X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে ধানমণ্ডির ‘রবীন্দ্র সরোবর’

ওমর ফারুক
২৮ এপ্রিল ২০১৬, ১৪:০১আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০১৬, ১৪:৩৬

রবীন্দ্র সরোবরে খাবারের দোকান ধানমণ্ডি লেকপাড়ের ‘রবীন্দ্র সরোবর’ প্রভাবশালীদের ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কারও কোনও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সরোবর প্রাঙ্গণে বসেছে একের পর এক দোকান। দোকানের পাশাপাশি পসরা সাজিয়ে বসে হকাররা। যেখানে-সেখানে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। দিন শেষে সরোবর প্রাঙ্গণে জমছে বর্জ্যের স্তূপ। এই বর্জ্য গিয়ে পড়ছে লেকের পানিতে। ফলে লেকের পানি দূষিত হচ্ছে। সৌন্দর্যহানি হচ্ছে রবীন্দ্র সরোবরের। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কার্যকর কোনও উদ্যোগও নিচ্ছে না।

ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার ৮ নম্বর সড়কের ব্রিজের পাশে রবীন্দ্র সরোবরের অবস্থান। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য সাবেক মেয়র প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের আমলে এখানে অ্যাম্ফিথিয়েটারের আদলে মঞ্চ ও গ্যালারি নির্মাণ করা হয়। খোলা আকাশের নিচে গ্যালারিতে বসে দর্শক-শ্রোতারা অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারেন। হাঁটা-চলার জন্য সরোবরে রয়েছে খোলামেলা জায়গা। প্রায় পনের বছর ধরে এখানে অনুষ্ঠানাদি চলে আসছে।

আরও পড়ুন: রাজধানী থেকে স্কুলবাস উধাও!

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রবীন্দ্র সরোবরের পরিচ্ছন্ন ও মুক্ত পরিবেশ এখন আর নেই। সরোবরের খোলা জায়গায় নির্মিত হয়েছে চটপটি, কাবাব ও ফাস্টফুডের দোকান। শুরুতে আকারে ছোট থাকলেও পরে প্লাস্টিকের শেড দিয়ে দোকানগুলোর আয়তন বাড়ানো হয়েছে। দোকানের সামনে খালি জায়গাজুড়ে বসানো হয়েছে চেয়ার-টেবিল। এতে করে বিকেলে যারা রবীন্দ্র সরোবরে আসেন তাদের হাঁটার জায়গা থাকে না।

রবীন্দ্র সরোবরে খাবারের দোকান মঞ্চ ও বসার গ্যালারি বেশিরভাগ সময় থাকে অপরিচ্ছন্ন। চিপস, আইসক্রিম, বিস্কুট ইত্যাদির খালি প্যাকেট ছড়িয়ে আছে যেখানে সেখানে। কেউ কেউ আবার লেকের পানিতেই এসব প্যাকেট ছুড়ে ফেলছেন। প্রাঙ্গণে কয়েকটি ডাস্টবিন থাকলেও সেগুলো থেকে উপচে পড়ছে বর্জ্য। জায়গায় জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। খরকুটোও ফেলা হয়েছে অনেক জায়গায়। সরোবর প্রাঙ্গণে সিটি করপোরেশনের একটি পাকা ছাউনি রয়েছে। এ ছাউনিতে রাখা হয় ওইসব দোকানের মালামাল ও চেয়ার-টেবিল।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, দশ বছর আগেও এতো দোকান ছিল না। তখন রবীন্দ্র সরোবরে আসা লোকজন বেশ সাচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারতেন। এখন আর সেই পরিবেশ নেই। দোকানপাট তুলে রবীন্দ্র সরোবরকে ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: গণপরিবহনের ভাড়া কমাতে সরকারের নির্দেশনা নেই

আলাপকালে ব্যাচেলর পয়েন্ট নামক দোকানের ম্যানেজার পরিচয়দানকারী মো. জামাল বলেন, আগে এখানটা নিচু ছিল। আমরা মাটি ভরাট করে দোকান নির্মাণ করেছি। এ জন্য লেকের লিজ গ্রহীতা তুষারকে ভাড়া দিতে হয়। দোকানের বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানে কয়েকজন পরিচ্ছন্ন কর্মী আছেন। তারা এগুলো সাফ করে দেবেন। কী শর্তে দোকান সাব-লিজ নেওয়া হয়েছে সেটা জানা নেই জামালের।

ডায়নামিক ফুড নামক অপর একটি দোকানের কর্মকর্তা বোরহান বলেন, কৃষক লীগ সভাপতি মির্জা জলিলের ছেলে তুষারের কাছ থেকে আমরা এই দোকান সাব-লিজ নিয়েছি। এ জন্য প্রতিমাসে তাকে ভাড়া দিতে হয়। কত টাকা ভাড়া দিতে হয় জানতে চাইলে তিনি তা বলতে রাজি হননি। এমনকি লিজ গ্রহীতা তুষারের মোবাইল ফোন নম্বর কিংবা অফিসের ঠিকানাও তিনি জানাতে পারেননি।

রবীন্দ্র সরোবরে খাবারের দোকানের চেয়ার, ময়লা আবর্জনা শুধু রবীন্দ্র সরোবরই নয়, লেকের আরও দু’টি স্থানে নতুন করে দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো হলো ২/এ সড়ক এবং ৫/এ সড়কের পাশে লেকের প্রান্তসীমায়। দু’টি স্পটই সাতসমজিদ রোডের পাশে। দেখা গেছে, লেকপাড়ের যেখানেই দোকানপাট রয়েছে, সেখানেই নোংরা পরিবেশ।

খাবারের দোকানগুলো বাদে লেকের সার্বিক পরিবেশ কিছুটা ভালো। তবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা কর্মী নেই। আলাপকালে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত এক নারী কর্মী বলেন, দিনের বেলায় ১৫-২০ জন নিরাপত্তা কর্মী রয়েছেন লেক এলাকায়। রাতেও কয়েকজন দায়িত্ব পালন করেন।

ধানমণ্ডি লেকের উন্নয়ন এবং এর দেখভাল করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। লেক উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে রবীন্দ্র সরোবর, ব্রিজ, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি নির্মাণ করেছে সংস্থাটি। এই নির্মাণকালে লেকের কোথায় কি থাকবে তা স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা মানছেন না প্রভাবশালীরা।

রবীন্দ্র সরোবর তথা লেক সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীনা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পাঁচ লাখ পঁচিশ হাজার টাকায় ডায়নামিক ফুড কোর্ট এবং আট লাখ টাকায় মেসার্স চিলিস মোনামী জেভি নামের দু’টি প্রতিষ্ঠানকে ধানমণ্ডি লেক (৩২ নম্বর সড়ক সংলগ্ন অংশ বাদে) এবং এর স্থাপনা লিজ দেওয়া হয়েছে। লিজ বাবদ ডিএসসিসির মাসে আয় হয় ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ২০১৩ সালে তিন বছরের জন্য এ লিজ দেওয়া হয়। গত ৩১ মার্চ লিজের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তিনি জানান, ডায়নামিক ফুড কোর্টের মালিক মির্জা শাহরুখ জলিল তুষার এবং চিলিস-মোনামী জেভির মালিক আবুল হোসেন কবির।

শাহীনা খাতুন আরও জানান, লেকের নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতার জন্য ‘কনসোর্টিয়াম অব এফটি ঢাকা সিকিউরিটি সার্ভিস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কাজের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানকে প্রতি মাসে পাঁচ লাখ টাকার বেশি পরিশোধ করা হয়।

রবীন্দ্র সরোবরে খাবারের দোকান দু’টি প্রতিষ্ঠানকে কী শর্তে লেকের জমি বাণিজ্যিকভাবে লিজ দেওয়া হয়েছে?- এমন প্রশ্ন করা হলে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা তার সামনে লেক সংক্রান্ত ফাইল নিয়ে বসে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী তানভির আহমেদের সহযোগিতা চান। কিন্তু নির্বাহী প্রকৌশলী তানভীর আহমেদ কোনও জবাব দেননি। এমনকি লিজের শর্তের কপিও এ প্রতিবেদককে দিতে সম্মত হননি তিনি। দোকানপাট তুলে লেকের পরিবেশ নষ্টের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আসলে আমাকে অনেক কাজ করতে হয়। এ কারণে সবদিকে খেয়াল রাখা সম্ভব হয় না।

স্থানীয় ওয়ার্ড-১৫ এর কাউন্সিলর জাকির হোসেন স্বপন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নির্বাচিত হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি লেকের পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তার বিষয়টা দেখতাম। এখন দেখছে ইব্রাহিম খলিল নামের একজন। যেহেতু আমি এই এলাকার কাউন্সিলর সেহেতু এ ব্যাপারে এখনও খোঁজ-খবর রাখতে হয়।

তিনি বলেন, লেকের সার্বিক অবস্থা ভালো। তবে রেস্টুরেন্ট ও খাবারের দোকানগুলো দেখাশোনা করে অন্যরা। এদের বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে লেকের নিরাপত্তায় ১২০ জন পুরুষ ও মহিলা কর্মী কাজ করছেন। এ কাজের জন্য সিটি করপোরেশন দিচ্ছে পাঁচ লাখ টাকা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এতে পোষাচ্ছে না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগের কিছু দুর্নীতিবাজের সহযোগিতায় ধানমণ্ডি লেকে ব্যবসার নামে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। মূল ডিজাইনকে পাশ কাটিয়ে তারা নিজেদের সুবিধামত দোকানপাট তুলেছে।

জানা গেছে, লেক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কমিটির রয়েছে। কিন্তু দুর্নীতিবাজদের কারসাজিতে এ কমিটির নিয়মিত বৈঠক হয় না। যোগাযোগ করা হলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিষয়টা মূলত দেখাশোনা করেন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও সেখানকার নির্বাহী প্রকৌশলী। লেক সম্পর্কে তারাই ভালো বলতে পারবেন।

আরও পড়ুন: এখনও জ্বলছে সুন্দরবনের আগুন

ছবি: নাসিরুল ইসলাম।

ওএফ /এপিএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন