পারো। ওদের তো প্রাণ আছে। কথা বলতে পারে। তবে চুপে চুপে বলে। এ কথা শুনতে হয় হৃদয় দিয়ে। যার মন সুন্দর, হৃদয় নরম, সে-ই কেবল সবচেয়ে ভালোভাবে কথাগুলো শুনতে পারে। গাছপালার সাথে চুপে চুপে কথা বলার মজাই আলাদা। কী যে আনন্দ লাগে!

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
উন্নত বিশ্বের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে আমরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত: পরিবেশমন্ত্রী
উন্নত বিশ্বের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে আমরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত: পরিবেশমন্ত্রী
সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি ওবায়দুল কাদেরের
দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যসময়মতো ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি ওবায়দুল কাদেরের
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম আবার বাড়লো
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম আবার বাড়লো
‘সিঁধেল চোর’ ধরতে মরিয়া পুলিশ
রাজধানীজুড়ে সাঁড়াশি অভিযান‘সিঁধেল চোর’ ধরতে মরিয়া পুলিশ
সর্বাধিক পঠিত
চুয়াডাঙ্গা জেলায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুয়াডাঙ্গা জেলায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সিস্টেম লস কমাতে সার্বক্ষণিক ম্যাজিস্ট্রেট চায় পেট্রোবাংলা
সিস্টেম লস কমাতে সার্বক্ষণিক ম্যাজিস্ট্রেট চায় পেট্রোবাংলা
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
এক ফ্রেমে এত ‘সুন্দরী’, স্মৃতিকাতর সকলেই!
এক ফ্রেমে এত ‘সুন্দরী’, স্মৃতিকাতর সকলেই!
আজকের আবহাওয়া: তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকার আভাস