X
মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪
৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

যে কারণে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের ফল ঢাকার জন্য সুখবর নয়

রঞ্জন বসু, দিল্লি প্রতিনিধি
২৩ মে ২০১৬, ০০:৩৭আপডেট : ২৩ মে ২০১৬, ১৫:০৫

বাংলাদেশ ও ভারতের পতাকা ভারতে পাঁচ রাজ্যে ম্যারাথন ভোটপর্বের শেষে নির্বাচনি ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে গত ১৯ মে। এই পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে ছিল বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দু’টি বড় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম। পশ্চিমবঙ্গে বিপুল ব্যবধানে পুর্নির্বাচিত হয়েছেন মমতা ব্যানার্জির দল তৃণমূল কংগ্রেস, আর আসামে এই প্রথমবারের জন্য ক্ষমতায় এসেছে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। তবে দুই রাজ্যের কোনওটাই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্য খুব একটা ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, দলগুলো যেসব নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে এবং যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা  পেয়েছে, তাতে বাংলাদেশ সংক্রান্ত ইস্যুতে রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংঘাত আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে বলেই পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন।

তিস্তা নিয়ে আরও জোরদার দরকষাকষি

তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি যে প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তিতেই আটকে আছে এটা কোনও গোপন কথা নয়। তবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আশা করেছিল পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের পর মমতা যদি ফের জিতে আসেন তাহলে হয়তো তিনি তিস্তা নিয়ে সুর নরম করবেন। রাজনীতি বিশ্লেষকরা প্রায় একবাক্যে বলেছিলেন মমতা যদি ক্ষমতাতে ফেরেনও, তাহলেও তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনেক কমবে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তার দরকষাকষি করার ক্ষমতাও অনেক দুর্বল হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং দেখা গেছে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি  সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় ফিরেছেন মমতা ব্যানার্জি। এর অর্থ রাজ্যেই শুধু তার ক্ষমতা বাড়ছে না পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভাতেও তিনি এখন অনেক বেশিসংখ্যক এমপি পাঠাতে পারবেন। আর রাজ্যসভায় যেহেতু বিজেপির গরিষ্ঠতা নেই, তাই বিভিন্ন বিল পাস করানোর জন্য তৃণমূলকে তোয়াজ করে চলতে হবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও। সোজা কথায় দিল্লিতে তৃণমূল কংগ্রেসের দরকষাকষির ক্ষমতা কমার বদলে বাড়লো। এ বাস্তবতারই সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে তিস্তা চুক্তির ওপর।

আরও পড়তে পারেন: দেড়শো কোটি টাকার ক্ষত রেখে গেলো রোয়ানু

রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, তৃণমূল নেত্রী হয়তো এখন এই চুক্তিতে সম্মতি দেওয়ার বিনিময়ে পশ্চিমবঙ্গের বিপুল ঋণ মওকুফ করার শর্ত জুড়ে দেবেন। কেন্দ্রের সঙ্গে দরাদরিতে তিনি ভীষণই ওস্তাদ এবং এখন হয়তো তিনি বলবেন, তিস্তাতে রাজি আছি, কিন্তু তার আগে রাজ্যের এতো হাজার কোটি টাকার ঋণ মাফ করে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে অবধারিতভাবেই তিস্তা চুক্তির ভাগ্য নিয়ে নতুন করে সংশয় তৈরি হবে। কারণ এক কথায় এতো বিপুল ঋণ মওকুফ করাটা মোটেই সহজ নয়। ঋণ মওকুফ যদি নাও হয়, মমতার শর্ত যে মোটেই সহজ হবে না এটা ধরেই নেওয়া যায় এবং তাতে তিস্তা চুক্তির জট খোলাতেও দেরি হবে নির্ঘাত।      

আবার জামায়াত-জেএমবির বাড়বাড়ন্ত?

মমতা ব্যানার্জির পাঁচ বছরের মুখ্যমন্ত্রীত্বে যে বিষয়গুলো নিয়ে তাকে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে তার একটি হল পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামি ও জেএমবির শেকড় ছড়ানো। জামায়াত নেতাকর্মীরা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন,সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির টাকা জামায়াতের মাধ্যমে বাংলাদেশে নাশকতা সৃষ্টির জন্য পাঠানো হয়েছে, মমতার রাজত্বে জেএমবি জঙ্গিরা অবাধে পশ্চিমবঙ্গে তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তার করেছে। কিন্তু প্রশাসন সব জেনেশুনেও চুপ করে থেকেছে, এমন অজস্র অভিযোগ গত পাঁচ বছরে উঠেছে।

শুধু অভিযোগই কেন, বর্ধমানের খাগড়াগড়ে ২০১৪ সালের অক্টোবরে মারাত্মক বিস্ফোরণের পর তো প্রমাণই হয়ে গিয়েছিল জেএমবির শেকড় পশ্চিমবঙ্গের কতটা গভীরে। বর্ধমান থেকে শুরু করে মুর্শিদাবাদ, মালদা, নদীয়া সর্বত্রই তাদের প্রশিক্ষণ শিবিরের খোঁজ মিলল, পরে ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সির তদন্তে এটাও জানা গেল যে, পশ্চিমবঙ্গে বসেই তারা বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মারার ছক কষছিলেন।

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কিন্তু কখনও এই সব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরব হননি। এমন কী, খাগড়াগড় বিস্ফোরণের ঘটনায় নিন্দা জানাতেও তিনি এক মাসের মতো সময় নিয়েছিলেন। উল্টো তিনি গোয়েন্দা সংস্থার সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেই রাজ্যসভায় তার দল থেকে এমপি করে পাঠিয়েছিলেন ইমরান আহমেদকে। যিনি এককালে নিষিদ্ধ সংগঠন সিমির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বাংলাদেশে জামায়াত নেতাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল সুবিদিত। এমনও অভিযোগ উঠেছিল,সারদা কেলেঙ্কারির টাকা বাংলাদেশে পাচার করার পেছনে মূল মাথা ছিলেন তিনিই।

মমতা ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠরাও স্বীকার করেন, এই সব জঙ্গি বা মৌলবাদী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তিনি সেভাবে কখনও জোরালো প্রতিবাদ করেননি। কারণ তার মধ্যে একটা মুসলিম ভোট হারানোর ভয় কাজ করে। পশ্চিমবঙ্গের হয়তো ৯৯ শতাংশ মুসলিমই জামায়াত-জেএমবির কার্যকলাপ সমর্থন করেন না, তারপরও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মমতা ব্যানার্জির সরকার জামায়াত-জেএমবিকেই প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। ‘মমতা হয়তো ভাবেন, এই সব ইসলামি মৌলবাদীদের নিন্দা করলে মুসলিমরা তার ওপর চটে যাবেন। যদিও এই ধারণার কোনও ভিত্তি নেই’,স্বীকার করছেন তার দলেরই এক এমপি। 

২০১১ সালে ভোটে তার দল পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের পাশে পেয়েছিল, পাঁচ বছর পরে এবারের ভোটেও মুসলিমরা তৃণমূলকে ঢেলে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, এর ফলে পশ্চিমবঙ্গে জামায়াত বা জেএমবির কাজকর্ম নিয়ে মমতা সম্ভবত আরও চুপ করে যাবেন, আর তার সরকারের নীরব প্রশ্রয়েই পশ্চিমবঙ্গকে নিরাপদ অভয়ারণ্য হিসেবে বেছে নেবে এই দুই সংগঠনের লোকজন। যারা বাংলাদেশের ভেতর ক্রমশ: কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।    

আসামে ফের বাংলাদেশি হঠাও জিগির?

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে সবচেয়ে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে যে রাজ্যটিকে ঘিরে তা হল আসাম। উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রাজ্যটিতে সবচেয়ে বড় নির্বাচনি ইস্যু ছিল অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং বেআইনিভাবে যে বাংলাদেশিরা আসামে বসবাস করছেন, তাদেরকে রাজ্য থেকে তাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েই প্রথমবারের মতো আসামে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। এখন তাদের ভোটে জেতা সারা, কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি পালন করা নিয়ে জটিলতা অবধারিত।

আসামে যে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমরা আছেন, তাদেরকে দেশের নাগরিক বলে স্বীকার করার ক্ষেত্রে আসামে সংশয় আর সন্দেহ অনেক দিনের। কোন তারিখের পরে আসা মুসলিমদের ‘বিদেশি’ বলে চিহ্নিত করা হবে তা নিয়ে বাগবিতণ্ডাও দীর্ঘদিনের। আসামে গত পনেরো বছর ধরে রাজত্ব করেছে তরুণ গগৈ-র নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার, তারা এই কথিত বিদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে বেশ নরম মনোভাব নিয়েছিলেন বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। তবে আসামে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিস্থিতিও বোধহয় পাল্টাতে যাচ্ছে।

আরও পড়তে পারেন:৩৭টি হত্যাকাণ্ডের ২৫টিতে জড়িত জেএমবি

রাজ্যের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোওয়াল জেতার পর তার প্রথম সাক্ষাৎকারেই ঘোষণা করেছেন, আগামী দু’বছরের মধ্যে পুরো আসাম-বাংলাদেশ সীমান্ত সিলগালা করে দেওয়া হবে। সীমান্তে যেসব জায়গায় ফাঁকফোকর আছে সেগুলো যে কোনওভাবে বন্ধ করে নিশ্ছিদ্র করে তোলা হবে। শুধু তাই নয়,সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আসামে যে ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস (এনআরসি) তৈরির কাজ চলছে, সেই তালিকা তৈরির কাজ দ্রুত শেষ করাও তার অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়বে বলে জানিয়েছেন সোনোওয়াল।

এই তালিকায় যাদের নাম থাকবে না, তারাই বিদেশি বলে চিহ্নিত হবে এবং সরকার তাদের বাংলাদেশে পুশব্যাক করতে দ্বিধা করবে না সেটাও জানিয়ে দিয়েছেন আসামের নতুন মুখ্যমন্ত্রী। কাজটা বলা যতটা সহজ, অবশ্যই করা ততটা সহজ নয়, কিন্তু নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি রক্ষার তাগিদে বিজেপিকে অবশ্যই এ ব্যাপারে কিছু পদেক্ষেপ নিতে হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যে আঞ্চলিক দল অসম গণপরিষদকে জোটসঙ্গী করে তারা ভোটে লড়েছে, অনুপ্রবেশের বিরোধিতায় তারা বিজেপিরও এককাঠি আগে। ফলে চাপ থাকবে তাদের দিক থেকেও।

সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তনের জেরে যে সব ঘটনাপ্রবাহের ইঙ্গিত মিলছে, তা আগামীতে ঢাকাকে স্বস্তিতে রাখবে না কিছুতেই!

আরও পড়তে পারেন: ৬ জঙ্গির সবই জানে পুলিশ, অজানা শুধু ঠিকানা ও পরিচয়

 

 

 

/এসএনএইচ /এমএসএম /

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে কাজ করে চলেছে রকমারি ডট কম
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে কাজ করে চলেছে রকমারি ডট কম
বিছানায় পড়ে ছিল স্ত্রীর লাশ, ঘরের আড়ায় ঝুলছিলেন স্বামী
বিছানায় পড়ে ছিল স্ত্রীর লাশ, ঘরের আড়ায় ঝুলছিলেন স্বামী
রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির জন্মদিন আজ
রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির জন্মদিন আজ
সংসদীয় কমিটির তোপের মুখে টেলিটক
সংসদীয় কমিটির তোপের মুখে টেলিটক
সর্বাধিক পঠিত
রাইসির হেলিকপ্টারের অবস্থান ‘শনাক্ত’, সুসংবাদের প্রত্যাশা
রাইসির হেলিকপ্টারের অবস্থান ‘শনাক্ত’, সুসংবাদের প্রত্যাশা
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহত
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহত
রাইসির বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের ভিডিও প্রকাশ
রাইসির বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের ভিডিও প্রকাশ
ঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলবে
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, জানালেন ওবায়দুল কাদেরঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলবে
এ আর রাহমানের মুখে লালন ফকির থেকে শেখ হাসিনা...
কান উৎসব ২০২৪এ আর রাহমানের মুখে লালন ফকির থেকে শেখ হাসিনা...