X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সম্পত্তিতেও অধিকার নেই তাদের!

জাকিয়া আহমেদ
০৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৯:২৭আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:২৪

কেবল স্বীকৃতি নয়, মৌলিক অধিকারের অপেক্ষায় তারা

‘ছোট ভাইকে কোলে পিঠে করে বড় করেছি। ওর পছন্দ-অপছন্দ বোধ হওয়ার পর থেকে কখনও ওকে রেখে কিছু খেতে পারি নাই। ওর পছন্দের খাবার কোনওদিন নিজে খাইনি, ওকে খাইয়েছি। আর সেই ভাই কিনা বড় হওয়ার পর বাবাকে বলেছে, আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। মুখের ওপর বলেছে, আমার বউ বাড়ি এসে কী একটা হিজড়ার মুখ দেখবে?’ বাংলা ট্রিবিউনকে নিজের জীবনের দুঃখের কথা এভাবেই বর্ণনা করেন যৌন সংখ্যালঘুদের একজন শাম্মী। শাম্মী বলেন, ‘নিজে না খেয়ে ভাইকে খাইয়েছি, আগলে রেখেছি যতদিন পেরেছি। অথচ আজ আমার বাড়িতে যাওয়ার পথে প্রধান বাধা সেই ভাই। ’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার পরও এ বিষয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় যৌন সংখ্যালঘু এ সম্প্রদায় সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যার কারণে তারা মানবেতর জীবন যাপন করতেও বাধ্য হচ্ছেন।
শাম্মী বলেন,‘আমাদের অনেক সম্পত্তি,কিন্তু সেখান থেকে আমাকে কিছুই দেওয়া হয়নি, সব কিছু ভাইয়ের নামে। আমাদের বসতবাড়ি ছাড়াও অন্যখানে এক খণ্ড জমি রয়েছে। সেখানে একটা ঘর করতে চেয়েছিলাম থাকার জন্য, কিন্তু সেটাও আমার ভাই বাবাকে করতে দেয়নি। বাধ্য হয়ে আমি এখন ডেরায় (হিজড়াদের বাসস্থান) থাকি।’ শুধু শাম্মী একা নন, সম্পত্তিতে অধিকার না থাকা যেন এ সম্প্রদায়ের জন্য নিয়মে পরিণত হয়েছে। অনন্যা, চৈতি, লারা, পার্বতী, আঁখি, পাতা, জিনিয়া, ববিসহ সবারই এক অবস্থা। কেউ বাবার বাড়ি থেকে বিন্দুমাত্র সম্পত্তি পাননি। যৌনসংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিটি সদস্য জানান, পরিবারে কেবল মা-ই একমাত্র যতোটুকু সম্ভব সমর্থন দেয়। কিন্তু বাবা, ভাই-বোনসহ অন্য আত্মীয়স্বজন দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। যৌন সংখ্যালঘু জিনিয়া বলেন, ‘আপা, আমরা কেবল সম্পত্তি থেকেই বঞ্চিত নই, কোনও পরিবারও নেই আমাদের।পাই না মায়ের ভালবাসা, বাবার আদর-স্নেহ, ভাই কিংবা বোনদের মমতা। পরিবারের কেউ মারা গেলেও আমাদের খবর দেওয়া হয় না, যদি সেখানে উপস্থিত হয়ে বসি এই ভয়ে। জীবনের কোথাও আমাদের কোনও অধিকার নেই।’
সম্পত্তিতে হিজড়া সম্প্রদায়ের অধিকার কতোটুকু জানতে চাইলে যৌন সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাজ করা বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের লিগ্যাল কনসালটেন্ট মো. জাহিদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যখন বাবা বা মা মারা যান তখন উত্তরাধিকার সূত্রে একজন নারী হিসেবে নাকি একজন পুরুষ হিসেবে তিনি সম্পত্তি পাবেন সে বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই। যদি কোনও হিজড়া সম্পত্তির দাবি নিয়ে আদালতে যান, তাহলে তার প্রধান সমস্যা হয় আইডেন্টিটি নিয়ে।তাকে সেখানে পরিচয় বদলাতে হয়।’ কিন্তু হিজড়া জনগোষ্ঠীর দাবি, নিজস্ব পরিচয়ে তারা সম্পত্তির মালিক হবেন। দেশের যে প্রচলিত আইন রয়েছে সেটাও কেবল ছেলে ও মেয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ, একজন হিজড়ার জন্য সেখানে কিছু বলা নেই।
এক্ষেত্রে সরকারের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দরকার উল্লেখ করে মো. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যৌন সংখ্যালঘুদের সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু পরিবারের ছেলে এবং মেয়ের পাশাপাশি একজন হিজড়া কতোটুকু সম্পত্তি পাবেন সেটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া নেই। সেটা দেওয়া হলে শুধু সম্পত্তি নয়, যতগুলো মৌলিক অধিকার তাদের রয়েছে, সেগুলো যদি অ্যাড্রেস করা না হয় তাহলে এ ধরণের বৈষম্য এবং বঞ্চনা থেকেই যাবে।’
সংবিধান তাদেরকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিলেও তারা সেটা ভোগ করতে পারছে না। কারণ তারা নানা বৈষম্যের শিকার। আর এসব বৈষম্য রোধ করতেই অ্যান্টি ডিসক্রিমেশন অ্যাক্ট বা বৈষম্য বিলোপ আইন করা হয়েছে মন্তব্য করে এই অ্যান্টি ডিসক্রিমেশন অ্যাক্ট-এর সঙ্গে কাজ করা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ গোলাম সারোয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আইনটি এখনও পাস হয়নি, খসড়া আকারে আইন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। সঠিকভাবে যদি এ আইনের বাস্তবায়ন হয় তাহলে যৌন লংখ্যালঘুদের সম্পত্তিসহ সব অধিকার নিশ্চিত হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সব সনদ মেনে এবং সংবিধান অনুসরণ করে এ আইন করা হয়েছে।’ ‘অ্যান্টি ডিসক্রিমেশন অ্যাক্ট’-এর খসড়া করছে আইন কমিশন। ২০১৪ সালে তৈরি হয়েছিল এই খসড়া, যেটাকে মনে করা হয়েছিল একটি যুগান্তকারী আইন। কারণ শুধুমাত্র লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে পৃথক কোনও আইন বাংলাদেশে এর আগে হয়নি।
হিজড়ারাও মানুষ এবং তাদেরও সম্পত্তিতে অধিকার রয়েছে জানিয়ে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের খতিব ফরীদউদ্দীন মাসউদ বাংলা ট্রিবিউন বলেন, ‘পিতা-মাতার জায়েজ নেই তাদেরকে পরিত্যাগ করার, ইসলাম তাদেরকে অনুমতি দেয়নি এসব সন্তানদের পরিত্যাগ করার। অতি প্রাচীনকালে অনেক সাহাবি এবং আলেমদের মধ্যেও ছিল হিজড়া সম্প্রদায়ের, তাদেরকে মান্য করা হতো, আমারাও তাদের মান্য করেছি। কিন্তু বর্তমান সময়ে সমাজের কুসংস্কারের কারণে তাদেরকে আলাদা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, কিন্তু তারা সমাজের অঙ্গ। সমাজে একজন পুরুষের কিংবা নারীর যে অধিকার রয়েছে একজন হিজড়ারও সে অধিকার রয়েছে। তাকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না, সেটা সম্পত্তিসহ যে কোনও অধিকারই হোক না কেন।’

শাম্মী
হিজড়া সম্প্রদায়ের সম্পত্তির অধিকার নিয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. মো. ইউনুস আলী আকন্দ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একজন নাগরিক হিসেবে তার সকল অধিকার রয়েছে এই দেশে। এমনকি সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদেও রয়েছে একজন নাগরিকের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে আর ২৭, ২৮, ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার অধিকার রয়েছে সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার। সে হিসেবে অন্য সবার মতো হিজড়া সম্প্রদায়ও সম্পত্তি পাবার পূর্ণ অধিকার রাখে।’
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে সরকার হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ট্রাফিক ‍পুলিশ পদে তাদের চাকরি দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে বর্তমানে দেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নিয়ে কোনও পরিসংখ্যান নেই।
/এএআর/আপ-এইচকে/

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা