উত্তরায় খেলার মাঠে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনানকে কুপিয়ে হত্যার পর বেরিয়ে আসছে ভয়ঙ্কর সব তথ্য। ওই এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে কিশোরদের পাঁচটি গ্রুপ রয়েছে। যাদের বেশিরভাগই নামকরা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের প্রায় সবার বয়সই ১৮ বছরের নিচে। এই পাঁচ ‘গ্যাংয়ের’ মধ্যে মারামারি, অস্ত্র প্রদর্শন, মাদক নেয়, নিজেদের ভাগাভাগি করে নেওয়া এলাকায় ‘শো-ডাউন’ লেগেই থাকে। সবাই সব জানে, কিন্তু এখন কেউ মুখ খুলছে না। এরা এলাকার কিশোরীদের জন্য রীতিমতো ত্রাস হয়ে উঠেছে।
উত্তরায় সক্রিয় থাকা গ্রুপগুলোর মধ্যে রয়েছে বিগবস, ডিসকো বয়েজ উত্তরা, পাওয়ার বয়েস উত্তরা, নাইনএমএম বয়েজ উত্তরা ও নাইন স্টার (৯*)। এর মধ্যে আদনানের যোগাযোগ ছিল নাইন স্টারের সঙ্গে। তাদের দাবি, আদনানকে হত্যা করেছে ডিসকো গ্রুপের সদস্যরা।
প্রতিটা গ্রুপের ফেসবুক পেজ আছে। সেখানে তারা পরস্পরকে হুমকি দেওয়া, নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শণ কার নিত্যদিনের ঘটনা। এমনকি এদের প্রায় সবার ফেসবুক প্রোফাইলে ‘নিক নেইম’ (ডাক নাম) আছে। কারও নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নবাব, হিটলার বা বয়রা। আবার কারও নাম ইবলিশ। গ্রুপের ভেতর এসব নাম ধরেই ডাকা হয় তাদের। এদের ফেসবুক গ্রুপ ও ব্যক্তিগত প্রোফাইল স্ট্যাটাসে ইমো হিসেবে বোমা, পিস্তল, সিগারেট ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এছাড়া এক গ্রুপ আরেক গুপকে গালি দিয়ে তাদের এলাকায় প্রবেশ করলে ‘দেখে নেওয়ার প্রকাশ্য’ হুমকি দেয়।
আদনানের মৃত্যুর পর বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছে নাইন স্টার গ্রুপের এক সদস্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সে জানায়, ‘আদনান আমাদের গ্রুপের ভাই। তার এ পরিণতির প্রতিশোধ আমরা নিতে চাই।’
আদনানের গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বিষয়ে সে বলে, ‘উঠাবসা একসঙ্গে ছিল আমাদের। ও তৈরি হচ্ছিল। ডিসকো গ্রুপের যারা আদনান হত্যায় অংশ নিয়েছিল তাদের আমরা চিনি। আমরা জানি তাদের বিচার হবে না। আপনারা খোঁজ নিলেই জানবেন। মূল হত্যাকারীর বাবা কত বড় পদমর্যাদার লোক।’
উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন আমরা কি সব জেনেও না জানার ভান করছি। এই গ্যাংগুলোর নাম মোটামোটি সবার মুখে মুখে। এদের ভয়ে এখন না জানার ভান করছি। বিষয়টা কারোরই অজানা নেই যে বিষয়টি ‘গ্যাং-ওয়ার’ নামক নোংরা খেলা। কেউ চেষ্টা করছেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে।’
উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, ‘এলাকাভিত্তিক একেকটা গ্রুপ আমাদের ছোটবেলাতেও দেখেছি। কিন্তু সেগুলো রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। উত্তরায় যা হচ্ছে তা এক কথায় ভয়ঙ্কর। এদের সবার বয়সই ১৮ বছরের নিচে। কিন্তু এদের চলাফেরা, আচরণ এবং যেসব বিষয়ে পরস্পর মারামারি করে সেগুলো বিভৎস।’
তিনি আরও বলেন, উত্তরায় যে ছেলেটা খুন হয়েছে সে এমনই একটি গ্রুপ করতো। এসব দলগুলোর সঙ্গে পুলিশ কথা বললেই জানতে পারবে এদের গ্রুপের নেতারা কলেজের প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আর দলের সদস্যরা অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্র।
বিষয়টি নিয়ে কাজে নেমেছে জাস্টিস ফর উইমেন বাংলাদেশের মাহবুবুর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উত্তরায় এখন পর্যন্ত আমরা ৫টি গ্রুপের সন্ধান পেয়েছি। আদনানের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করা কোনও সমস্যা না। কারণ এদের সবাই চেনে। প্রশ্ন হলো, আমাদের প্রশাসন কী করছে। গত পরশুদিন উত্তরায় যা ঘটলো সেটি হুট করে ঘটা কোনও ঘটনা না।’
তিনি বলেন, ‘এসব দলর পরস্পরের এলাকা নির্দিষ্ট করে সেই এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা আছে তাদের প্রোফাইলে। এমনকি ফেসবুকে তারা আদনান হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। এসব কারোর নজরে পড়ে না?’
উত্তরা থানার (পশ্চিম) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলী হোসেন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এরই মধ্যে দুজনকে আটক করা হয়েছে। এরা সবই স্কুলের ছেলে।’ এরা কোনও গ্রুপের কথা বলেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গ্রুপ ট্রুপ না, স্কুলের পোলাপাইন। একসঙ্গে চলে না, সে রকমই।’ আটককৃতদের মধ্যে এক আসামি জেলা জজের ছেলে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আটক আছে, সাবেক জাজ। সে আটকই আছে।’
আরও পড়ুন: ‘ডিসকো বয়েজ’ ও ‘নাইন স্টার’ গ্রুপের দ্বন্দ্বেই মৃত্যু আদনানের!
/এসটি/