শনিবার দুপুরে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, ঝালকাঠি, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রাম অঞ্চল ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে। সম্পদ বিনষ্ট ও প্রাণহানির দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে চট্টগ্রাম জেলা।
চট্টগ্রাম ব্যুরোর পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, রোয়ানুর প্রভাবে সৃষ্ট ঝড় ও বন্যায় বিনষ্ট হয়েছে অন্তত ৫০ কোটি টাকার ফসলসহ আনুমানিক ১০০ কোটি টাকার পশুসম্পদ। উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে এ জেলায় (১১ জন)।
চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) মেসবাহ উদ্দিন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলা ট্রিবিউনকে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
ডিসি জানান, বন্যায় শুধুমাত্র সন্দ্বীপ উপজেলাতেই অন্তত ১৫০০ গবাদি পশু ভেসে গেছে। এছাড়া গোটা জেলার উপকূলে ঝড়সহ ভূমি ধসে বিধ্বস্ত হয়েছে অন্তত আড়াই লাখ ঘরবাড়ি।
চট্টগ্রামের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলো হলো বাঁশখালীর খানখানাবাদ ও গন্ডামারা; সন্দ্বীপের রহমতপুর, সারিকাইত, উরিরচর, মগধারা, কালাপানিয়া। এসব অঞ্চল রোয়ানুর প্রভাবে সৃষ্ট বানের পানিতে তলিয়ে যায়।
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, এই ঘুর্ণিঝড়ে লক্ষ্মীপুরে প্রায় আড়াই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. সাজ্জাদুল হাসান।
জানা যায় শনিবার ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে লক্ষ্মীপুরের মেঘনা উপকুলীয় অঞ্চলের রামগতির বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে চারটি উপজেলার ১০ টি গ্রাম। এতে রামগতির চর আলগী, চর গজারিয়া, মৌলভীর চর, কমলনগরের চর কালকিনি, চর ফলকন ও সদরের চর রমনী মোহন ও রায়পুরের ৫টিসহ মোট ১০টি গ্রামে বিপুল সংখ্যক ঘরবাড়িসহ শতশত একর ফসলী জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
প্রায় ৫০টি কাঁচা ঘরবাড়ী ও শতাধিক গাছপালা ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে অর্ধশতাতিক ঘেরের মাছ। সেইসঙ্গে জেলার ৩শ’ একর জমির আউশ ধান ও ২শ’ একর জমির গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি নষ্ট হয়ে গেছে।
বরিশাল প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, বরিশালের আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কর্মকর্তা রমেন্দ্রনাথ বাড়ৈ জানান, বৃহস্পতিবার (১৯ মে) থেকে শনিবার (২১ মে) দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত বৃষ্টিতে জমির আউশের বীজতলা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হওয়াসহ ঝড়ো বাতাসে জমির পানের বরজ মাটিতে মিশে গেছে। নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় সবজির ক্ষেত ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ওয়হিদুজ্জামান জানান, অতিবর্ষণে পানি বেড়ে যাওয়ায় জেলার অধিকাংশ পুকুর ও মাছের ঘের তলিয়ে গেছে।
জেলা নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য অনুযায়ী বিভিন্নস্থানে ছোট বড় গাছপালা উপড়ে আসাসহ, মাছের ঘের তলিয়ে যাওয়া, কাঁচা-পাকা সড়ক, বাড়িঘর বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।
ঝালকাঠি প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, তিন দিনের টানা বর্ষণে জেলার জেলার ৪ উপজেলার মধ্যে ৫০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে রবি শষ্য, আউশ ধানের বীজতলা, উফসি আউশ ধানের ফসল, পানের বরজ, নার্সারী বাগান, মাছের ঘের ও গবাদি পশুর খামার। কাঁঠালিয়া ও রাজাপুরের নদী তীরবর্তী এলাকায় বানের পানি ঢুকে পড়ে রবি শষ্য ও ফসল তলিয়ে যায়।
রবিবার রাত পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতির পরিমাণ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস নির্ধারণ করতে পারেনি। জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মো. ফয়সাল আহম্মেদের প্রাথমিকভাবে দেওয়া তথ্য মতে জেলায় ১৬শ’ ঘর, ২ হাজার গবাদি পশুসহ ৬০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৬৫ কি.মি. পাকা ও ১৬৮ কি.মি. কাঁচা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাঁঠালিয়ার শৌজালিয়ার বেড়িবাঁধ বিভিন্ন স্থানে হয়েছে ক্ষতির শিকার।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যমতে কাঁঠালিয়া উপজেলার শৌলজালিয়া ইউনিয়নের রগুয়ার চর এলাকায় দুই কি.মি. বেড়িবাঁধ ভেঙে পড়া ও রাস্তা ডুবে যাওয়াসহ আমুয়া, চিংড়াখালী, মশাবুনিয়া, পাটিখালঘাটা ও আওরাবুনিয়ার ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়।
বরগুনা প্রতিনিধির পাঠানো খবর অনুযায়ী, জেলার বুড়িশ্বর ও বিষখালী নদীতে দেওয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপকূল রক্ষা বাঁধের প্রায় ১৭৫ মিটার অংশ ভেঙে গেছে। সেইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঁধের আরও ছয় কি.মি. দীর্ঘ অংশ। পাউবোর এসব বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলো হলো তালতলি উপজেলার নিশানবাড়িয়া, পাথরঘাটা উপজেলার কাকখিরা, বরগুনা সদরের নলটোনা ও আয়লা পাতাকাটা প্রভৃতি।
জেলায় আউশ ধানের ২ হাজার ৮ শত ৯৫ হেক্টরের বীজতলার মধ্যে পানির নিচ তলিয়ে গেছে ২ হাজার ৫শ’ ৯৯ হেক্টর। এছাড়া ২ লাখ ২০ হাজার ১৮ হেক্টর জমির গ্রীষ্মকালীন সবজিও বানের পানিতে তলিয়ে গেছে।
বাগেরহাট প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, জেলার বাগেরহাটের শরনখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদীর সাউথখালী ইউনিয়নের বেড়িবাঁধে কয়েকটি স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। বেড়িবাঁধে ফাটলের খবর জানতে পেরে বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর আলম বাঁধ এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
জানা গেছে, ২০০৭ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরে জলোচ্ছ্বাসে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারের সাউথখালীর বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়ে হাজারও মানুষের প্রানহানি ঘটে। পরে বাঁধটিকে টেকসইরূপে পুনঃনির্মাণ করতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে ‘কোস্টাল এমব্যাঙ্কমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের’ আওতায় তিন বছর মেয়াদি নির্মাণকাজ শুরু হয়। রোয়ানুতে বাঁধ নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সংস্কারকাজ মন্থর হয়েছে।
খুলনা প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য অনুযায়ী দাকোপ, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া ও কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় রোয়ানুর তাণ্ডবে সহস্রাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়াসহ বন্যা প্রতিরোধক বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
খুলনা জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখার সূত্র জানান, খুলনার উপকূলবর্তী দাকোপ উপজেলার সূতারখালী, কামারখোলা ও তিলডাঙ্গা এলাকার ৫ শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।
কয়রা উপজেলার বেদকাশি, ডুমুরিয়া উপজেলার শরাফপুর, চাঁদগড় ও পাইকগাছা উপজেলার হরিঢালী এলাকায় বেশ কিছু ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়াসহ বেড়িবাঁধ ভেঙে একাধিক গ্রাম প্লাবিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত মেহনাজ জানান, শরাফপুর বাঁধ কিছুটা ভেঙে গেছে। আগে থেকেই বাঁধটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বাঁধে কাজ চলা অবস্থায় ঝড়ের কবলে পড়ার কারণে ৭০০ বাসিন্দাকে আগেই আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়।
খুলনার ডিসি নাজমুল আহসান জানান, কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা পরিদর্শন শেষে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের আনুমানিক দেড় লাখ টাকার ক্ষতির কথা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান।
আরও পড়ুন: হত্যাকাণ্ডের অবসান চায় ইইউ
/এইচকে/